পারিবারিক ও দাম্পত্য-জীবনেও সফল ছিলেন ইমাম খোমেনী-র.
সুখের নীড় - পর্ব ২১ ( পরিবার বিষয়ে ইমাম খোমেনি-র.)
আজকাল বদলে গেছে দিন!/ নেই আর সস্তার সেইসব সুদিন! স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে যাওয়া ভ্রমণে অথবা রেস্তোরাঁয় কিছু খেতে যাওয়া মানে বিল দেয়ার সময় চেহারাটাকে করা বিবর্ণ মলিন! / অনর্থক বিলাসিতা অথবা বোকামি! পরিণতি মাসের শেষে বাড়তি চাপ! মনে হতে পারে আক্কেল সেলামি!
হ্যাঁ, বিষয়টা বেশ কঠিন!/ তবুও ঘণ্টা কয়েকের এই বিনোদনে
কেটে যায় একঘেয়েমি, অবসাদ ও ক্লান্তি!
হৃদয়গুলো ভরে যায় মিলনের প্রফুল্লতায়, দিনগুলো হয়ে ওঠে আবারও চনমনে!
আরও অনেকে বেশি অর্থ দিয়েও কেনা যায় না তেমন প্রশান্তি!
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে নৈতিকতা, সংস্কৃতি ও সামাজিক শক্তির কেন্দ্র হিসেবে। পরিবারকে ঘিরে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে গেছেন এর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও বিশেষ করে ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনি এবং এখন এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি। এ বিষয়গুলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে করে অনেক বেশি গভীর ও অর্থবহ। সমাজে খোদাভীতি ও ইমানের আলোকে নৈতিকতার বিকাশ ঘটিয়ে সব ধরনের অনাচারের উপাদানগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পরিবারগুলোকে সুসংহত ও রক্ষা করার বিষয়টি ইরানের সংবিধানেও গুরুত্ব পেয়েছে।
ইমাম খোমেনি (র) বলতেন, মানবিকতা বা ইনসানিয়াতের দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, তবে তাদের নিজস্ব বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। মানুষ হিসেবে তারা সমান হওয়া সত্ত্বেও শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। এই পার্থক্যগুলো এমনই যে তারা যদি পরস্পরের পাশে থাকেন তাহলে তারা একে অপরের পরিপূরক হন এবং তাদের বন্ধন বয়ে আনে এক পরিপূর্ণ পরিবার।
মরহুম ইমাম খোমেনির দৃষ্টিতে পরিবার গঠনের উদ্দেশ্য হল স্বামী ও স্ত্রীর প্রশান্তি অর্জন এবং সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য এক নিরাপদ কেন্দ্র গঠন করার পাশাপাশি দায়িত্বশীলতার আলোকে মাতৃত্বের মহতী মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যা ইসলামী সমাজের অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয়।
ইমাম খোমেনি র. মনে করতেন পরিবার হচ্ছে মানুষ গড়ার ও নানা গুণ অর্জনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষালয় এবং পরিবারই হচ্ছে আধ্যাত্মিক উন্নতি ও অগ্রগতির মাধ্যম। আত্মগঠন ও আত্মিক পরিশুদ্ধির কাজে পরিবারের ভূমিকা হচ্ছে প্রধান যন্ত্রের মত।
ইমাম খোমেনীর মতে স্ত্রী বা মাতা পরিবার নামক শিক্ষালয়ের প্রধান ও প্রথম শিক্ষক। তারাই সন্তানের জন্য সৌভাগ্যের প্রাথমিক ভিত গড়ে দেন। তাই সংসারের কর্তী বা গৃহিণীকে বিশেষভাবে সম্মান দেয়া উচিত এবং তার ওই পেশা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশা যাকে প্রায়ই খুব কম গুরুত্ব দেয়া হয়। ইমাম খোমেনীর কন্যা ফরিদা মোস্তফাভি বলেছেন, ইমাম খোমেনীর নাতি নাতনিরা সবাই শৈশবে হৈ-চৈ করত। ওদের চপলতার ব্যাপারে আমি বাবার কাছে অভিযোগ করলে তিনি বলতেন, হুসাইনের দুষ্টুমিগুলো সহ্য করার কারণে তুমি যে ব্যাপক সাওয়াব অর্জন করছ আমি আমার সব ইবাদতের সাওয়াব দিয়ে হলেও তা অর্জন করতে প্রস্তুত রয়েছি!
