সুন্দর জীবন-পর্ব ২০ (বিশ্রামও জরুরি)
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রে আপনি যতটা কৃপণ তার চেয়েও বেশি কৃপণ হোন আয়ু বা জীবনকাল রক্ষার ক্ষেত্রে। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, প্রতিটি মুহূর্ত আপনার আয়ু বা জীবনকালের অংশ। কাজেই চেষ্টা করুন যাতে এক মুহূর্তও অবহেলায় নষ্ট না হয়। নিজেকে উদ্ধার বা নিজেকে মুক্ত করার প্রয়োজনে সেটা করতে হলে তা ভিন্ন কথা। এবার আমরা সময়ের গুরুত্ব এবং সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও আলোচনার চেষ্টা করব।
আমরা অনেক সময়ই কাজ করতে করতে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভুলে যাই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থের লোভও আমাদেরকে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভুলিয়ে দেয়। আপনি হয়তো কাজ করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন। চিন্তা করছেন যে, এইটুকু কাজ করলেই এত টাকা পাচ্ছি, আরো করি আরো পাবো। এতখানি করলে তো আর মরে যাব না। কিন্তু বুঝতেই পারছেন না যে, এই কাজের চাপ, একটা সময় হয়তো আপনাকে এতটাই দুর্বল করে দেবে যে এক সময় কিছুই করতে পারবেন না। তাই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেয়া অতি জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা ৯০ মিনিট কাজ করার পর মানুষের মন-মগজ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে ৯০ মিনিট কাজ করার পর অন্তত ১০ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। আপনি যদি এ সময় বিশ্রাম না করে কাজ চালিয়েই যেতে থাকেন তাহলে আপনি কাজে একাগ্রতা হারাবেন। মনোযোগের অভাব ও ক্লান্তির কারণে আপনার সময় নষ্ট হবে। এটা সময় ব্যবস্থাপনার নীতি-কৌশলের পরিপন্থী।
আরেকটা ক্ষেত্রে আমাদের সময় খুব নষ্ট হয়। সেটা হলো কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা। আমরা সাধারণত বাস বা অন্য যেকোনো যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করে থাকি অথবা গাড়িতে উঠার পর ট্রাফিক জ্যামে বসে অপেক্ষায় থাকি কখন গাড়ি চলবে এবং কর্মস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করব। সাধারণত এই সময়টা একেবারেই কাজে লাগে না। অপেক্ষার এই সময়টাকে কাজে লাগানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো পড়া। বই বা পছন্দের কোনো কিছু পড়লে সময়টা যেমন দ্রুত চলে যায় তেমনি তা থেকে উপকৃতও হওয়া যায়। সময় নষ্টের আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। প্রায় সবার হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন থাকায় এ ক্ষেত্রে সময় নষ্টের ঘটনা বেশি ঘটছে। কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার ও ইমোসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢু মারাটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে অনেকেরই।
ঢু মারতে গিয়ে অনেকে নিজের অজান্তেই ব্যয় করে দিচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই ভুবনে সময় নষ্ট করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একটু ভেবে দেখুন এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার জন্য প্রয়োজনীয় কী উপাদান রয়েছে? এরপর নির্ধারণ করুন প্রতিদিন কয় মিনিট সেখানে অবস্থান করলেই আপনার প্রয়োজনীয়তা মিটে যায়। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন সেখানে আপনার অতি প্রয়োজনীয় তেমন কিছুই নেই। আপনি যদি আপনার বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চান তাহলে তা কয়েক মিনিটেই জানা সম্ভব। একটু ভেবে দেখুন আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে কী করেন। আপনি সেখানে ঢুকে সাধারণত দেখতে পারেন, আপনার পরিচিত কেউ অথবা ফেসবুকে বন্ধুদের কেউ বিশ্বের কোনো দেশ ঘুরতে গেছেন, কেউ গেছেন বান্দরবানে, কেউবা একটি দামি রেস্তোরাঁয় বসে সুদৃশ্য প্লেট নিয়ে খেতে বসে পোস্ট দিয়েছেন, কেউবা ঘরে মায়ের সঙ্গে বা সন্তানের সঙ্গে বা বন্ধুদের সঙ্গে নিছক চায়ের আড্ডার ছবি পোস্ট দিয়েছেন, কেউ হয়তো তার বিয়ের ছবি দিয়েছেন অথবা নতুন জামা বা চশমা পরে ছবি তুলেছেন।
ফেসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ হয়তো তার চিত্রকর্ম বা লেখা পোস্ট দিয়েছেন। কেউ হয়তো বেড়াতে গিয়ে সরাসরি ভিডিও দেখাচ্ছেন। এভাবেই সামাজিক নেটওয়ার্কে শতশত কনটেন্ট পোস্ট হচ্ছে। এর মধ্যে খুব কম সংখ্যক কন্টেন্টই আপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এই ফেসবুকের নোটিফিকেশন আপনাকে বারবারই বিরক্ত করছে। আপনি হয়তো অফিসের জরুরি মিটিংয়ে রয়েছেন অথবা রাস্তা পার হচ্ছেন। কিন্তু এরপরও একটু পরপর নোটিফিকেশন পেয়ে মোবাইলটি খুলে দেখছেন, কখনো রিপ্লাই দিচ্ছেন, লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট করছেন। এর মাধ্যমে আপনার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে, কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, সর্বোপরি আপনার প্রতিদিনের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। আপনি চাইলে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে এক বা দুই বার এসব মাধ্যমে একটু ঘুরে আসুন এবং সময় নির্ধারণ করুন। যত কিছুই ঘটুক নির্দিষ্ট সময়ের বেশি সেই জগতে থাকবেন না এভাবে মনস্থির করুন। তাহলে দেখবেন এ ক্ষেত্রে আপনার সময় অপচয় হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকে খেতে বসেও ফেসবুক ব্যবহার করেন। কেউ কেউ প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে ঘনিষ্ঠ সময় কাটানোর মুহূর্তেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন।
যাইহোক, আপনার প্রতিদিনকে সঠিক উপায়ে কাজে লাগাতে আগের দিন রাতেই তালিকা করুন, ঠিক করুন আগামীকাল সারা দিনে কী করবেন। তাতে আপনার কাজের প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে। তালিকা অনুযায়ী কাজ করলে সময়ও নষ্ট হবে কম। আবার কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভুলে যাওয়ার আশঙ্কাও কমে আসবে। রাতে পরদিনের একটা খসড়া পরিকল্পনা করে আরাম করে ঘুমাতে পারবেন। ঘুমানোর আগে চলে যাওয়া দিনের ছোট্ট একটা পর্যালোচনা করার অভ্যাস করেন। আপনার কোন কাজটি আপনি কীভাবে আরও ভালোভাবে করতে পারতেন, এমন একটি বিশ্লেষণ দিয়ে সেটি শুরু হবে। আর শেষ করুন নিজেকে কোনো একটা কাজ সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে। যে দিনটি খুব খারাপ গেছে, সেখান থেকেও কোনো ইতিবাচকতা নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ব্যস্ততম জীবনে দিনে আমাদের অনেকেরই বই পড়ার সময় হয় না। সে ক্ষেত্রে রাতে ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ বই পড়তে পারেন। এতে আপনার ঘুম ভালো হবে। আর ফোন নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাসকেও সহজেই বিদায় করতে পারবেন। প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এমন তিনটি পয়েন্ট লিখুন, যেগুলো নিয়ে আপনি কৃতজ্ঞ। আপনার মন যত কৃতজ্ঞতায় আর্দ্র থাকবে, আপনি তত সহজেই একটা সন্তুষ্ট মন নিয়ে সুখী হতে পারবেন। কে আপনার জন্য কী করেনি, এগুলো ক্ষুদ্র হয়ে যাবে। ফলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। রাতে একটা সন্তুষ্ট হৃদয় নিয়ে ঘুমাতেও পারবেন। রাতের এবাদত সম্পন্ন করুন। এতে আপনি প্রশান্তি পাবেন।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।