সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ২৭ (পরিবার ও যোগাযোগ দক্ষতা)
সফল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার মানে হলো একজন অপরজনকে যে উদ্দেশ্যে বার্তা দিচ্ছেন ঠিক সেই উদ্দেশ্যটি বোঝাতে পারা বা বুঝতে পারা। পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্যের পেছনে যে বিষয়গুলো দায়ী, সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে কথা বলার ধরণের ত্রুটি অথবা নিজের উদ্দেশ্য বোঝানোর অক্ষমতা। যোগাযোগ দক্ষতা পারিবারিক জীবনকে সুখী-সমৃদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাধারণত নারী ও পুরুষ বিয়ের মাধ্যমে দু'জন আলাদা পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে এসে বৈধভাবে এমন একটা সম্পর্কে জড়ান যা স্থায়ী এবং এ ক্ষেত্রে পরস্পরকে মানিয়ে নেওয়াটা এক ধরণের আবশ্যিক বিষয়। এ অবস্থায় যারা যোগাযোগ দক্ষতায় পারদর্শী তারা এ ক্ষেত্রে বেশি সুখী জীবনের অধিকারী হতে পারেন এবং এ ধরণের মানুষেরা দাম্পত্য জীবনের প্রতি বেশি সন্তুষ্ট থাকেন। আমরা এর আগেও বলেছি যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশি বেশি জানা-শোনার কোনো বিকল্প নেই। নানা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে জন্মগতভাবে কিছু আচরণগত বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠতে পারে। এসব পার্থক্য সম্পর্কে জানা থাকলে বোঝাপড়াটা অনেক ভালো হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পুরুষ নারীর তুলনায় শ্রোতা হিসেবে দুর্বল। অর্থাৎ পুরুষেরা কথা শোনার চেয়ে কথা বলা এবং কথার জবাব দেন বেশি। বিপরীতে নারীরা অনেক বেশি মনোযোগ কথা শোনেন এবং ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে খুব সহজেই কথা বলতে পারেন। তবে একজন নির্দিষ্ট নারী বা পুরুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আগেভাগে ভালোভাবে জানতে পরস্পরের মধ্যে সরাসরি কথা বলা যেতে পারে।
এছাড়া সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কেমন আচরণ করছে তা পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। শুধু বাবা-মা নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্য বিশেষকরে পরিবারের কর্তার সঙ্গে তার আচরণ পর্যবেক্ষণ করলেই ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা যায়।
স্বামী বা স্ত্রীর কেউ যখন কোনো কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, ক্ষোভ, দুঃখ-কষ্ট ও ক্লান্তির মধ্যে থাকেন তখন পরস্পরের উচিত সতর্কতার সঙ্গে আচরণ করা। এ সময়টায় স্বামী বা স্ত্রী সাধারণ বিষয়েও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, কোনো ইতিবাচক আচরণকেও অপমান হিসেবে গণ্য করতে পারে। কাজেই মেজাজ বা অবস্থা বুঝে আচরণ করতে হবে, অবস্থা বুঝে কথা বলতে হবে। এ সময় এমন কথা বলা যাবে না বা এমন আচরণ করা যাবে না, যেটা তার ক্ষোভ বা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে। অযৌক্তিক চিন্তা-বিশ্বাস দাম্পত্য জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায় যে, আপনি যদি জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন তাহলে আপনার মধ্যে এক ধরণের উৎফুল্ল ভাব আসবে এবং সন্তুষ্ট থাকতে পারবেন।
দাম্পত্য জীবনে যে বিষয়টি খুব বেশি ক্ষতি করে তাহলো আমরা অনেকেই বলে থাকি কোনো নারী বা কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করা যায় না। আবার এমন কথাও বলি যে, আমি না বললেও আমার স্বামী বা স্ত্রীর অবশ্যই জানা উচিৎ যে, আমি কী চাই এবং আমার কী প্রয়োজন। স্বামী-স্ত্রীকে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষ হওয়া জরুরি। মানুষের মুখের কথার অনেক প্রভাব রয়েছে তা কেউ কেউ বুঝতে চান না। আমরা যখন স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি তখন অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত যে, আমরা কী বলছি। 'তুমি সব সময় এমন করো' অথবা 'তুমি কখনোই ভালো চাও না'-এমন বাক্য ব্যবহার করা উচিৎ নয়। আমরা হরহামেশাই পরস্পরকে বলে ফেলি- 'তুমি কখনোই আমাকে গুরুত্ব দাও না' অথবা 'তুমি সব সময় স্বার্থপর অথবা কখনোই আমার কথা শোন না'। আসলে এমন বাক্য ব্যবহার করা যাবে না। এসব কথা বলার মানে হলো, আমরা স্বামী বা স্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছি। যোগাযোগ ঘাটতি অথবা যোগাযোগ স্থাপনে অপারদর্শিতা দাম্পত্য জীবনে নানা সমস্যার জন্ম দেয়।
কিছু বিষয় পরিহার করা জরুরি। যেমন অনেকেই অতি প্রয়োজনেও কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিক্ততার একপর্যায়ে এক পক্ষ বা উভয় পক্ষ এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, তারা আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে, সমঝোতায় আসতে চেষ্টাই করে না। তারা পারস্পরিক ঘৃণা, অবজ্ঞায় সব ধরনের যোগাযোগ এড়িয়ে চলে—ভাবখানা এমন, এসব নিয়ে আলোচনা বৃথা। ফলে তীব্র ক্ষোভ, বিরক্তি, অসন্তুষ্টি জমতে থাকে ও ধীরে ধীরে বিষণ্ণতায় ভুগতে থাকে। নিশ্চল বা নির্বাক থাকাও জটিলতা বাড়িয়ে দেয়। স্বামী-স্ত্রী কখনো কখনো কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে বিলম্বিত করার পন্থা নেয় বা স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলে। ফলে নিজেদের মধ্যে বরফাচ্ছাদিত একটি দেয়াল তৈরি হয়। তাদের মধ্যে দিন দিন উদ্বেগ বাড়তে থাকে। অথবা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হয়ে তারা অন্য দিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে নিজকে ব্যস্ত রাখতে চায়। এভাবে তারা একে অপর থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কখনো কখনো দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সঙ্গে সংঘাত, প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে—এটি হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক ধরনের যোগাযোগ বিপর্যয়। এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী সব সময় একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা, বদনাম করতে থাকে; অনবরত অভিযোগ, নালিশ করতে থাকে; খুঁটিনাটি বিষয়েও সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত থাকে; তর্ক-বিবাদ তাদের দৈনন্দিন কাজ; এমনকি মৌখিকভাবে গালাগালি করে অপর পক্ষকে পরাস্ত করতে না পেরে হাতাহাতি ও মারামারিতে লিপ্ত হয়। এ মারামারিতে কেউ কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাজি নয়—তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা যে করেই হোক জিততে হবে। প্রায় প্রতিদিন তাদের এ রকম খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে ও তাদের উভয়ের মধ্যে ভয়ংকর সব প্রতিশোধ-স্পৃহা জাগতে থাকে। তবে এ রকম বেদনাদায়ক চিত্রের পাশাপাশি সুখী দাম্পত্যজীবনের উদাহরণও অসংখ্য রয়েছে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।