সুন্দর জীবন- পর্ব ২৫ (অ-মৌখিক যোগাযোগ)
আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন- সেটাই হলো সর্বোত্তম বক্তব্য যা যুক্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল এবং যা সব ধরণের মানুষের কাছেই বোধগম্য।
মানুষ প্রতিটি আচরণের মাধ্যমেই অন্যের কাছে বার্তা পাঠাতে পারে। আমরা যখন কথা বলি তখন কেবল কথা বা বাক্যের মাধ্যমেই যোগাযোগ স্থাপন করি না বরং এ সময় অ-মৌখিক যোগাযোগও স্থাপিত হয়। একজন দর্শক-শ্রোতা আমাদের মুখের কথা এবং আমাদের বডি ল্যাংগুয়েজ বা শরীরের ভাষা-এই উভয়ের মিশ্রণে গঠিত বার্তা গ্রহণ ও ব্যাখ্যা করে। সৃষ্টি জগতের সর্বোত্তম মহামানব হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, একজন ঈমানদার পুরুষ যখন অপর মুসলিম ভাইয়ের দিকে তাকায় তখন তার দৃষ্টিতে ভালোবাসা ও আকর্ষণের বিষয়টি ফুটে ওঠে। মহানবী (স.)'র এই হাদিসে সঠিক উপায়ে আই কন্টাক্ট বা চোখের ওপর চোখ রাখার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
আসলে সফল যোগাযোগে প্রতিষ্ঠার জন্য মৌখিক যোগাযোগের পাশাপাশি অ-মৌখিক যোগাযোগকেও ব্যাপক গুরুত্ব দিতে হবে। অ-মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে আপনি আপনার বার্তা বা বক্তব্য অনেক সহজে অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন। একইভাবে আপনি যার জন্য বার্তা দিচ্ছেন সে সঠিকভাবে ঐ বার্তা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে কিনা সেটাও আপনি তার অ-মৌখিক প্রতিক্রিয়া দেখে বুঝতে পারবেন। অর্থাৎ অ-মৌখিক যোগাযোগের ব্যাপারে সচেতন থাকলে অন্যের অভিব্যক্তি আমরা সহজেই ধরতে পারি। যেমন ধরুন, আপনি কারো সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করছেন, সে যদি একসময় আর গল্প করতে আগ্রহী না থাকে তখন তার অঙ্গভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে তা আপনি সহজেই ধরতে পারবেন। এক্ষেত্রে মূলত অ-মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমেই সে জানিয়ে দিচ্ছে সে আর আপনার বলা গল্পে আগ্রহী নয়। আপনি যদি অ-মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ হন তাহলে সহজেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে যেমন চাকরীস্থল, দাম্পত্য জীবন এবং বন্ধুত্ব স্থাপন ও তা রক্ষায় তুলনামূলক-ভাবে বেশি সাফল্য পাবেন। এর ফলে আপনার মধ্যে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি বাড়বে এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা হ্রাস পাবে।
মৌখিক যোগাযোগের সঙ্গে অ-মৌখিক যোগাযোগ এমনভাবে মিশে গেছে যে, আলাদাভাবে আমরা এ বিষয়টা নিয়ে চিন্তাই করি না। কিন্তু অ-মৌখিক যোগাযোগের সঠিক প্রয়োগ ছাড়া শুধুমাত্র মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে কখনোই মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। মৌখিক বার্তা ছাড়া বাকি সকল বার্তাই মূলত অ-মৌখিক যোগাযোগকে নির্দেশ করে। চেহারার অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি, ইশারা ইত্যাদি অ-মৌখিক যোগাযোগের উদাহরণ। অ-মৌখিক যোগাযোগ মূলত আমাদের আবেগকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যখন অনেকদিন পর আপনার প্রিয় কোনো মানুষের সাথে দেখা হবে, তখন তাকে দেখে আপনার মুখে যে হাসি ফুটে উঠবে, সেই হাসি দেখেই ব্যক্তিটি বুঝতে পারবেন যে তাকে দেখে আপনি খুশি হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মুখে কিছু বলারও প্রয়োজন হবে না, তার আগেই সে আপনার আবেগটা ধরতে পারবে।
