ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩ ১৯:৩৮ Asia/Dhaka

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা ভালো ও সুস্থ আছেন। আমরা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কথা বলব। সম্প্রতি এ দিবসটি পালিত হয়েছে।

আর এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাদের সাথে অতিথি হিসেবে আছেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবদুল আউয়াল ঠাকুর। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সহকর্মী সিরাজুল ইসলাম।

জনাব আবদুল আউয়াল ঠাকুর আলাপনে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

রেডিও তেহরান:  আবদুল আউয়াল ঠাকুর,  আরো একটি ২১শে ফেব্রুয়ারি পার করলাম আমরা যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে থাকি। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর এসে এর অর্জন সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: দেখুন, ভাষা আন্দোলনকে আমি সব সময় মনে করি আমাদের চেতনার গভীরে গ্রোথিত একটি জাতিসত্তার সূচক নির্দেশক। অর্থাৎ ভাষাটা আমাদের এখানে জাতীয়তাবাদ হিসেবে গৃহীত হয়েছে একদিকে, অন্যদিকে এই ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের সুদীর্ঘ সময়ের লড়াই এবং ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকার আত্মপ্রত্যয়ের চেতনাবোধ সংগঠিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেটা ঘটেছে সেটিকে কেবলমাত্র মাইলস্টোন বলা যাবে। আমরা শত সহস্র বছর ধরে এই অঞ্চলে অর্থাৎ দ্রাবিড়িয় সভ্যতার সময় আদি মানুষ যে ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছিল মুখে মুখে-কথায় কথায় সেটি আর্য বা সনাতনি আক্রমণের মধ্য দিয়ে সমাজে বর্ণবাদ প্রথা সৃষ্টির বিরুদ্ধে যে মানুষগুলো লড়াই করেছিল ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সেই মানুষগুলোর আত্মপ্রত্যয় চেতনার অংশই ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন।

শহিদ মিনার

অনেক ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করেন কিন্তু মূল জাতিগত সত্তা হচ্ছে ভাষার আন্দোলন যেভাবে  জনপ্রিয়তা পেয়েছিল এবং যেভাবে ব্যপ্তি ঘটেছিল তার ভিত্তিতে আমরা এর প্রতি যথাযথ সম্মান করছি সেকথা কিন্তু বলা যাবে না। তবে অবশ্যই একথা বলতে হবে ভাষা আন্দোলন থেকেই আমরা আমাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতার আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়েছি। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু ভাষার যে মুক্তি সংগ্রাম, ভাষার মৌলিক সত্তা প্রতিষ্ঠা করা আমাদের জাতীয় সত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ!

রেডিও তেহরান: জনাব ঠাকুর,  ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার সময় দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোলমাল সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন তাতে জড়িত। আবার বিএনপিও অভিযোগ করেছে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে। কী বলবেন আপনি?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: বিষয়টি খুব সংক্ষেপে বললে,স্বা ধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথম যে ২১ শে ফেব্রুয়ারি পালিত  হয়েছিল সেখানে রাত ১২ টার পর আলো নিভিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছিল। খবরটি পরের দিন দৈনিক গণকণ্ঠে প্রকাশিত হয়েছিল। তার পেছনে কোনো রাজনীতি ছিল কি না আমি জানি না তবে এটি বলা যাবে সেই ঘটনা ঘটিয়েছিল অশ্লীল কতগুলো বেহানা মানুষ! তার পেছনে মদদ ছিল। ২১ শে'র স্মৃতি স্তম্ভে ফুল দেয়া নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। মাঝখানে নানা আলোচনার মধ্যেও যখন গণতান্ত্রিক সহনশীলতা ছিল তখন এটি বন্ধ ছিল। আবার গত কিছুদিনে বিষয়টি আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। কেন এবং কি কারণে শহিদ মিনারে মালা দিতে গিয়ে উত্তপ্ত  ও উত্তেজিত হয়ে উঠি একথা বোঝার কোনো সুযোগ নেই! প্রকৃতপক্ষে ভাষা শহিদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে যারা কুণ্ঠবোধ করেন তারাই এই ধরনের অপকর্মে জড়িত আছেন বা থেকে থাকতে পারেন বলে মনে করি।

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আবদুল আউয়াল ঠাকুরের সাক্ষাৎকার শুনছেন। আমাদের সাথেই থাকুন,ফিরছি শিগগিরি।

রেডিও তেহরান:  মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম। জনাব আবদুল আউয়াল ঠাকুর, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাংলা ভাষার চর্চা এবং এর উন্নয়ন নিয়ে নানা রকম আলোচনা হয়, বার বার বলা হয় সর্বস্তরে বাংলা | ভাষা চালু করার কথা। কিন্তু ফেব্রুয়ারি শেষে আবার সেই আগের অবস্থায় সবকিছু ফিরে যায়। এর কারণ কী?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: দেখুন, আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধানের মধ্যেই উপনিবেশিকতা কার্যকর রয়েছে। বাংলা ভাষা মানুষের মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা , গণতন্ত্রের কথা এবং সকল মানুষকে সমন্বিত করে ভাব বিনিময়ের কথা বলে। অর্থাৎ যারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান যেমন ধরুন-উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ম আদালত পর্যন্ত যাঁরা কাজ করেন তারা বাংলা বলা এবং চর্চায় যদি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি তা কার্যকর না করেন তাহলে কীভাবে সম্ভব!

