কুরআনের আলো
সূরা আন-নাজম: আয়াত ১-১৮ (পর্ব-১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠান কুরআনের আলোর এ পর্ব থেকে সূরা আন নাজম নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরা ওহী নাজিলের পদ্ধতি এবং মহানবী (সা.)-এর মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করে শুরু হয়েছে। এরপর মুশরিকদের কুসংস্কারগুলো প্রত্যাখ্যান করে পার্থিব ও পরকালীন জীবনে কাফিরদের ওপর ঐশী শাস্তিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা নাজমের ১ থেকে ৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى (1) مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَى (2) وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4)
“শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্তমিত হয়।” (৫৩:১)
“তোমাদের সঙ্গী [মুহাম্মাদ (সা.)] পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি।” (৫৩:২)
“আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না।” (৫৩:৩)
“তার বাণী ওহী ছাড়া আর কিছু নয় যা তার প্রতি নাজিল করা হয়।” (৫৩:৪)
মক্কায় অবতীর্ণ আরো কিছু সূরার মতো এই সূরাও শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। এখানে নক্ষত্রের মতো এমন একটি সৃষ্টির শপথ করা হয়েছে যা যুগে যুগে মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এমনকি কোনো কোনো যুগে মানুষ নক্ষত্রসমূহের পূজাও করত।
নক্ষত্রের শপথ গ্রহণের পর মক্কাবাসীকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ তোমাদের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছে এবং ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সে তোমাদের সঙ্গে একত্রে বসবাস করেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তোমরা তার মধ্যে কোনো অসঙ্গত আচরণ বা ভ্রষ্টতা লক্ষ্য করোনি এবং তোমরাই তাঁর সত্যবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষ্য দাও। তাহলে আজ যখন সে একথা বলছে যে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদেরকে সৎপথ প্রদর্শনের জন্য নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছে তখন জেনে রেখো, একথা সে মনগড়া বলেনি বা তার মধ্যে ক্ষমতালিপ্সাও নেই। তার মুখ থেকে যেসব বক্তব্য শোনা যায় তার সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা ওহী। কাজেই তোমরা আল্লাহর অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনো।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবী-রাসূলগণকে সাধারণত পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত জাতিগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এসব মহামানবকে কোনো পাপ স্পর্শ করেনি বরং শিশুকাল থেকেই ওই নষ্ট জাতিগুলোর ভ্রান্ত বিশ্বাস ও অন্যায় আচরণ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে তারা নিজেদের পুতপবিত্র রেখেছেন।
২- যারা সত্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয় তারা পবিত্র মানুষদের ওপর ক্ষমতালিপ্সার অপবাদ দিয়ে সত্য থেকে দূরে সরে গেছে।
৩- নবী-রাসূলদের বক্তব্য যেমন মনগড়া নয় তেমনি তা সমাজের পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব থেকেও মুক্ত।
৪- নবী-রাসূলদের বাণী আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী হিসেবে আসুক অথবা তাঁরা নিজে থেকে বলুন- তা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।
এবারে সূরা নাজ্মের ৫ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে:
َلَّمَهُ شَدِيدُ الْقُوَى (5) ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَى (6) وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَى (7) ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى (8) فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَى (9) فَأَوْحَى إِلَى عَبْدِهِ مَا أَوْحَى (10) مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَى (11) أَفَتُمَارُونَهُ عَلَى مَا يَرَى (12)
“[এই ওহী] তাকে শিক্ষা দিয়েছে প্রবল শক্তিধর [আল্লাহ তায়ালা]।” (৫৩:৫)
“[যে কিনা] প্রজ্ঞাবান ও বিস্ময়কর শক্তির অধিকারী, সে নিজ আকৃতিতে স্থির হয়ে ছিল।” (৫৩:৬)
“আর সে শ্রেষ্ঠ ছিল ঊর্ধ্বদিগন্তে।” (৫৩:৭)
“অতঃপর সে নিকটবর্তী হল, অতঃপর আসলো আরো নিকটে।” (৫৩:৮)
“ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুক বা তার চেয়ে কম ব্যবধান রইল।” (৫৩:৯)
“তখন আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি যা ওহী করার তা ওহী করলেন।” (৫৩:১০)
“তিনি যা দেখেছেন, তার আত্মা সে সম্পর্কে মিথ্যা বলেনি।” (৫৩:১১)
“তিনি যা দেখেছেন তোমরা কি সে বিষয়ে তার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হবে?” (৫৩:১২)
এই আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহর সঙ্গে তাঁর রাসূলের সম্পর্ক স্থাপনের পদ্ধতি বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষক হলেন স্বয়ং মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তায়ালা। গোটা সৃষ্টিজগত তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তাঁর কাজকর্ম সুদৃঢ় ও মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর অবস্থান মানুষের কল্পনাশক্তির ঊর্ধ্বে এবং তাঁর নাগাল পাওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী পূর্ণাঙ্গ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহকে আত্মিকভাবে প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎ কোনো ভ্রম বা বিভ্রাট ছিল না বরং এটি ছিল মহানবীর প্রতি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার সর্বোচ্চ করুণা।
