নভেম্বর ২৮, ২০২২ ১৮:১৩ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা মানব সভ্যতার বিকাশে পদার্থবিজ্ঞানের অবদান এবং প্রাচীনকাল থেকেই ইরানে এ সংক্রান্ত বিদ্যাচর্চার ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছিলাম। এ পর্বেও এ বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখব।

পদার্থবিজ্ঞানের যেসব শাখায় ইরানি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন এবং আবিষ্কার করেছেন চলমান অনুষ্ঠানে আমরা তাদের বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিটি বহু বছর আগ থেকেই সারা বিশ্বের গবেষকদের প্রতি নজর রেখে আসছে। এটা পরিষ্কার যে, বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানুষের পারিপার্শ্বিক যেকোনো বস্তুজগতের রহস্য উৎঘাটন করতে হলে প্রাকৃতিক অবস্থান নির্ণয় এবং জরিপ পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে হয়। সে কারণে সঠিক পরিমাপের একক নির্ধারণ সম্পর্কে জানা জরুরি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায় প্রতিটি কাজের সাথে মাপ-জোখের বিষয়টি জড়িত। বিভিন্ন গবেষণার কাজে প্রয়োজন হয় সূক্ষ্ম পরিমাপের। পাদর্থবিজ্ঞানের প্রায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেই পদার্থের পরিমাণ, বলের মান, অতিবাহিত সময়, শক্তির পরিমাণ ইত্যাদি জানতে হয়। এ ছাড়া, পরিমাপের একক, এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি, পরিমাপক যন্ত্র প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। বহুকাল ধরেই ইরানে বস্তুর পরিমাপ এবং ওজন মাপার জন্য বিভিন্ন রকম সরঞ্জাম ছিল এবং এর বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বস্তুর নির্দিষ্ট ওজন পরিমাপ করার কাজে এসব যন্ত্রপাতি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন আবু রেইহান বিরুনি।

আবু হাতেম মোজাফ্ফর বিন ইসমাইল

ইসলাম আসার পর মুসলিম সমাজে ওজন মাপার বিভিন্ন রকম স্কেল তৈরিতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটেছিল।

আবু হাতেম মোজাফ্ফর বিন ইসমাইল এসফাজারির লিখিত 'মিজান আল হিকমা' গ্রন্থে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ী এসব স্কেল তৈরি হতো এবং তিনিই ছিলেন এর আবিষ্কারক। আবু হাতেম ছিলেন হিজরি পঞ্চদশ শতকের ইরানি খ্যাতনামা গণিতবিদ। আলোকবিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা যা আলোর আচরণ, বৈশিষ্ট্যাবলী এবং বস্তুর সঙ্গে আলোর পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বর্ণনা করে। আলোকবিদ্যা আলোক সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষ ঘটনা ব্যাখ্যা করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতির জগতে আলোকবিজ্ঞান বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত বর্ণনা ইরানি মনীষীদের সক্ষমতাকে তুলে ধরে। মোহাম্মদ বিন জাকারিয়া রাজি, কামাল উদ্দিন ফারসি, ইবনে হিশাম, কাতেব উদ্দিন শিরাজি প্রমুখ মনীষীরা আলোকবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডেকার্টেজ, ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স ও আইজ্যাক নিউটনের মত বিজ্ঞানীদের চাইতেও অগ্রগামী ছিলেন।

সারাখসি ও রাজির মতো ব্যক্তিরা ছিলেন ইরানের প্রথম সারির বিজ্ঞানী যারা শ্রবণ শক্তি ও পদার্থবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দ বা ধ্বনিবিদ্যার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। দর্শনশাস্ত্রে খ্যাতনামা ব্যক্তি আবু নাসের ফারাবি এ বিষয়ে মূল্যবান গবেষণাকর্ম উপহার দিয়ে গেছেন।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জ্যোতির্বিদ্যা হচ্ছে অন্যতম একটি প্রাচীন শাস্ত্র। ইরানের মুসলিম মনীষীরা এ ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তারা বিভিন্ন রকমের সূর্যঘড়ি ও মহাকাশ গবেষণার যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছেন যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে আজো সংরক্ষিত আছে। মোটকথা, এটা বলা যায় যে আজকে আমরা প্রযুক্তির চোখ ধাঁধানো যে অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি তার পেছনে এইসব মনীষীদের রেখে যাওয়া গবেষণা ও আবিষ্কারের কাছে আমরা ঋণী।