ভাষা আন্দোলন

তবে এখানে অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে বাংলা বলতে হবে তারমানে এই না যে অন্য ভাষা শেখা যাবে না। আমাদের এখানে অব্স্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই গল্পের মতো- বাংলা তো জানি না, ইংরেজি বুঝিনা, আরবি শিখিনি অর্থাৎ সব মিলিয়ে একটা মুর্খ শ্রেণি ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। কার্যত ভাষা দরদি কোনো মানুষের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব যে ভাষার প্রতি যদি আমরা সম্মান প্রদর্শন করতে না পারি তাহলে মূলত আমি আমার নিজেকে অসম্মান করছি। আর কাজটা তো কেবল ভাষার মাসের না; কাজটা হচ্ছে সারা বছরের, সারা জীবনের এবং যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে বা যদি বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চিন্তা করে তাহলে অবশ্য অবশ্যই তাকে বাংলা ভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে বাস্তবে এবং চেতনায়। এই দুটো জিনিষের সমন্বয় করা না গেলে কথা কথাই থাকবে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমরা শুধু সম্মান দেখাব আর বক্তৃতা দেব তার বাইরে কিছুই হবে না।

রেডিও তেহরান: জনাব ঠাকুর সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব,  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা নিয়ে গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে। আমাদের ভাষার উন্নয়নে বাংলা একাডেমী ও ভাষা ইনস্টিটিউটের ভূমিকাকে কীভাবে দেখেন আপনি?

আবদুল আউয়াল ঠাকুর: প্রধানমন্ত্রী যে কথাটি বলেছেন সেটি খুবই সময়োপযোগী কথা বলেছেন বলে আমি মনে করি। এই কারণে যে, বাংলা ভাষার গবেষণার বিষয়টি যে প্রচলিত অর্থে দেখি তার চেয়ে কিন্তু এই ভাষা নিয়ে গবেষণার বিষয়টি অনেক দূরে। বাংলা ভাষায় আমরা যে ব্যকরণটি পাঠ করি সেটি মূলত সংস্কৃত ব্যকরণের  বাংলারূপ। আমরা যে ভাষাকে আমাদের ভাষা বলে মনে করছি সেটি আমাদের আদি ভাষার সাথে সম্পৃক্ত নয়। যে ভাষা আমাদেরকে লড়াই করতে শিখিয়েছে সেই প্রাকৃত ভাষার মৌলিক অবস্থার মধ্যে কিন্তু আমরা নেই। যেহেতু ভাষার কোনো আদিসত্তা নেই সেই কারণে ভাষা পরিবর্তিত। আর পরিবর্তনের মধ্যে ভাষা কীভাবে সম্পৃক্ত করছে সেই সম্পৃক্ত করণের ধারাটা কিন্তু একটা নিয়ম মেনে চলে। আমাদের ভাষাকে আমরা সেই নিয়মের মধ্যে আনতে পারিনি। কেউ কখনও বাংরেজির কথা বলি, কেউ কখনও বাংলি ভাষার কথা বলি বা অন্য ভাষাকে পছন্দ করি অর্থাৎ আমাদের চিন্তা এবং মেধা মননের মধ্যে অন্য জাতির প্রতি যে একটা পরোক্ষ আনুগত্য সেটিকে ভাষার মধ্যে অন্তর্নিহিত করতে চাই। এই নিজের ভাষার মধ্যে বিদেশিদের লিন করার প্রবণতাই হচ্ছে আমাদের একধরনের অপ্রশংসনীয় উদ্যোগ। এর বাইরে প্রশংনীয় উদ্যোগ হচ্ছে মূল ভাষার ওপর কাজ করা। আজকে বলা হয় ত্রিশ কোটিরও বেশি মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। কিন্তু আমরাই একমাত্র জাতি যারা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মনে করি। অন্যরা তো তা মনে করে না। তাদের কাছে বাংলা অবদমিত ভাষা। আর ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবিতো আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বৃটিশ আমল থেকে নবাব আলী চৌধুরী সাহেব করেছেন, ড. মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহ সাহেব করেছেন, আমাদের এখানে তমুদ্দিন মজলিস করেছে সর্বশেষ ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছি। এটা হলো রাজনৈতিক দিক কিন্তু এই কাজগুলো  করেছেন তাদের মূল বিষয় হচ্ছে ভাষার প্রতি গবেষণা। অর্থাৎ গবেষণাহীনভাবে যদি কোনো ভাষা চলতে থাকে তাহলে ভাষার প্রবহমানতাকে অব্যাহত রাখা যায় না। আমাদের ভাষার মধ্যে এই একটা অসঙ্গতি রয়েছে। আর এই অসঙ্গতি দূর করার দায়িত্ব হচ্ছে গবেষকদের। অর্থাৎ ভাষাকে একটি মূল লাইনে ফিরিয়ে আনা, ভাষাকে তার নিজস্ব গতিতে ফিরিয়ে আনা। বাংলা ভাষার উপযোগি  একটা ব্যকরণ তৈরি করা যে ব্যাকরণের মাধ্যমে বাংলা ভাষা আগামীতে টিকে থাকার চেষ্টা করবে আর সেই চেষ্টা করাটাই গবেষণা।

রেডিও তেহরান: জনাব আবদুল আউয়াল ঠাকুর, অমর ২১ শে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আলাপন অনুষ্ঠানে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৬

ট্যাগ