পবিত্র কুরআনেও পরিবার বলতে যে পরিবেশের চিত্র ফুটে উঠে তা হল দয়া, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার কেন্দ্রস্থল হল পরিবার। প্রশান্তির এই কেন্দ্রস্থল নানা মন্দ স্বভাব দুর করা ও নানা দুশ্চিন্তা দুর করারও কেন্দ্র হওয়া উচিত যাতে সেখানে খোদায়ি রহমত নেমে আসার পথ প্রশস্ত হয়। মরহুম ইমাম খোমেনি (র) মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নশীল হতে নিজের সন্তানদের উপদেশ দিতেন। তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো এক সন্তানকে উদ্দেশ করে লিখেছেন: সব মা-ই আদর্শ মা, তবুও তাদের কেউ কেউ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আমি আমার দীর্ঘ জীবনে তোমাদের সম্মানিত মায়ের মধ্যে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখেছি। এ ব্যাপারে আমার অনেক স্মৃতি মনে পড়ে সেইসব রাতের ও দিনের যখন তিনি সেই দিন ও রাতগুলো নিজের শিশুদের নিয়ে কাটিয়েছেন। এখন আমি তোমাকে ও আমার অন্য সন্তানদের ওসিয়ত করছি যে তোমরা তার সেবায় সচেষ্ট থাকবে এবং আমার মৃত্যুর পর তোমরা তার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে যেমনিভাবে তাকে আমি তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট দেখছি আমার জীবদ্দশায়। আমার মৃত্যুর পর তোমরা তার সেবায় থাকবে বেশি নিয়োজিত।
পারিবারিক মূল্যবোধের একটি মহতী দিক হল পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি ত্যাগ-তিতিক্ষা। এ বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়ায় এবং পরিবারের ভিত্তিগুলোকে রক্ষায় সহায়তা করে। পারিবারিক মহতী গুণগুলোর বিকাশ পরিবারের ও সমাজের জন্য বয়ে আনে সুস্থতা, আন্তরিকতা, প্রফুল্লতা, সততা ও পবিত্রতা । সন্তানদের সুস্থ নৈতিক পরিবেশের মধ্যে সুশিক্ষিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমাম খোমেনী র. এই বিষয়গুলোর দিকে খুব লক্ষ্য রাখতেন। তিনি কোনো অবস্থাতেই ঘর ও পরিবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকতেন না যদিও রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছে চিঠি লিখতেন। চিঠিতে নিজের কাজকর্মের বিবরণ দিতেন ও পরিবারের সদস্যদের কার কি অবস্থা সেসব খবরও নিতেন। ইমাম খোমেনী একজন বড় ইসলামী আইনবিদ ও সংগ্রামী ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও পারিবারিক ও দাম্পত্য-জীবনেও ছিলেন সফল। তিনি স্ত্রীর প্রতি ছিলেন বেশ শ্রদ্ধাশীল, আমানতদার ও অনুরাগী। তিনি পবিত্র হজের সফরে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে স্ত্রীকে উদ্দেশ করে অত্যন্ত অনুরাগপূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন। ইমাম লিখেছিলেন:
আল্লাহর কসম! তোমার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করব ও সদকা হব! এই যে সময়টুকু আমি আমার প্রিয়তম চোখের আলো ও হৃদয়ের শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি এই সময়ে তোমাকে স্মরণে রেখেছি। তোমার সুন্দর চেহারা আমার হৃদয়ের আয়নাতে হয়ে আছে অঙ্কিত। প্রিয়তমা, আশা করছি আল্লাহ তোমাকে সুস্থতার মধ্যে ও আনন্দের মধ্যে নিজের আশ্রয়ে রেখে হেফাজত করবেন। আমার অবস্থা এমন যে যত কঠোরতাই আসুক না কেন তা কেটে যাবে, অবশ্য মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি এ জন্য যে এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তা সুখময়ই ছিল। এখন আমি সুন্দর শহর বৈরুতে রয়েছি। সত্যিই তোমার অভাব অনুভব করছি দারুণভাবে। শুধু দেখার জন্য এই শহরে ও সাগরে খুব সুন্দর দৃশ্য রয়েছে। এমন সব সুন্দর দৃশ্যপট, অথচ শত দুঃখের বিষয় যে প্রিয়তমা প্রেয়সী আমার সঙ্গে নেই!... তোমার আয়ু ও সম্মান অফুরন্ত হোক। তোমার জন্য উৎসর্গ-প্রাণ- রুহুল্লাহ। -সত্যিই ইমাম খোমেনির চিঠির এমন শ্রদ্ধাপূর্ণ আন্তরিকতাপূর্ণ ভাষা সবার জন্য অনুসরণীয়।
ভালো স্ত্রী বা স্বামী তথা জীবন-সঙ্গী আল্লাহর অত্যন্ত বড় অনুগ্রহ। মহান আল্লাহর অনুগ্রহগুলো গুণে শেষ করা সম্ভব নয় ও এসবের কৃতজ্ঞতা পুরোপুরি আদায় করাও সম্ভব নয়। অথচ অনেকে খুব ভালো স্ত্রী পেয়েও জীবনের শেষ পর্যন্তও তা বুঝতে পারে না। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ভালো জীবনসঙ্গী পেয়ে হে আল্লাহ তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ- এ কথা বলা বা কৃতজ্ঞতার সিজদা দেয়াই যথেষ্ট নয়। বরং প্রকৃত কৃতজ্ঞতা হল এই নেয়ামতের গুরুত্বকে বোঝা। এ নেয়ামত যে আল্লাহই তাকে দিয়েছেন তা মনে রেখে আল্লাহর পছন্দনীয় পন্থায় তাকে ব্যবহার করা ও তার সঙ্গে আচরণ করাটাই হল আসল কৃতজ্ঞতা। ... বিয়েও হল আল্লাহর এক নেয়ামত। তাই এই নেয়ামতের জন্য যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ জরুরি।
সহধর্মী বা সহধর্মীনী মানুষের জন্য বয়ে আনে শান্তি, সুরক্ষা ও অনুরাগ। তাই খোদায়ি এই নেয়ামতের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। তাই স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে সদাচার, সহৃদয় ও আন্তরিক ব্যবহার জরুরি। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৩