ইরানি অযেরি তুর্কি প্রবাদ: সিংহ তো সিংহই! এর নারী ও পুরুষে প্রভেদ নেই।
সুখের নীড় - পর্ব ২৬ ( ইরানি অযেরি তুর্কিদের পরিবার )
কোনো উপহার কতটা বড় বা মূল্যবান তা এর বস্তুগত মূল্যের ওপর নির্ভর করে না, বরং এর মাধ্যমে আপনি কতটা অনুরাগ ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করলেন সেটাই উপহারের আসল মূল্য।
তাই পরিবারের সদস্যদের জন্য বেশি অর্থ দিয়ে কেনা কোনো উপহার সংগ্রহের অপেক্ষায় না থেকে একটি সাধারণ উপহার বা একটি মাত্র ফুল দিয়ে হলেও পরিবারের প্রতি আপনার ভালোবাসা, হৃদ্যতা, প্রাণবন্ততা ও হৃদয়ের প্রসন্নতা তুলে ধরুন। পরিবার হচ্ছে সুস্থ সমাজ ও সুস্থ মনোজগৎ গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান ভিত্তি। প্রাত্যহিক জীবনের নানা সংকট ও ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে একজন স্বামী বা স্ত্রী যখন ঘরে ফিরে আসেন তখন পারিবারিক পরিবেশ তাকে দেয় সজীবতা ও সংকট উতরে যাওয়ার জন্য সংগ্রামের প্রেরণা। আরেকটি নতুন দিন তার জন্য আশার আলো হয়ে সামনে আসে পরিবারের সুবাদে।
অন্য কথায় পরিবার যদি হয় প্রশান্তির আলো তাহলে তা কর্মজগতেও মানুষের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়স্থল। দুঃখ-বেদনা দূর করার ও আত্মিক প্রশান্তি লাভের এই আশ্রয়স্থল গড়া তথা বিয়ে করা ও পরিবার গঠনের প্রথা তাই এক অনন্য খোদায়ি নেয়ামত।
ইরানের জাতিগুলোর মধ্যে ফার্সিভাষী ফার্স জাতির পরেই সবচেয়ে বড় জাতি হল অযেরি জাতি। এ জাতির ভাষা হল অযেরি-তুর্কি ভাষা। ইরানের ইতিহাসের সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ও ঘটনায় তারা বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছেন। তাদের বসবাসের এক বিশাল অংশই পর্বতসঙ্কুল ও জঙ্গলাকীর্ণ। এইসব অঞ্চলে শীতকালে তীব্র শীত পড়ে এবং বসন্তকালে ও গ্রীষ্মকালে সবুজ বনানী আর ফুলের সমারোহ সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা তুলে ধরে। অযেরিদের পরিবার-ব্যবস্থা বেশ সুদৃঢ়। বাবা ও মা সাধারণত তাদের পরিবারগুলোর শীর্ষ সদস্য। তবে কোনো কোনো অযেরি পরিবারে দাদা ও দাদীও সসম্মানে পুত্র বা সন্তানদের সঙ্গে বসবাস করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিতা বা বড় ছেলেই হলেন অযেরি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে প্রধান সিদ্ধান্ত-দাতা। সন্তানরা অযেরি পরিবারে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকেন যা তাদের জন্য নানা সংকট উৎরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে ।
অযেরিদের বেশিরভাগ বিয়ে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই ঘটে থাকে। ফলে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর বাঁধন আরও মজবুত ও বহুমুখী হয়। পারিবারিক সম্পর্কগুলো রক্ষার কাজে ঘরের নারীরাই বেশি সক্রিয় এবং তারাই বেশিরভাগ বিয়ের অনুষ্ঠান, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও মেহমানদারির কাজ পরিচালনা করেন। অতীতে অযেরিদের প্রধান পেশা ছিল কৃষি ও পশু-পালন নির্ভর। তাই পুত্র সন্তান বেশি গুরুত্ব পেত অর্থনৈতিক চাহিদার দিক থেকে। তবে তারা কন্যা সন্তানকেও জীবনের