রংধনু আসর
জাম্বিয়ার রূপকথা: গন্ডার ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতা
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই রূপকথা শুনতে পছন্দ করো। রূপকথার গল্পগুলোর মধ্যে খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার গল্পটি সম্ভবত সবাই জানো। তবে আজকের আসরে আমরা ওই গল্পটি শোনাব না। আজকের গল্পটি গন্ডার ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার নিয়ে। আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় প্রচলিত গল্পটি অনুবাদক করেছে কবি হাসান হাফিজ। গল্পের পর থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।
একদিন দুপুরের ঘটনা। গন্ডার পরিবারের সবাই খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। গন্ডার, তার স্ত্রী ও তিন ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে গল্প হচ্ছিল। বিষয়: মাটির পৃথিবী ও স্বর্গ। কোন জায়গার জীবন কেমন? কারও ধারণা, মাটির দুনিয়ার চেয়ে ওখানে আরাম–আয়েশ অনেক বেশি। কেউ আবার বলছে, না এখানেই ভালো আছি আমরা। দুনিয়ায় কোন প্রাণী কতটা সুখী?
গল্পের এক পর্যায়ে কেমন করে যেন কচ্ছপের কথা এসে গেল। এক ছেলে বলল, ‘আহা রে বেচারা! খুব মায়া লাগে ওর জন্য। বিপদে পড়লেও জোরেশোরে ছুটতে পারে না সে। এতই মন্থর গতি গোবেচারা প্রাণীটির।’
মা গন্ডার বলেন, ‘কথা সত্য। তা সত্ত্বেও এই ছোট প্রাণীটি কিন্তু বেশ মজার। দেখতেও বেশ সুন্দর। ওদের আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি।’
গন্ডার পরিবারের একেবারে ছোট ছেলেটি একটু আলাদা। তার চিন্তাভাবনা কারোর সঙ্গে মেলে না। সে ফোড়ন কেটে বলল: ‘কচ্ছপের সঙ্গে দৌড়ানোর প্রতিযোগিতা করলে কেমন হয়? ওকে হারিয়ে দেওয়া তো খুবই সহজ তাহলে। তাই না?’
বাবা গন্ডার বলল: ‘হয়তো সহজ। তবে কচ্ছপ কিন্তু বেশ চালাক–চতুরও বটে। ওকে যদি বোকা ভাবো কেউ, মারাত্মক ভুল করা হবে। দেখো, ভুলেও ওর সঙ্গে কখনো লাগতে যেয়ো না। তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি, বাবারা। আমার কথাটা মনে রেখো। না হলে পস্তাবে।’
ছোকরা গন্ডারের পছন্দ হলো না এমন সাবধানবাণী। সে মুখ গোমড়া করে বলল: ‘কী যে বলো না বাবা! দৌড় হলে আমি খুব সহজেই কচ্ছপকে হারিয়ে দিতে পারব। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ওর যে গতি, সেটা তো পিঁপড়াকেও হার মানায়।’
ছোকরার মনে ভারি দেমাগ। বেশ অহংকারীও সে। বাবার কথাকে গুরুত্ব দিল না মোটেও। মনে মনে ঠিক করল একদিন না একদিন কচ্ছপকে দৌড়ে হারাবেই হারাবে। একদিন ছেলেটি চলে গেল নদীর ধারে। ওখানটায় আগে কচ্ছপ দেখেছে সে। যেকোনো কচ্ছপের সঙ্গে আজ তার দেখা হয়ে যাবে। দেখলেই প্রস্তাব দেবে দৌড়াদৌড়ির। সে রকমটা ভেবেই এখানে তার আসা।
খুব বেশি দেরি করতে হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা খুদে কচ্ছপ ভেসে উঠল ভুস করে। গন্ডারশাবক তাকে দেখে বলে, ‘ওহে কচ্ছপ। আকারে–আয়তনে তুমি কত্ত ছোট একটা প্রাণী। আহ–হা রে! কী দুর্ভাগ্য তোমার। আফসোসে বাঁচি না।’
কচ্ছপ এই খোঁচা হজম করার পাত্র না। সে–ও পাল্টা জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, তা মন্দ বলোনি তুমি। সত্যি কথাই বলেছ। তবে শরীরের সাইজ যেমনই হোক, তা নিয়ে আমি কিন্তু মোটেও লজ্জিত নই।’
গন্ডারশাবক: কী বললে? তোমার লজ্জা হয় না এতে? আমি যদি তোমার জায়গায় হতাম, তাহলে এমন উদ্ভট কথা কখনো বলতাম না।’
কচ্ছপ: ‘সেটা তোমার ব্যাপার। নিজের চরকায় তেল দাও বাপু।’
গন্ডারশাবক: ‘ও, তাই নাকি? তোমার জন্য করুণা হয় রে পিচ্চি। ইশ, কী বিশ্রীই না দেখতে তুমি। ছিঃ!’
