রোজার মূল লক্ষ্য হল খোদা-সচেতনতা অর্জন করা
রমজান: খোদাপ্রেমের অনন্য উৎসব (পর্ব-২৯, ঈদ, খোদাসচেতনতা ও তাওয়াক্কুল )
আজ পবিত্র এবারের রজমানের সম্ভবত শেষ দিন। মহান আল্লাহ যেন এই রমজানকেই আমাদের জীবনের শেষ রমজান না করেন।
আজ সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর যদি চাঁদ দেখা না যায় তবে আগামীকাল ত্রিশে রমজান এবং পরশু পবিত্র ঈদুল ফিতর পালন করা হবে।
ঈদুল ফিতর হচ্ছে একমাস ব্যাপী সিয়াম সাধনার পুরস্কার তথা বড় ইফতার। সংযম সাধনার ফলে মানুষ যখন সব ধরনের পাপ-প্রবৃত্তিকে দমন করার ক্ষমতা অর্জন করে তার প্রকৃত মানবীয় প্রকৃতি বা পবিত্র ফিতরাতকে ফিরে পাবে তখনই তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে প্রকৃত ঈদ। আর এ জন্যই আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, যে দিনটিতে মানুষ কোনো পাপ করে না সে দিনটিই তার জন্য প্রকৃত ঈদের দিন।
গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ধৈর্য হচ্ছে পাপ বর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় এবং রমজান ও রোজা আমাদের ধৈর্য শেখায়। মহানবী (সা) বলেছেন, রমজান হচ্ছে ধৈর্যের মাস এবং নিঃসন্দেহে ধৈর্যের পুরস্কার হল বেহেশত। এক মাস ধরে পানাহার ও যৌন প্রবৃত্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ বড় ধরনের ধৈর্যেরই চর্চা।
হযরত ইমাম জাফর আস সাদিক (আ) বলেছেন, যখনই তোমাদের ওপর কোনো বিপদ বা কষ্ট নেমে আসে তখন রোজা রাখ। কারণ মহান আল্লাহ ধৈর্যের মাধ্যমে সাহায্য অন্বেষণ কর বলে পবিত্র কুরআনে যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে ধৈর্য বলতে আসলে রোজাকেই বোঝানো হয়েছে।
পবিত্র রমজানের রোজার মূল লক্ষ্য হল খোদা-সচেতনতা অর্জন করা। আর এই গুণ অর্জনের জন্য জরুরি মহান আল্লাহকে ভালোভাবে চেনা ও জানা এবং এরই আলোকে মহান আল্লাহর ওপর সব বিষয়ে পরিপূর্ণ ভরসা করাসহ আরও জরুরি অনেক গুণ অর্জন করা। মহান আল্লাহ সব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞানী ও সব বিষয়ে সবচেয়ে শক্তিশালী, চিরঞ্জীব এবং অসীম শক্তির অধিকারী হওয়ায় একমাত্র তাঁর ওপরই সব বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে ভরসা করা বা নির্ভর করা যায়।
উপাস্য হিসেবে বিবেচিত প্রতিমা বা মূর্তি ভাঙ্গার কারণে নমরুদ যখন হযরত ইব্রাহিমকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের ব্যবস্থা সম্পন্ন করে তখন জিবরাইল ফেরেশতা হযরত ইব্রাহিমের কাছে এসে বলেন, আমি কি আপনার জন্য কিছু করতে পারি বা আমার সাহায্য কি আপনি প্রত্যাশা করছেন? তখন মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসাকারী তথা পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুলের অধিকারী ওই মহান নবী বললেন, তোমার সাহায্য চাই না, তবে মহান আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশা করছি। এ সময় হযরত জিবরাইল ইব্রাহিম (আ)-কে একটি আংটি দেন যাতে লেখা ছিল: আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন তাঁর রাসুল; আমার পিঠকে ঠেকালাম তথা ভর করলাম আল্লাহর ওপর; আমার কাজকে আল্লাহর নির্ভরতার ওপর সোপর্দ করলাম ও আমার বিষয়গুলোকে আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। হযরত ইব্রাহিম এই আংটি আঙ্গুলে পরলেন এবং এরপর সুরা তাওহীদ বা ইখলাসে উল্লেখিত মহান নামগুলোর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে বললেন: ইয়া আল্লাহ ইয়া ওয়াহিদ ইয়া আহাদ ইয়া সামাদ ইয়া মাল্লামিআলিদ ওয়ালামইউলাদ ওয়ালাম ইয়া কুল্লাহু কুফুয়ান আহাদ। এরপর হযরত ইব্রাহিম আল্লাহর রহমতের ওয়াসিলায় অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষার আবেদন জানালেন মহান আল্লাহর কাছে।