অন্ধকার ঘর ও সেটাতে আলো প্রবেশের মাধ্যমে ছবি তোলার অভিনব কৌশল আবিষ্কার করেন ইবনে হাইসাম বাসরি। এ কৌশলকে অ্যাপারচার বলে। অ্যাপারচারের অর্থ হচ্ছে ছিদ্র। ক্যামেরায় যে লেন্স থাকে সেখানে প্রথমে থাকে কিছু কাচের বস্তু। তার ঠিক পরেই থাকে অ্যাপারচার । অ্যাপারচার যতো বড় হবে অর্থাৎ ছিদ্র যতো বড়ো হবে, ক্যামেরার ভিতরে ততো বেশি আলো প্রবেশ করবে। আবার অ্যাপারচার ছোটো হলে আলো ঢুকবে কম কম। তার মানে দাঁড়ালো ক্যামেরার ভিতরে কি পরিমাণ আলো ঢুকবে, সেটা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এই অ্যাপারচার দিয়ে। ইবনে হাইসাম বাসরি এ সংক্রান্ত কৌশল আবিষ্কার করে সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে দিয়ে গেছেন। এ ছাড়া, পানি ও বায়ু প্রবাহিত করার জন্য বিভিন্ন রকমের কৌশল বা যন্ত্র আবিষ্কার, সময় পরিমাপের জন্য বিভিন্ন রকমের ঘড়ি নির্মাণ, পানি স্থানান্তর ও পানি খালি করার যন্ত্র এবং পানির ফুয়ারা পদ্ধতি তৈরিতে ইরানি মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রথম অবদান রাখেন। এ থেকে ওই যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রমাণ পাওয়া যায়।

অনেক গবেষক মনে করেন, ইবনে হাইসাম ছিলেন বিশ্বের প্রথম বিজ্ঞানী যিনি শব্দের গতি নির্ধারণ করেন। ইরানের এই খ্যাতনামা বিজ্ঞানী দৈর্ঘ্যের প্রচলিত মাপ ব্যবহার করে শব্দের গতি নির্ধারণ করেছিলেন। এ ছাড়া, ইবনে হাইসামের যুগে স্থান পরিমাপের যে একক ছিল সেটাকে ব্যবহার করে তিনি আলোর গতি এবং পৃথিবীর ব্যাসার্ধ নির্ধারণ করেছিলেন।

আবু আলী মোহাম্মদ বিন হাসান বিন হাইসাম বাসরি মূলত:  ইবনে হাইসাম নামেই সবার কাছে পরিচিত যিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম হয় এবং ১০৩৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ইরানের আহওয়াজ এলাকার অধিবাসী এই বিজ্ঞানী। ল্যাটিন ভাষার গ্রন্থগুলোতে তিনি অ্যাভেন্টান অথবা অ্যাভনাথন নামে পরিচিতি হলেও আল-হাজেন নামেই তিনি বেশি পরিচিত। সাসানিয়দের যুগে খুজিস্তানের জান্দি শাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে হাইসামের পূর্বপুরুষরা পাটিগণিত, জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি এবং বীজগণিতে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং তারা শিক্ষকতাও করতেন।

মুস্তাফা নাজিফ বেগ ছিলেন একজন মিশরীয় পণ্ডিত যিনি বিংশ শতাব্দিতে ইবনে হাইসামের গুরুত্বপূর্ণ বই 'আল-মানাজা'র ব্যাখ্যা ও সংশোধন করার ক্ষেত্রে তার মূল্যবান প্রচেষ্টার জন্য সুপরিচিত। তিনি ইবনে হাইসামের গবেষণা পদ্ধতিকে সঠিক উল্লেখ করে এই মহান বিজ্ঞানীকে বিশ্বের অন্যতম বড় বিজ্ঞানী হিসাবে অভিহিত করেছিলেন।

ইবনে হাইসামের গবেষণা কর্মের প্রায় একই সময়ে আরেকজন মহান বিজ্ঞানী ছিলেন 'আবু রেইহান বিরুনি'। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামি সভ্যতায় জ্ঞান ও চিন্তার স্বর্ণযুগের শুরুতে ইরানিরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা ও আবিষ্কারকে কতখানি গুরুত্ব দিত। বলা যায়, নতুন নতুন গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে ইরানি মনীষীরা জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। ইবনে হাইসাম এই ক্ষেত্রে তার মৌলিক গবেষণার পাশাপাশি একটি নতুন ব্যবহারিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও পরিচিত। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