কচ্ছপ: ‘দেখো হে, ছোট আকৃতির জীব হওয়াটা লজ্জার কোনো ব্যাপার না। আমি আছি আমার জায়গায়। তোমার জায়গায় তুমি।’
গন্ডারশাবক: ‘তুমি একটা বুদ্ধু হাঁদারাম।’
কচ্ছপ: ‘অ্যাই খবরদার। উল্টাপাল্টা কিছু বলবে না। ভালো হবে না বলে রাখছি। আমি কি তোমার কোনো ক্ষতি করেছি নাকি? পেছনে লাগছ কেন শুধু শুধু?’
গন্ডারশাবক: ‘আরে আমার কোনো ক্ষতি করার মুরোদ তোমার আছে নাকি? আমার তুলনায় তুমি তো কিচ্ছুই নও বলতে গেলে।’
কচ্ছপ: ‘কী যা–তা বলছ! আসল কথাটা বলে ফেলো। ঝেড়ে কাশো তো শুনি। এখানে কোন মতলবে এসেছ, সেটা সাফ সাফ বলো।’
গন্ডারশাবক: ‘আমি তোমাকে জ্ঞান দিতে এসেছি। আমার বিশ্বাস, তুমি তারপর এমন অবুঝ থাকবে না।’
কচ্ছপ: ‘আমার তো মনে হয়, তুমি নিজেই বেকুবের মতো কথা বলছ। আমরা যে মোটেও বেকুব নই, সেটা প্রমাণ করা কঠিন কাজ না। তার পরীক্ষাও হতে পারে তুমি রাজি থাকলে।’
গন্ডার ছোকরা যেন হালে পানি পায় এ কথা শুনে। ঝটপট জবাব দেয়, ‘ঠিক এ জন্যই এখানে আমার আসা। দারুণ কথা বলেছ। পরীক্ষা একখানা হয়েই যাক তাহলে।’
কচ্ছপ: ‘আচ্ছা বেশ, হোক পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা কীভাবে হতে পারে, তুমিই নাহয় বলো।’
গন্ডারশাবক তো আগেই ভেবে রেখেছে। যথাযথ মওকা পেয়ে তা প্রকাশ করল সে। ‘কাল সকালে আমরা দৌড়ানোর প্রতিযোগিতা করব। চার–চারটি নদী পার হয়ে সোজা চলে যাব দক্ষিণে। একেবারে সাগরপাড়ে।’
শুনে কচ্ছপ মোটেও ঘাবড়ায় না। ‘ঠিক আছে। তা–ই হবে। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
গন্ডারশাবক অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। গর্বে বুক ফুলে উঠেছে তার। সে বলল: ‘আমি যদি কোনোক্রমে হেরে যাই, তাহলে তুমি যা বলবে তা-ই হবে। এই কথা রইল। তবে হারব না আমি।’
কচ্ছপের মনের জোর নিতান্ত কম না। সে–ও জোর গলায় গন্ডারকে সাফ জানিয়ে দেয়, ‘আগামীকাল ভোর হওয়ার পরপর এখানে চলে এসো। এখান থেকেই আমাদের দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হবে।’