এই সাক্ষাতের ফলে ওহী নাজিলের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং হযরত জিব্রাইল আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাসূলের অন্তরে ঐশী বাণী ঢেলে দিতেন এবং মহানবী তা মানুষকে তেলাওয়াত করে শোনাতেন।
কোনো যুগেই কাফিররা আল্লাহর সঙ্গে মানুষের এই সম্পর্ক স্থাপনকে বিশ্বাস করেনি। সব নবী-রাসূলকে অস্বীকারকারী কাফিররা এই ঘটনাকে অসম্ভব ভেবেছে। অথচ এই সাক্ষাৎ বস্তুগত ছিল না বরং এই সাক্ষাৎ হয়েছে আত্মিক জগতে। এই আয়াতগুলোতেও বলা হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তায়ালাকে তার কলব বা আত্মার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছেন, চোখ দিয়ে নয়।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- শুধুমাত্র মানব অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা করার জন্যই শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না বরং আত্মিক দিক দিয়ে পূর্ণতায় পৌঁছার জন্য মানুষের ঐশী শিক্ষকের প্রয়োজন দেখা দেয়। নবী-রাসূল নামক এই শিক্ষকগণ আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে অর্জিত জ্ঞান মানুষকে শিক্ষা দেন এবং মানবজাতিকে কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে আলোর পথ দেখান।
২- যারা বিশ্বনবীকে তাদের নিজেদের মতো মানুষের কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত জ্ঞানী বলে ভাবত এই আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে তাদেরকে জবাব দিয়ে বলা হচ্ছে, তিনি কোনো মানুষের কাছ থেকে বিন্দু পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করেননি বরং সকল জ্ঞানের প্রকৃত উৎস স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ছিলেন তাঁর শিক্ষক।
৩- আল্লাহ তায়ালা চাইলে তাঁর রাসূলকে নিজের এতটা কাছে ডেকে নিতে পারেন যেখানে তারা কোনো মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি কথা বলতে পারেন।
সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلَقَدْ رَآَهُ نَزْلَةً أُخْرَى (13) عِنْدَ سِدْرَةِ الْمُنْتَهَى (14) عِنْدَهَا جَنَّةُ الْمَأْوَى (15) إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَى (16) مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَى (17) لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى (18)
“নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল।” (৫৩:১৩)
“সিদরাতুল মুনতাহার নিকট।” (৫৩:১৪)
“যার কাছে জান্নাতুল মাওয়া বা নিরাপদ বেহেশত অবস্থিত।” (৫৩:১৫)
“যখন সিদরাতুল মুনতাহাকে [যে নূরের] আচ্ছাদিত করার তা আচ্ছাদিত করল।” (৫৩:১৬)
“(সত্যের ব্যাপারে নবীর) দৃষ্টি ভ্রম ঘটেনি এবং সীমাও ছাড়িয়ে যায়নি।” (৫৩:১৭)
“অবশ্যই তিনি তাঁর রবের মহান নিদর্শনাবলীর কিছু দেখেছিলেন।” (৫৩:১৮)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাকিতায় এই আয়াতগুলোতে মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা বনি ইসরাইলের শুরুতেও এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। আগের আয়াতগুলোতে অন্তরাত্মার মাধ্যমে রাসূলের প্রত্যক্ষ করার কথা বলার পর এখানে ঊর্ধ্বালোকে মহানবীর সশরীর উপস্থিতি এবং চর্মচক্ষু দিয়ে আল্লাহ তায়ালার মহান কিছু নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি তিনি আসমানে আল্লাহর তৈরি জান্নাতও প্রত্যক্ষ করেছেন যেটি কেয়ামত পর্যন্ত মুমিন ও পবিত্র আত্মগুলোর আবাসস্থল। আর সে জান্নাত রয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা নামক গাছের ছায়াতলে।
মিরাজের সফরে বিশ্বনবী (সা.) নিজের চোখে অনেক সত্য অবলোকন করতে পেরেছিলেন। এর আগে যেমনটি হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিনের বাদশাহি দেখিয়েছিলেন এবং আল্লাহর এই নবী তা প্রত্যক্ষ করে অভিভূত হয়েছিলেন। কাজেই বলা যায়, মানবজাতিকে হেদায়েত করার জন্য আল্লাহ যেসব নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন তাদেরকে তিনি নিজের কিছু অভিনব নিদর্শন প্রত্যক্ষ করান যাতে তারা নিজেরা নিশ্চিত বিশ্বাসে পৌঁছার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে বিষয়গুলো সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বোঝাতে পারেন।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- নবী-রাসূলগণ তাঁদের অন্তরাত্মা দিয়ে মহান আল্লাহর অস্তিত্ব উপলব্ধি করার পাশাপাশি স্বচক্ষে তাঁর সৃষ্টির বিশালতা অবলোকন করেছেন।
২- কিয়ামত দিবসের পরে যে জান্নাত থাকবে তা ছাড়া বারযাখি জীবনে অর্থাৎ মৃত্যুর পরপরই আরেকটি জান্নাত রয়েছে; মুমিন ও পবিত্র আত্মার বান্দারা সেখানে কিয়ামতের আগেই ঐশী নেয়ামত ভোগ করেন। #
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএআর/২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।