এ সময় মহান আল্লাহ আগুনকে বললেন: ইব্রাহিমের জন্য শীতল ও স্বস্তিদায়ক হয়ে যাও! নমরুদ তখন শীতল হয়ে পড়া অগ্নিশিখার মধ্যে ইব্রাহিমের অবস্থা দেখে শির্কযুক্ত বিশ্বাস নিয়েই তার আশপাশের সবাইকে বলল: কেউ যদি নিজের জন্য উপাস্য গ্রহণ করে তখন তার উচিত ইব্রাহিমের উপাস্যের মত উপাস্যই গ্রহণ করা! অর্থাৎ ইব্রাহিমের খোদা যে সর্বশক্তিমান ও তিনি তাঁর বিশ্বাসী বান্দাকে যে একাকী ছেড়ে দেন না বরং সাহায্য করেন তা নমরুদও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
মহান আল্লাহর ওপর ভরসা মানুষকে দেয় প্রশান্তি ও টেনশন থেকে মুক্তি। হিজরতের সময় মহানবী যখন সওর গিরি গুহায় আশ্রয় নেন মক্কার কাফেরদের চোখ এড়ানোর জন্য তখন তাঁর সঙ্গী এই বলে আতঙ্কের কথা জানান: ওরা অনেক ব্যক্তি! আর আমরা মাত্র দু'জন। এ সময় মহানবী (সা) তাকে বললেন, ভয় পেয়ো না মহান আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। এ সময় মহানবী পরিপূর্ণ প্রশান্ত ও মুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন।
হযরত মুসা নবী (আ) যখন বনি-ইসরাইলকে মুক্ত করার জন্য মিশর থেকে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ও নীল-দরিয়ার তীরে উপস্থিত হলেন তখন তাঁর সঙ্গীদের অনেকেই ভীত-চকিত দৃষ্টিতে তাদেরকে গ্রেফতার করতে ছুটে আসা ফিরআউন ও তার দলবলের দিকে তাকাচ্ছিল এবং আতঙ্কিত হয়ে বলছিল: ওরা তো আমাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে! অর্থাৎ আমাদের ধরে ফেললো প্রায়! কিন্তু এ সময়ও মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ভরসার অধিকারী হযরত মুসা বললেন: কখনও না! আল্লাহ আমাদের সঙ্গে রয়েছেন ও তিনি আমাদের পথ দেখাবেন বা মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। - এ সময় আল্লাহর নির্দেশে মুসা নবী তাঁর লাঠি দিয়ে নীল নদের ওপর আঘাত হানলে তাতে শুকনো পথ তৈরি হয়ে যায় এবং মুসা নবীর সব সঙ্গী নদ পার হয়ে যায়। অন্যদিকে ফিরআউন ও তার সেনাদল এবং দলবল ওই পথে নদীর মাঝামাঝি এলাকা পর্যন্ত পৌঁছলে চারদিক থেকে আবারও পানি এসে তাদের ডুবিয়ে মারে।
বর্তমানে করোনা মহামারীর ভয়ে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করার কথাও ভুলে গেছেন এবং ভয় ও আতঙ্কেই তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে মহান আল্লাহর ওপর ভরসাকারীরা স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলার পাশাপাশি মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে সব কাজ করে যাচ্ছেন এবং এমনকি অসুস্থদের সেবায়ও এগিয়ে আসছেন।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র রোজার বরকতে তাঁর ওপর পরিপূর্ণ ভরসাকারী হওয়ার তৌফিক দিন।
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।