নদীর পাড় থেকে চলে যাওয়ার পর কচ্ছপ বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে মিটিংয়ে বসে। গন্ডারশাবকের সঙ্গে কী কী কথা হয়েছে, ওদের তা জানায়। বেয়াদব গন্ডার ছোকরাকে কীভাবে আচ্ছামতো নাস্তানাবুদ করা যায় তা নিয়ে সলাপরামর্শ করে সবাই মিলে। সবাই মাথা খাটিয়ে বের করে একটা মোক্ষম কৌশল। ঠিক হয়, আগে থেকেই চার নদীতে চারটা কচ্ছপ গিয়ে লুকিয়ে থাকবে। নদীর পাড় ঘেঁষে ঘাপটি মেরে চুপটি করে থাকবে তারা। কে কখন কী বলবে, সেটাও বেশ ভালোমতো শিখিয়ে–পড়িয়ে দেওয়া হয়।
পরের দিন সকালবেলায় গন্ডার ছোকরা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির। কচ্ছপকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী, তৈরি আছ নাকি? চলো, আমরা দৌড় শুরু করি।’
কচ্ছপ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল: ‘বানর ভায়া শিস দিলেই আমরা দৌড় শুরু করব। ঠিক আছে?’
গন্ডারের আর তর সইছিল না। ঝাঁজিয়ে উত্তর দিল: ‘আরে রাখো তোমার বানরের শিস। এটা কোনো খেলা হলো নাকি? শুরু হওয়ার আগেই ফল জেনে রাখতে পারো তুমি- এই প্রতিযোগিতায় আমি জিতে গেছি। এটা একরকম সুনিশ্চিত বিষয় বলে ধরে নিতে পারো হে পুঁচকে প্রাণী।’
কয়েক সেকেন্ড পর বানর শিস দিলে গন্ডার দৌড় শুরু করে। হুমহাম করে ছোটে। মুচকি হাসে কচ্ছপ। সে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়। ভাবে, এই বেকুবটার উচিত শিক্ষা হবে আজ। বাছাধন খানিক বাদেই টের পাবে, কত ধানে কত চাল।
গন্ডার হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথম নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল আরেকটা কচ্ছপ। সে মিটমিটিয়ে হাসে, ‘যেতে হবে আরও অনেক দূর। জোরসে দৌড়াও গন্ডার ভায়া।’
গন্ডার থামে না। জিততে তাকে হবেই। ছুটতে ছুটতেই বলে, ‘শেষমেশ আমিই জিতব। এটা জেনে রাখো আহাম্মক। আমার সঙ্গে তুমি পেরে উঠবে না।’
দ্বিতীয় নদীর কিনারে পৌঁছানো গেল গন্ডারশাবক। সেখানেও অপেক্ষা করছিল অন্য একটা কচ্ছপ। ছুটন্ত গন্ডারকে দেখতে পেয়েই সে চেঁচিয়ে বলে, ‘ওহে অতি চতুর গন্ডার ভায়া। হালচাল কেমন বুঝছ?’
গন্ডার কী জবাব দেবে? সে অবাক। ভাবে, কচ্ছপ এত জোরে ছুটছে কীভাবে? এ রকম গতি সে কেমন করে পেল? আজব কাণ্ড!
