ডিসেম্বর ১৯, ২০২২ ২০:৩৭ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংকে সন্দেহজনক ঋণ বা নিয়মবহির্ভূত ঋণের সাম্প্রতিক যে ঘটনা ঘটেছে তা শুধু উদ্বেজনকই নয় এটা আতঙ্কজনক। এই ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ক্ষেত্রে কতবড় একটা আস্থার সংকট সৃষ্টি করল জনগণের আমানতের ক্ষেত্রে-এটা বলে বোঝানো যাবে না। এটি দেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড ধাক্কা এবং ব্যাংক সংক্রান্ত মানুষের আস্থার উপর একটা বড় আঘাত নিয়ে এল।

রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বা বাসদের কেন্দ্রীয় নেতা, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার রাজেকুজ্জামান রতন।

  • রাজনীতিতে যেমন দায়হীনতা আছে অর্থনীতিতেও সেই দায়হীনতার বিষয়টি এই নিয়মবহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো।

সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব রাজেকুজ্জামান রতন রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রাজেকুজ্জামান রতন: আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান:  রাজেকুজ্জামান রতন,  বাংলাদেশে সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকসহ তিন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে ঋণ দেয়া হয়েছে এবং এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় চলছে। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

তিনটি ইসলামী ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মবহিভূত ঋণ

রাজেকুজ্জামান রতন: বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এই ধরনের ঘটনা শুধু উদ্বেগজনক নয় এটা আতঙ্কজনকও বটে। সাধারণ মানুসের কষ্টের টাকা, সাধারণ মানুষের ভবিষ্যতের সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে যে টাকাটা তারা রাখেন সেই টাকা থেকে প্রাপ্ত আয় ক্রমাগতভাতে জনগণের কমে যাচ্ছে। এখান থেকে প্রায় ১৩ লক্ষ কোটি টাকার মতো ঋণ দেয়া হয়েছে। আর সেই ঋণের মধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণকে খেলাপি ঋণ বলা হয়েছে। এরমধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা ঋণ অবলোপন করে দিয়েছে। এই পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যায় একটা দেশের প্রদত্ত ঋণের ৯ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি। মাঝে মাঝে আবার খেলাপিঋণগ্রহীতাদের ঋণ নেয়ার দায় থেকে মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। এসব দেখেতে দেখতেই আমরা আবার নতুন করে দেখলাম একটা প্রতিষ্ঠান, একজন ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠান-তিনি ইসলামি ব্যাংকের মতো একটি ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে আর সেই ঋণের জন্য তাদের যে প্রয়োজনীয় শর্ত সে শর্তগুলো তারা পূরণ করেনি। এই ঘটনা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ক্ষেত্রে কতবড় একটা আস্থার সংকট সৃষ্টি করল জনগণের আমানতের ক্ষেত্রে-এটা বলে বোঝানো যাবে না। এটি দেশের অর্থনীতিতে প্রচণ্ড ধাক্কা এবং ব্যাংক সংক্রান্ত মানুষের আস্থার উপর একটা বড় আঘাত নিয়ে এল।

রেডিও তেহরান: সাধারণ একজন মানুষ ব্যাংক থেকে অল্প কিছু টাকা ঋণ নিতে গেলে তাকে যত রকমের নিয়ম এবং তদন্ত আছে সেগুলো শেষে যৌক্তিক কাগজপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে  ঋণ দেয়া হয়-অথচ এত টাকা এভাবে.. কি করে সম্ভব!

রাজেকুজ্জামান রতন: দেখুন, রাজনীতিতে যেমন দায়হীনতা আছে অর্থনীতিতেও সেই দায়হীনতার বিষয়টি এরমাধ্যমে প্রমাণিত হলো।

রেডিও তেহরান: জনাব রতন, বলা হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকে নতুন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া এবং মালিকানা পরিবর্তনের পর থেকে এই ব্যাংক ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক কার্যক্রম হারিয়ে এই পথে এসেছে। ব্যাপারটা কি আসলে তাই?

রাজেকুজ্জামান রতন: ধন্যবাদ আপনাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি থাকা দরকার ছিল সেটা তারা যেমন একদিকে যথাযথভাবে করেনি পাশাপাশি আমাদের সাবেক গভর্নরদের মধ্যে কেউ কেউ বললেন, কিভাবে একটা ব্যাংকে দেউলিয়া করা যায় তার একটা দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইসলামি ব্যাংকগুলোতে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ যে নিয়ম মেনে চলা দরকার সেটারও ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। ফলে খুবই সচেতন ও সুচতুরভাবে একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে একটা ব্যাংককে ধসিয়ে দেয়ার এই দৃষ্টান্ত এটাই প্রথম নয়। এর আগেও আমরা বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এরকম ঘটনা ঘটেছি। সর্বশেষ ইসলামি ব্যাংকের ঘটনা দেখলাম।

বাংলাদেশের ব্যাংক ঋণ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার রাজেকুজ্জামান রতনের সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা রাজেকুজ্জামান রতন, কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে, ইসলামী ব্যাংক দেশের বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় ব্যাংক হলেও এর সাথে যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছিল সে কারণেই এই ব্যাংকটিকে ধীরে ধীরে দেউলিয়া ঘোষণার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়?

