সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন- পর্ব ৩০ (শিশুদের যোগাযোগ দক্ষতা)
শিশুর কমিউনিকেশন স্কিল বা যোগাযোগ দক্ষতা হচ্ছে সফল সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি। এই দক্ষতা শিশুদেরকে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহযোগিতা করে।
যোগাযোগ দক্ষতা শিশুকে যেমন আত্মবিশ্বাসী করে তোলে তেমনি নিজেকে অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয়ভাজন ভাবতে শেখায়। অনেক শিশুই রয়েছে যারা দীর্ঘ সময় ধরে পাশাপাশি বসে খেলাধুলা করার পরও নিজেদের মধ্যে সফল যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। এ কারণে শিশু-কিশোরদেরকে যোগাযোগের কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া জরুরি। শিশুরাও বড়দের মতো মৌখিক এবং অ-মৌখিক-এই দুই প্রকারের যোগাযোগ স্থাপন করে। শরীরের ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, চোখে চোখ রাখা বা আই কন্টাক্ট হচ্ছে অমৌখিক যোগাযোগের অংশ। হাত ও পা-এর নড়াচড়ার ধরণ, দাঁড়ানো বা বসার স্টাইল, মুখের অভিব্যক্তি, মাথা নাড়ানো-এসবও অমৌখিক যোগাযোগের অংশ। এগুলো বড়দের মতো শিশুরাও ব্যবহার করে। দৃষ্টি সংযোগ বা আই কন্টাক্ট ব্যক্তির কথা বলার আগ্রহকে তুলে ধরে। শিশুরা সাধারণত শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর নিজেদের নাম-পরিচয় তুলে ধরতে বেশি পছন্দ করে।
বেশিরভাগ শিশুই মুখের অভিব্যক্তি ও কথার সুরের পরিবর্তন, দাঁড়ানো বা বসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্টাইল অনুসরণের মাধ্যমে বন্ধু ও সমবয়সীদের সঙ্গে মৌখিক ও অমৌখিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে। তাদের যোগাযোগটা কোন ধরণের বাক্য দিয়ে শুরু হলো তা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো চোখে, মুখ ও কণ্ঠে উৎফুল্ল ভাব আছে কিনা। এই উৎফুল্লতা সফল যোগাযোগ স্থাপনে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সাধারণত শিশুরা প্রথম সাক্ষাতেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং একসঙ্গে খেলার আগ্রহ প্রকাশ করে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য কোনো একটা শিশুকে প্রথমে বেশি অগ্রগামী হতে হয় এবং আকর্ষণীয় কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করতে হয়। কখনো কখনো দেখা যায় শিশুরা কী নিয়ে কথা বলবে তা খুঁজে পাচ্ছে না। এ অবস্থায় শিশুরা একে অপরের কাছে খুবই সাধারণ প্রশ্ন উত্থাপন করে কথোপকথন শুরু করতে পারে। যেমন সে ইদানীং কী কাজ করেছে, কোন ধরণের খেলা তার পছন্দ- এমন সব সাদামাটা কিন্তু সবার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে কথোকপন শুরু করতে পারে।
শিশুদের মধ্যেও যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানো এবং পারস্পরিক বন্ধুত্ব জরুরি কারণ, যেসব শিশুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে তারা বেশি উৎফুল্ল থাকে। একই সঙ্গে তারা অন্যদের তুলনায় বেশি সামাজিক ও বেশি মিশুক হয়ে থাকে। এর কারণ হলো এ ধরণের শিশুরা তাদের বন্ধুদের সঙ্গে নিজের মত বিনিময় করতে পারে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানাতে পারে এবং নানা ঘটনা বর্ণনা করতে পারে এমনকি নিজের সাফল্য ও ব্যর্থতার বিষয়গুলোও বলতে পারে। এসব তৎপরতা তাদেরকে প্রফুল্ল রাখে। শিশুরা একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করার মাধ্যমে আনন্দ পায়। এই আনন্দ অন্যান্য কাজের ওপরও প্রভাব ফেলে। কিন্তু যেসব শিশু সহজে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না তারা এক কোণায় বসে সমবয়সীদের খেলা দেখতে বাধ্য হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের সুযোগ কম থাকে। যাইহোক, যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছু বিষয় মা-মায়ের পক্ষ থেকে শিশুদেরকে শেখানো উচিত। আপনার শিশু সন্তান যখন কারো সঙ্গে কথা বলে তখন তাকে অপর পক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শেখান। তাকে বলুন সে যাতে কথা বলার সময় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে।