তৃতীয় নদীর পাড়ে পৌঁছতেই শোনা যায় অন্য আরেক কচ্ছপের কণ্ঠ। ঠাট্টার হাসি হেসে বলে সে, ‘এসো এসো, গন্ডার বন্ধু। পারলে আমাকে টপকে এগিয়ে যাও দেখি। জোরে, আরও জোরে দৌড়াও। না হলে তুমি জিতবে কেমন করে? এত অল্পে হার মানবেই–বা কেন? তোমার গায়ে তো জোরবল অনেক। মনের জোরও কম নেই। ছোটো। দৌড়াও।’
গন্ডার একটু থমকে দাঁড়ায়। তার গোঁ কমেনি এখনো। বলে, ‘আচ্ছা বাপু, দেখোই না, কে জেতে শেষ পর্যন্ত। শেষ হাসিটা কে হাসে! জিত আমারই হবে। দেখে নিয়ো। আমার জয়ী হওয়াটা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।’
কচ্ছপ তো হেসে কুটিপাটি। বাঁকা হাসি তার মুখে। বলে, ‘কীসব অদ্ভুতুড়ে কথা যে বলো না তুমি। হেরে ভূত হয়ে যাবে একেবারে। সেটাই ঘটতে যাচ্ছে। এখনো সময় আছে। আপস করতে চাইলে করে নিতে পারো। পরে আর সুযোগ থাকবে না।’
আপসের প্রস্তাব শুনে গন্ডারের চোখেমুখে আশার আলো ফোটে যেন। আহ্লাদিত হয়ে বলে, ‘কচ্ছপ ভায়া। ছুটতে ছুটতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছ তুমি। তাই না? নাহলে আপসরফার কথা তুললে কেন? না হে, কোনো আপস নয়। আমিই তো জিতে যাচ্ছি। এই তো আর মাত্র একটা ধাপ। তারপরই তো জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাবে।’
শুনে ফিকফিক করে হাসে কচ্ছপ। চেঁচিয়ে বলে, ‘জীবনজগৎ সম্পর্কে বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা বা ধারণা তোমার নেই। থাকলে এমন উজবুকের মতো কথা বলতে না। তুমি এক নম্বরের একটা গাধা। সে জন্যই বেআক্কেলের মতো দৌড়ে মরছ।’
৪ নম্বর নদীর ধারে পৌঁছায় গন্ডার। আর পেরে উঠছে না সে। পা চলে না। শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। দম যেন বেরিয়ে যাবে। গন্ডার দেখে, এখানেও আগে থেকেই কচ্ছপ হাজির। মর জ্বালা। এটা কেমন করে সম্ভব? নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
কচ্ছপের মুখে বিজয়ীর হাসি। সগর্বে বলতে থাকে, ‘দৌড়ে আমাকে হারানো তোমার কাজ নয়। নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ সেটা।’
গন্ডার কী বলবে? বলার কিছু নেইও। অপমানে–লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
কচ্ছপ আবারও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, ‘বোকামি ও অহংকারই তোমাকে ডুবিয়েছে। তোমার পরিবারের বাকি সদস্যরা কিন্তু তোমার মতো নয়। তাই তাদের কাছ থেকে শিখতে পারো কীভাবে অন্যদের সম্মান দিয়ে কথা বলতে হয়। শিখতে পারো আচার–ব্যবহার, স্বভাব কেমনধারা হওয়া উচিত! অন্যের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কেন, কীভাবে করা দরকার, সেটাও শেখার আছে।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই এই ঘটনার পরের ঘটনা জানতে চাও? হ্যাঁ, বলছি। অদ্ভুত ওই প্রতিযোগিতার পর থেকে গন্ডারের দৌড়ের গল্পটি কচ্ছপসমাজে হাসির খোরাক জুগিয়ে আসছে। যখনই কোনো গন্ডার নদীর ধারে পানি খেতে আসে, তাকে যেকোনো কচ্ছপ দেখলেই হয়- হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে। অন্য কচ্ছপদের ডেকে এনে মজা লোটে। তারা মিলেজুলে ঠাট্টামশকরা করে গন্ডারের সঙ্গে।
আর লজ্জা পেয়ে গন্ডার তখন পানির তৃষ্ণা মেটাতে চলে যায় দূরে কোথাও। যেখানে কোনো কচ্ছপ তাকে নিয়ে হাসি–তামাশা করার সুযোগ পাবে না, তেমন কোনো জায়গায়। তবে ও রকম জায়গা কি আদৌ এ দুনিয়ায় আছে?
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি ফোক গান। গানের কথা ও সুর আব্দুল লতিফ। মরমী শিল্প আবদুল আলিমের গাওয়া কালজয়ী গানটি গেয়েছে শিশুশিল্পী জাইমা নূর ও নাবিহা নূর।
বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১১