রাজেকুজ্জামান রতন: দেখুন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে নয়। এর আগেও আমরা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকে আমরা ধসে যেতে, বসে যেতে, দেউলিয়া হয়ে যেতে দেখেছি। আইনগত ভাষার দিক থেকে হয়তো দেউলিয়া হয়নি কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়েছে। সেইসব ব্যাংকের নামগুলো মানুষের মুখে মুখে ছিল-এখনও আছে। যেমন ধরুন, বেসিক ব্যাংক কীভাবে লুটপাটের শিকার হলো! ফার্মার্স ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক কীভাবে শেষ হয়ে গেল।

ফলে আমরা মনে করি যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়ন্ত্রিত লুটপাটের শিকার হয়েছে। প্রথমত তাদের পরিবর্তন আনা হয়েছে- কাঠামোগত বিন্যাস, পরিচালনা পদ্ধতি,  এবং পরিচালক নিয়োগে।

দ্বিতীয়ত কখনও কখনও বাইরে থেকে ব্যবস্থাপক নিয়োগ করা হয়েছে। আবার কখনও কখনও জাতীয় পর্যায়ের ব্যাংক যেমন জনতা ব্যাংকের কথা বলতে পারি- নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার খবরও আমরা দেখেছি। যে ঋণের ধাক্কাটা এখনও জনতা ব্যাংক সামাল দিয়ে উঠতে পারেনি। এরকম কত উদারহণ দেখা যাবে! প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়, প্রশ্রয় কিংবা সহায়তা থাকলে যে কোনো ধরনের আর্থিক দুর্নীতি করার একটা সুযোগ তারা পেয়ে যায়। রাজনীতিতে যেমন জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি অর্থনীতিতেও সেই জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় বাংলাদেশ ব্যাক তার  সর্বোচ্চ আর্থিক যে তদারকি হওয়া দরকার সেটা না থাকার কারণে ক্রমাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট এবং হয়রানির শিকার হচ্ছে।

রেডিও তেহরান:  ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে যে প্রশ্ন করব- সেটি হচ্ছে, ইসলামী ব্যাংকের সাম্প্রতিক যে সমস্ত ঘটনাবলী তা দেশের সামগ্রিক অর্থ ব্যবস্থা ও ব্যাংক ব্যবস্থায় কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? এর কল্যাণ-অকল্যাণকর দিকগুলো কি হতে পারে?

রাজেকুজ্জামান রতন: দেখুন, এর বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে। যারা ইসলামি ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল তারা কোন ধরনের প্রতিষ্ঠান। প্রথমত তারা সরকার ঘনিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ত তাদের অনেকেই খাদ্যপণ্য ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত। তৃতীয়ত এরমধ্যে দিয়ে  ব্যাংকগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের যে আস্থা সেই জায়গাটাতেও ধাক্কা খেল।

তারা যেহেতু খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যুক্ত সেইহেতু এই বাজারটিকে তারা একচেটিয়া করে ফেলেছে।সরকার ঘনিষ্ঠ বলে তারা যেকোনো কাজ যেকোনো সময় যেকোনোভাবে করতে পারে এই ধরনের একটা বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হয়েছে।

Image Caption

আর ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো টাকা নিয়ে যাওয়া যায় এই বার্তাটা ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থার জায়গাটা চিড় ধরে যায়। সবচেয়ে বড় যে সংকটা হয় সেটি হচ্ছে- জনগণের কষ্টের আমানতের টাকা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে চলে যায়। কোনো ধরনের তদারকি ছাড়াই টাকাটা চলে যেতে পারে। এরসাথে জড়িত অবৈধ বিষয়। অবৈধ বিষয় যদি ঘনঘন ঘটতে থাকলে অর্থনীতির সঙ্গে জনগণের নীতিগত চরিত্রটাকেও ধসিয়ে দেয়। এটি স্পষ্ট হয় যে ক্ষমতা থাকলে যেকোনোভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা নেওয়া যায়। এটা শুধু যে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে তাই নয়, নৈতিক মনস্তত্বে প্রভাব ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত এ প্রভাব রাজনীতিতে গিয়ে পড়ে এই জায়গায় যে ক্ষমতসীনদের সাথে থাকলে সবকিছুই করা যায়। আর এই মানসিকতা থেকে ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতি, অবৈধ উপার্জন এবং দুর্বৃ্ত্তায়িত রাজনীতির বড় দৃষ্টান্ত দাঁড়িয়ে যায়।

রেডিও তেহরান: তো জনাব রাজেকুজ্জামান রতন-ব্যাংক ঋণ এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ।

রেডিও তেহরান: আপনাকেও ধন্যবাদ। রেডিও তেহরানের অসংখ্য শ্রোতাবন্ধুদেরকে ধন্যবাদ। আমরা যে আলোচনাই করি আমাদের একটা লক্ষ্য থাকে। আমাদের সমস্ত আলোচনার লক্ষ্য জনগণ সর্বাধিক সুবিধা পাওয়া, গণতান্ত্রিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করা। ফলে আমরা চাইব রেডিও তেহরানের  অগণিত শ্রোতা-যারা দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- বাংলাদেশ আমাদের সবার। এই দেশের গণতান্ত্রিক চর্চাটাকে যেন আমরা যেন অব্যাহত রাখি। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৯

ট্যাগ