বহু বছর ধরেই বিলাসী দ্রব্য ঘরে ঢুকতে দেইনি: সর্বোচ্চ নেতার স্ত্রী
সুখের নীড় - পর্ব ২২ ( ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পারিবারিক জীবন )
দাম্পত্য-জীবনকে সুখময় সুস্থ আর সজীব রাখতে হলে অতীতের ভুলগুলোকে পরিহার করে চলা উচিত। আপনি বা আপনার স্বামী বা স্ত্রী যে-ই ভুল করুক না কেন বা ভুলের ক্ষেত্রে আপনার একার বা উভয়েরই ভূমিকা বা দায় থাকুক না কেন সেসব ভুলের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।
আপনার জীবনসঙ্গীর অতীতের নানা ব্যর্থতা বা ভুলগুলো তাকে স্মরণ না করিয়ে বরং নিজের ও তার ইতিবাচক আচরণ ও ইতিবাচক নানা দিক শক্তিশালী করুন। এই মুহূর্তে যে আপনি জীবনসঙ্গীর পাশে রয়েছেন তার উপস্থিতিকে উপভোগ করুন এবং আপনাদের মনের সব কথা ও ভাবনাগুলোকে একে একে তুলে ধরুন। যদি জীবন-সঙ্গীকে সত্যিই ভালোবাসেন তাহলে তার পছন্দ-অপছন্দগুলোকে গুরুত্ব দিন।
অতীতের এমন কোনো কথা বা ঘটনার স্মৃতি তুলে ধরবেন না যা আপনার জীবন-সঙ্গীকে পীড়া দিতে পারে বা যা তাকে করতে পারে উত্তেজিত। যদিও অতীতের সব কিছু ভুলে যাওয়া খুব সহজ নয়, কিন্তু অতীতের এমন কোনো ঘটনার বিষয় তুলে ধরা বা সেসবের কলকাঠি নাড়ানো ঠিক নয় যা প্রতিশোধপরায়নতা উস্কে দিতে পারে বা একগুঁয়েমির পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। মোট কথা অতীতের কথা তুলে ধরে জীবনসঙ্গীর ওপর আঘাত হানবেন না।
পরিবার সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। পরিবারের জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে/ যে সংস্কৃতি ও আচার-আচরণকে অনুসরণ করতে চায় পরিবার/ তার ওপর। পরিবারকে সঠিক পথে রাখতে হলে দরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা যাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দয়া ও সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠে এবং পরিবার হয়ে ওঠে নিরাপত্তা ও নির্ভরশীলতার কেন্দ্র। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি পরিবারের সুরক্ষা ও সংহতি জোরদারের জন্য বিভিন্ন নীতি ও সুপারিশের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৬ টি পয়েন্টে উল্লেখিত এসব নীতির মধ্যে রয়েছে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পরিবারকে শক্তিশালী করা এবং এ জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ আর গণমাধ্যমকে ব্যবহার করাসহ পরিবার সংক্রান্ত আইনি ব্যবস্থায় সংস্কার আনা ও তাতে পূর্ণতা আনা। পারিবারিক বিষয়ে সঠিক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানো ও পরিবারের সবাইকে একত্রে অবসর বিনোদনের সুযোগ দেয়া, পরিবারের জীবন-উপকরণ, রুটি-রুজি ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, পেশা বা চাকরির ব্যাপারে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে দুশ্চিন্তা তা দুর করতে তাদেরকে শক্তিশালী করা, এবং পরিবারের সদস্যদের বিয়ের ও বাসস্থান সমস্যা দুর করারও সুপারিশ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা পরিবার বিষয়ক তার সুপারিশমালায় আরও যেসব বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন স্ত্রী বা মায়ের প্রতি সহায়তা ও মাতৃত্বের ভূমিকা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পিতার ভূমিকার প্রতি সম্মান প্রদর্শনও সেসব বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ি তার সুপারিশমালায় পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি সহায়তা এবং পরিবারের সব সদস্যদের সুস্থতা ও বিশেষভাবে সন্তান জন্মদানের সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপরও জোর দিয়েছেন। মোট কথা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা চান ইরানি পরিবারগুলো যেন হয় সম্প্রীতি ও নিরাপত্তার কেন্দ্র, নৈতিকতা এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র, অর্থনৈতিক নানা দক্ষতা, পেশাগত দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্র এবং সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষার কেন্দ্র ও সমাজকে শক্তিশালী করার কেন্দ্র।