অ-মৌখিক যোগাযোগ আমাদের অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। আপনি যখন কথা বলার সময়, আপনার কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তি ইত্যাদি অ-মৌখিক বার্তার দিকে খেয়াল রেখে কথা বলবেন, তখন আপনার কথাগুলো অন্য ব্যক্তির কাছে শ্রুতিমধুর ও মার্জিত মনে হবে এবং সেই ব্যক্তির আপনার সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা তৈরি হবে ৷যেমন ধরুন, দু'জন ব্যবসায়ীর মধ্যে যার ব্যবহার বেশি ভালো ক্রেতারা তার দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়, এক্ষেত্রে অ-মৌখিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ-মৌখিক যোগাযোগ আমাদের মৌখিক যোগাযোগের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। আমরা যদি বিষয়টিকে এভাবে তুলে ধরি তাহলে বুঝতে আরও সহজ হবে। ধরুন, স্কুলে এক ছাত্র টিফিন পিরিয়ডে মাথা ব্যথা বা হঠাৎ অসুস্থতার কারণে বাড়ি যেতে চাচ্ছে, শিক্ষক কিন্তু সেই ছাত্রের অঙ্গভঙ্গি, চেহারার অভিব্যক্তি ইত্যাদি আগে পর্যবেক্ষণ করবেন। তারপর যদি বুঝতে পারেন সে আসলেই অসুস্থ তবেই তাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেবেন। এক্ষেত্রে মৌখিক যোগাযোগের চেয়ে অ-মৌখিক যোগাযোগের প্রতি শিক্ষক বেশি গুরুত্ব দেবেন।
অ-মৌখিক যোগাযোগ আমাদের ব্যক্তিত্বকেও নির্দেশ করে। আপনি কাউকে কোনো কিছুর নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই নির্দেশটি আপনি মুখে উচ্চারণ করছেন। কিন্তু এর পাশাপাশি অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে উঠছে আপনি রাগী নাকি শান্ত স্বভাবের-সেই বিষয়টি। একজন রাগী লোক যেভাবে বলবেন, একজন শান্ত মানুষ তার চেয়ে ভিন্নভাবে বলবেন। তাদের এই কথার মধ্যকার পার্থক্য মূলত আমরা অ-মৌখিক যোগাযোগের উপাদানগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারি। সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও অ-মৌখিক যোগাযোগের গুরুত্ব রয়েছে। অনেক সময় রাস্তা দিয়ে চলার পথে আমরা পরিচিতজনকে হাত ইশারা করে সম্মান, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা প্রকাশ করি। এছাড়াও দূর থেকে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কিংবা বিদায় জানাতে হাত নেড়ে ইশারা করা হয়, যা এক ধরণের অ-মৌখিক যোগাযোগ। অ-মৌখিক যোগাযোগ নানা ধরণের শিষ্টাচারকেও নির্দেশ করে।
কিছু ইঙ্গিত বা ইশারা তথা অ-মৌখিক যোগাযোগকে ভালোভাবে দেখা হয় না। আমাদের সমাজে বড়দের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাকে বেয়াদবি ধরা হয়, আবার কোনো প্রভাবশালী অন্যায়কারী বা জালিমের চোখে চোখ রেখে কথা বলাকে সাহস হিসেবে ধরা হয়। তাই ক্ষেত্রবিশেষে অ-মৌখিক যোগাযোগের উপাদানের পরিবর্তন বাঞ্ছনীয়। অ-মৌখিক যোগাযোগ আমাদের সুস্থতা, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদিরও পরিচায়ক। চাকরির ইন্টারভিউয়ে আপনি আত্মবিশ্বাসী কিনা পরীক্ষক তা আপনার অঙ্গভঙ্গি, মৌখিক অভিব্যক্তি, অযথা নাক কানে হাত দেওয়া বা ঘন ঘন ঢোক গেলা ইত্যাদি বিভিন্ন অ-মৌখিক যোগাযোগের উপাদানের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির মাধ্যমে বুঝতে পারেন। ঠিক একই ভাবে একজন ডাক্তারও প্রাথমিকভাবে একজন ব্যক্তির সুস্থতা বা অসুস্থতা সম্পর্কে ধারণা করেন অ-মৌখিক যোগাযোগের উপাদানগুলোরই দ্বারা।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, অ-মৌখিক যোগাযোগ, মৌখিক যোগাযোগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর হয়তো আপনি কথা না বলেও পারবেন, কিন্তু আপনার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ও আচরণ ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন না, আপনার চেহারায় নানা পরিবর্তন আসবেই, আপনার নানা অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ পাবেই। এভাবেই অপর পক্ষের কাছে আপনার অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া পৌঁছে যাবে। কাজেই একজন ব্যক্তি মুখোমুখি যোগাযোগের ক্ষেত্রে বার্তার একটা বড় অংশই পান অ-মৌখিক যোগাযোগের প্রক্রিয়ায়। অনেকের মতে, মুখোমুখি বার্তা আদান-প্রদানে মৌখিক যোগাযোগের প্রভাব ৩৫ শতাংশ এবং অ-মৌখিক যোগাযোগের প্রভাব ৬৫ শতাংশ। এছাড়াও অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, বডি ল্যাঙ্গুয়েজের প্রভাব ৫৫ শতাংশ, প্রকাশ ভঙ্গি ও কথার সুরের প্রভাব ৩৮ শতাংশ এবং খোদ কথার প্রভাব মাত্র ৭ শতাংশ।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।