শিশুকে আবেগ-অনুভূতির নানা পর্যায় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিন। তাকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ, রেগে যাওয়া, আশাহত হওয়া, আনন্দ-ফুর্তি করা, একটু দুষ্টুমি করা, একটু উল্টাপাল্টা কাজ করা, ক্লান্ত হওয়া, ভয় পাওয়া, বিপদ অনুভব করা- এ ধরণের নানা বিষয় উপলব্ধির সুযোগ দিতে হবে। তবে যখন শিশু কোনো ভুল কাজ করবে তখন তাকে বোঝাতে হবে যে, তার কাজটি করা ঠিক হয়নি এবং এ কারণে আপনি মন খারাপ করেছেন। এ সময় আপনাকে একটু কঠোরভাবেই সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে যে, আপনি ঠিক তার কোন কাজ বা আচরণের কারণে কষ্ট পেয়েছেন। আপনার শিশু সন্তানকে এটা শেখাতে হবে যে, সে কীভাবে মৌখিক এবং অ-মৌখিক অনুভূতি প্রকাশ করবে, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরণ কেমন হবে এবং সামাজিক নানা বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিৎ। শিশুরা যাতে অন্যের সঙ্গে একটা সুন্দর ও সুস্থ সম্পর্ক গড়তে পারে, সব কাজে লজ্জা না পায় এবং ভালোভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে সেজন্য তাদেরকে কিছু পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। শিশুরাও যে নিজের কথা বলার, প্রশ্ন উত্থাপনের, নিজের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার এবং নিজের চিন্তা-বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার রাখে তা তাদেরকে বোঝাতে হবে।
আপনার সন্তান হয়তো একা একা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বা সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এমনও হতে পারে সে সহজেই অপরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এতে চিন্তার কিছু নেই। আপনি আপনার সন্তানকে সহযোগিতা করুন। তাকে নানা ধরণের পরিবেশে নানা ধরণের মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিন। শিশুরা আনন্দ পায় এমন ক্লাসে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করুন, খেলার মাঠ ও বিনোদন পার্কে নিয়ে যান এবং বিভিন্ন ধরণের খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিন। এর ফলে আপনার সন্তান ক্রমেই আরও বেশি সামাজিক হয়ে ওঠবে। একটা শিশু যখন অপর শিশু বা তার চেয়ে বড় কোনো মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে, কথা বলে অথবা কোনো ইস্যুতে ভাব আদান-প্রদান করে তখন তার মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ে এবং তার ব্যক্তিত্ব গঠনে এটা সহযোগিতা করে। যেসব শিশু ভয়-ভীতি ছাড়াই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে সেসব শিশু বড় হয়ে সহজেই জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। শিশুকে আলোচনা, সমস্যা সমাধান, অমৌখিক যোগাযোগ স্থাপন, নিজের যুক্তি ও অবস্থান তুলে ধরা এবং মানুষের সামনে বক্তৃতা করার সুযোগ দিন। সে যাতে এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ায় সেজন্য উৎসাহ দিন।
শিশুদের প্রথম শিক্ষক হচ্ছেন তারা বাবা-মা। শিশু যাতে নানা পরিবেশে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে, সাফল্যের সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে পারে এবং সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারে, সেজন্য বাবা-মাকে সোচ্চার হতে হবে এবং প্রয়োজনীয় নানা বিষয় শেখাতে হবে। শিশুদের মধ্যে যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানোর নানা কৌশল সম্পর্কে বাবা-মা অবহিত থাকলে তারা সহজেই তাদের সন্তানদেরকে সেগুলো শেখাতে পারবেন এবং তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। এসব কৌশলের মধ্যে একটি হলো শিশুকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া। অনেক বাবা-মা আছেন যারা সন্তানের কথার মধ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত। অর্থাৎ তারা অপর ব্যক্তির কথা শেষ হওয়ার আগেই নিজে কথা বলতে শুরু করেন। এর ফলে যিনি কথা বলছিলেন তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হন এবং নিজের মতামত পুরোপুরি প্রকাশ করতে ব্যর্থ হন। এই অভ্যাসটা ত্যাগ করতে হবে। আপনি আপনার সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড ধৈর্য ধারণের ফর্মুলা প্রয়োগ করুন। আপনার শিশুকে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড চিন্তা করার এবং এরপর উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিন। এটি একটি উপযুক্ত পন্থা।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।