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বা রাহবার নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত এবং পারিবারিক যোগাযোগকে খুব গুরুত্ব দিয়ে থাকেন যাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্প্রীতি ও পারস্পরিক অনুরাগের বন্ধন জোরদার হয়। তিনি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান শীর্ষ নেতা হিসেবে ও এর আগেও শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা হিসেবে ব্যাপক ব্যস্ত জীবনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। তিনি ইরানের মাশহাদ প্রদেশে গেলে বাবা ও মায়ের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করতেন এবং হাতে সময় কিছুটা বেশি থাকলে এ ধরনের সফরের সময় তাদের সঙ্গে দুইবার সাক্ষাৎ করতেন বা পারিবারিক সমাবেশে বেশি সময় দিতেন। অন্যদিকে রাহবারের বাবা মায়ের পরিবারের ও সন্তানদের পরিবারের সদস্যরাও রাহবারের এ ধরনের সাক্ষাৎ ও পারিবারিক সমাবেশে তাঁর উপস্থিতিকে বেশ আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন। এই পরিবারের জুনিয়র সদস্যরা যতই বড় হচ্ছেন ততই ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বেশি অনুরাগী হচ্ছেন পরিবারের সবার প্রতি তাঁর সহৃদয় আচরণ ও মমত্ববোধের কারণে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে পরিবার হচ্ছে স্নেহ ও প্রীতির বন্ধন বিকাশের কেন্দ্র। পরিবারের শিশুরা বড়দের কাছ থেকে স্নেহ ও মমতার পরশ পেয়ে থাকে। তাঁর মতে পরিবারের পুরুষ তথা স্বামী/ স্ত্রীর তুলনায় কিছুটা বেশি কাঁচা ও বিশেষ ক্ষেত্রে ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়ে থাকেন, কিন্তু স্ত্রীর যত্ন ও সেবা তার এ ধরনের ঘাটতি বা ক্ষতের ক্ষেত্রে কোমল মলমের কাজ করে, এমনকি মায়ের যত্নও এর পরিপূরক হয় না।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার স্ত্রী মানসুরেহ খুজাস্তেহ বাকিরজাদেহ'র বক্তব্য অনুযায়ী তাঁর স্বামী বাইরের নানা কাজ শেষে যখন ঘরে আসেন তখন ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের পরিবেশকে বাইরের সমস্যার জগত থেকে দুরে রাখার তথা ঘরের পরিবেশকে প্রশান্ত, প্রফুল্ল ও সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন। রাহবারের স্ত্রী মনে করেন যে পরিবারে প্রশান্তি বজায় রাখাই তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব যাতে তাঁর স্বামী কোনো টেনশন ছাড়াই নিজের কাজগুলো অব্যাহত রাখতে পারেন। তিনি বলেছেন, আমি সব সময় এ চেষ্টা করি যে আমার স্বামী (রাহবার) আমার ও সন্তানদের বিষয়ে যেন কোনো উদ্বেগের শিকার না হন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সাদামাটা জীবন যাপন সম্পর্কে তাঁর স্ত্রী বলেছেন, বহু বছর ধরেই আমরা কোনো বিলাসী দ্রব্য আমাদের ঘরে ঢুকতে দেইনি। সৌন্দর্য বৃদ্ধির অজুহাতে কোনো বিলাসী দ্রব্য ঘরে ঢুকতে দেয়াকেও আমরা অনুচিত মনে করি যদিও খোদ্ সৌন্দর্য একটি ভালো বিষয়। ঘরের প্রচলিত সাজ-সজ্জা বলতে যা বোঝায় যেমন মূল্যবান কার্পেট ও পর্দা, সোফা ইত্যাদি-এসব আমাদের ঘরে নেই। বহু বছর ধরেই আমরা এসব বর্জন করে আসছি। জনাব খামেনেয়ির (মরহুম) বাবা-মা এ বিষয়ে আমাদের আদর্শ। তাঁর মা এ ধরনের অভিজাত সাজ-সজ্জার বিরোধিতা করতেন এবং আমিও তা-ই মনে করি। আমি আমার সন্তানদের সব সময় বলে আসছি যে তারাও যেন ব্যক্তি জীবনে এই নীতি বজায় রাখে। কারণ বিলাসী দ্রব্যগুলো অপ্রয়োজনীয়।
কোনো কোনো ব্যক্তির স্বভাব এমন যে রেগে গেলে তারা গালি দেন ও অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন। এ ধরনের ব্যক্তি কখনও রেগে গেলে তার কাছের ব্যক্তির উচিত দ্রুত নতুন কোনো বিষয়ের অবতারণা করে তাকে রেগে-যাওয়া বিষয়টি থেকে নতুন বিষয়ের ভাবনায় ডুবিয়ে দেয়া। আবার কখনও একগুঁয়ে ব্যক্তির অশোভনীয় ভাষা ও স্বেচ্ছাচারের প্রতিবাদ হিসেবে ঘটনাস্থল বা নিজের অবস্থান ত্যাগ করাই উত্তম পন্থা। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি কোনো উপদেশ বা অসন্তুষ্টিরই ধার ধারে না, এ ধরনের ব্যক্তির সঙ্গে কঠোর ভাষায় কথা বলা উচিত যাতে সে সংযত ভাষায় কথা বলে, তবে কোনো অবস্থাতেই মানবীয় শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতাকে বিসর্জন দেয়া যাবে না। মহানবী (সা) অশোভনীয় ভাষা বর্জন করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ কটুভাষী বা অশোভনীয় ভাষা ব্যবহারকারীকে পছন্দ করেন না।
আপনি যদি বুঝতে পারেন যে আপনার কথা বা আচরণ আপনার জীবনসঙ্গীকে অসন্তুষ্ট করেছে তাহলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। যারা দ্রুত রেগে যান তাদেরও উচিত নিজেকে চেনা ও নিজেই নিজেকে শাসন করা। আর এভাবে অসংযত আবেগ দমিয়ে রাখা যায়।
পার্সটুডে/এমএএইচ/০১