নামাজ যখন শুদ্ধ হবে তখন জীবনের অন্য সব দিকও শুদ্ধ হবে
রমজান: খোদাপ্রেমের অনন্য উৎসব (পর্ব- ৫)
রমজানের রোজা রাখার উদ্দেশ্য হল তাকওয়া বা খোদাভীতি তথা খোদা-সচেতনতা অর্জন। মহান আল্লাহ এ জন্যই রোজা ফরজ করেছেন মুমিনদের জন্য। একই কারণে রোজা রাখা অতীত যুগের তথা ইসলাম-পূর্ব যুগে নবী-রাসুলদের অনুসারী বা উম্মতের জন্যও ফরজ করা হয়েছিল বলে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য খোদাভীরু হওয়া। পবিত্র কুরআন থেকে আমরা জেনেছি যে খোদাভীরুকে হতে হবে অদৃশ্যে বিশ্বাসী। খোদা, পরকাল, পরকালীন শাস্তি ও পরকালীন পুরস্কার –এসবই অদৃশ্য। অতীতের নবী-রাসুল এবং তাঁদের ওপর নাজিল হওয়া ধর্মগ্রন্থ-এসবই অদৃশ্য।
প্রিয়নবী তথা আল্লাহর শেষ রাসুলকেও (সা) আমরা দেখিনি। এইসব বিষয়ে বিশ্বাস ও মৌখিক স্বীকৃতির পাশাপাশি কাজও করতে হবে। আর এক্ষেত্রে মুমিনের প্রধান কাজ হল নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। নামাজ পড়া বা আদায় করা ও নামাজ প্রতিষ্ঠার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। নামাজ প্রতিষ্ঠার অর্থ ব্যাপক। কুরআনে সব সময়ই নামাজ প্রতিষ্ঠা করতে বলা হয়েছে। আমাদেরকে প্রত্যেক ইবাদত করতে হবে আল্লাহর ইচ্ছামত নিজের ইচ্ছামত নয়। যেমন, সফরে নামাজ সংক্ষিপ্তভাবে পড়তে হবে। নামাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে নামাজ আদায় জরুরি। বিনা কারণে নামাজের জামায়াত ত্যাগ গ্রহণযোগ্য নয়। নামাজের মধ্যে অন্তর হতে হবে মহান আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ ও প্রেমার্ত, বিনম্র ও ভীত-সন্ত্রস্ত।
পেটে যখন তীব্র ক্ষুধা তখন মনোযোগ যাতে ঠিক থাকে সেজন্য নামাজের আগে খেয়ে নেয়া উচিত। মন যখন প্রশান্ত ও আল্লাহ ছাড়া অন্য সব ভাবনামুক্ত তখনই নামাজ শুরু করতে বলা হয়। যে নামাজের মধ্যে নামাজির হৃদয় আল্লাহর প্রতি মনোযোগী থাকে না সে নামাজ গ্রহণ করা হয় না বলে হাদিস রয়েছে।
নামাজের সময় হলে মহানবী (সা) আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছু ভুলে যেতেন। খোদার ভয় ও খোদাপ্রেম ছাড়া সে সময় মনে অন্য কিছু থাকতো না। এ সময় তিনি যেন নিজের অতি আপনজনদেরও চিনতেন না। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) যখন নামাজ পড়তেন তখন তিনি যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু অনুভবও করতেন না তার প্রমাণ দেখা গেছে নামাজরত অবস্থায় তাঁর পা থেকে তির খুলে নেয়ার ঘটনায়। নামাজরত অবস্থায় তাঁর পা থেকে তির টেনে খোলা হলেও তিনি কিছুই টের পাননি! অথচ অন্য সময় ওই তিরে হাত দিলেও তিনি তীব্র ব্যথা অনুভব করতেন! নামাজের মধ্যে আমাদের মোবাইল ফোনে যদি কম্পন বা ভাইব্রেশনও সৃষ্টি হয় আমাদের মন আল্লাহর দিক থেকে উড়ে যায় অন্যদিকে- না জানি ব্যবসার ক্ষতি হল বা কোনো দুঃসংবাদ আসলো! নামাজে মনোযোগ না থাকার অন্যতম কারণ হল ধর্মীয় বিশ্বাস ও আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকা বা না থাকা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে সেইসব মুমিন বা বিশ্বাসীরাই সফল যারা নামাজের মধ্যে আল্লাহর প্রতি ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে।- এখানে খাশিয়ুন শব্দটি যা খুশু থেকে এসেছে তার অর্থ ভয় হলেও আরবি খওফ বা ভয় শব্দের চেয়ে ভিন্ন মাত্রাযুক্ত। খওফ হচ্ছে অচেনা বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে ভয়। কিন্তু খুশু হচ্ছে জানা ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি ভয়। অর্থাৎ আল্লাহ চান নামাজি যেন আল্লাহর পরিচয় জেনেই আল্লাহকে ভয় করেন। আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত ভয় তিনি চান না নামাজির কাছ থেকে। আল্লাহর পরিচয় জানার জন্য আল্লাহর বিখ্যাত ৯৯ নাম বা আসমাউল হুসনার ব্যাখ্যা জানা যেতে পারে এবং দোয়ায়ে জওশন কবিরও পড়া যেতে পারে ব্যাখ্যাসহ। দোয়ায়ে জওশান কবিরে মহান আল্লাহকে এক সহস্র পরিচয়ে স্মরণ করা হয়েছে।
নামাজ কবুল হল কিনা তা বোঝার উপায় হল সুরা আনকাবুতের এ আয়াত যেখানে বলা হয়েছে: নামাজ কায়েম বা প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয়ই নামাজ মন্দ বা অন্যায় কর্ম ও অশালীনতা থেকে রক্ষা করে। - একজন প্রকৃত নামাজি গিবত বা কোনো হারাম কাজ করতে পারেন না। অথচ অনেক নামাজি নামাজ শেষ হওয়ার পরই এ ধরনের মন্দ কাজের চর্চা শুরু করেন! এ ধরনের নামাজ যে কবুল হয়নি তা স্পষ্ট।
ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, তোমার নামাজ কবুল হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার উপায় হল নামাজের পর তুমি কোনো হারাম কাজ করছ কিনা! যদি দেখো যে করেছ তার মানে তোমার নামাজ কবুল হয়নি আল্লাহর দরবারে!
একই বিষয় রোজা ও হজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ প্রকৃত নামাজির নামাজ ও রোজাদারের রোজা ও হাজির হজ তাকে অবশ্যই অন্যায়, মন্দ কাজ ও অশালীনতা থেকে দূরে রাখবে।
নামাজ প্রতিষ্ঠার আরেকটি বড় শর্ত হল নামাজে যা বলছি তার অর্থ নিজেই বুঝতে হবে তা না হলে বিষয়টি হবে খুবই লজ্জাজনক। নামাজের সময়ও নামাজ কায়েমের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অনেকেই নিজের ব্যক্তিগত সব কাজ সেরে নামাজের ওয়াক্ত শেষ হওয়ার কয়েক মিনিট আগে নামাজ শুরু করেন। অথচ প্রকৃত নামাজির উচিত আযানের পরপরই অন্য সব কাজের আগে নামাজ সম্পন্ন করা এবং তাড়াহুড়া করে নামাজ সম্পন্ন না করা।
নামাজের সময় অন্য কাজের প্রতি মনোযোগ রাখা অনুচিত। তাই বলা হয়: নামাজকে বলো না আমার অন্য কাজ আছে, বরং অন্য কাজকে বলো আমার নামাজ আছে। তাড়াহুড়ো করে বা কোনো রকম দায়সারা গোছের যেন না হয় আমাদের নামাজ। আমাদের নামাজ যখন শুদ্ধ হবে তখন জীবনের অন্য সব দিকও শুদ্ধ হবে এবং তখনই আমরা হতে পারব প্রকৃত খোদাভীরু ও প্রকৃত রোজাদার।
এবারে শোনা যাক অর্থসহ পঞ্চম রমজানের দোয়া:

পার্সটুডে/এমএএইচ/২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।