লাবণ্য বলে মনে করতেন ও কন্যা ছাড়া সংসারকে শ্রীহীন বা নিরানন্দময় মনে করতেন। অযেরিদের বীরত্ব গাথায় নারীর স্থান রয়েছে পুরুষের সমান পর্যায়ে এবং মায়ের প্রতি সম্মানকে খোদার প্রতি সম্মান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য কথায় কন্যা সন্তানের জন্মকে তারা পুত্র সন্তান জন্মের চেয়ে কম আনন্দদায়ক মনে করতো না। অযেরি নারী ও কন্যারা তির নিক্ষেপ, ঘোড়া চালনা ও অন্যান্য ক্রীড়ায় পুরুষের চেয়ে কম দক্ষ নন। অযেরি তুর্কি অঞ্চলের একটি প্রবাদে বলা হয়: সিংহ তো সিংহই! এর নারী ও পুরুষে প্রভেদ নেই।
তুর্কি জাতিগুলোর মধ্যে নারীরা স্বাধীনতা, সাহসিকতা, দৃঢ়তা, অধিকার-প্রাপ্তি এবং স্ত্রী ও মা হিসেবে সর্বোচ্চ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। তুর্কি রূপকথাগুলোতে কন্যাকে কখনও লাল আপেল ও কখনওবা উজ্জ্বল স্বর্ণের টুকরো হিসেবে তুলনা করা হয়েছে।পূর্ব আযারবাইজানের জনগণের কাছে বিয়ে অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানজনক বিষয়। তাই তারা বিয়ের উৎসবগুলোকে যত বেশি সম্ভব জাঁকজমকপূর্ণ ও সুন্দর করতে চায়। অযেরিদের প্রথা হল ছেলে নিজে অথবা ছেলের মা ও বোন কনে নির্বাচন করবে। উপযুক্ত পরিবারের কন্যা নির্বাচনের পর্ব শেষ হলে আসে প্রস্তাব উত্থাপনের আনুষ্ঠানিকতা। এ অনুষ্ঠানে থাকে সঙ্গীত বা গানের পর্ব। কন্যা পক্ষ সম্মতি দিলে আনন্দ ও উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। উভয়পক্ষের বয়স্ক ব্যক্তিরা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের উপায় ও নানা দিক নিয়ে কন্যার বাসায় বৈঠক ও মত-বিনিময় করেন। উভয়পক্ষের সম্মতির পর বর পক্ষের আনা জমাটবাধা চিনির একটি বড় শিলা ওই পক্ষের একজন বয়স্ক ব্যক্তি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করেন। মাঝারি লাউ সাইজের ওই চিনির শিলার চৌখা অংশের টুকরো যিনি কন্যার মাকে দেন তিনি তার কাছ থেকে উপহার পান।
বাগদান পর্ব শেষ হলে বিয়ের আকদ্ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি হিসেবে নানা রংয়ের কাপড় ও কনের জন্য সোনার গয়নাগাটি কেনা হয়। বিয়ের আক্দ্ পড়ার সময় কনের প্রায় সমবয়সী অবিবাহিতা মেয়েরা একটি সাদা কাপড় বর ও কনের মাথার ওপর রেখে তাতে চিনির বড় বড় টুকরোকে পরস্পরের সঙ্গে ঘষে চিনির গুড়া ফেলেন। এই কাজ হল বর-কনের দাম্পত্য জীবন সুমিষ্ট ও দীর্ঘ হওয়ার প্রত্যাশার প্রতীক। এ সময় স্থানীয় আনন্দ সঙ্গীত গাওয়া হয়। ইরানের আযারবাইজানের গ্রামগুলোতে নববর্ষ শুরুর আগে বছরের শেষ বুধবারে বর তার কোমরের একটি শাল বা মাফলার জাতীয় কাপড় কনের বাড়ির ছাদে আলো-প্রবেশের কোনো ফাঁকা স্থানে ঝুলিয়ে দেন। আর কনের পরিবারের সদস্যরা সেখানে নানা উপহার বেঁধে দেন। এটি বেশ জনপ্রিয় ও সুন্দর প্রথা হিসেবে বিবেচিত। বিয়ের দিন বর ও কনের পরিবারে আনন্দের জোয়ার সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা দেয়। বরের বিয়ের পোশাক পরা ও সাজ-সজ্জা শেষ হলে একটি ভেড়া কুরবানি করে এর গোশত পাকিয়ে রাতে মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয়। রাতের খাবার শেষে শুরু হয় প্রথাগত অযেরি নাচ। নাচ ও গানের আসরে উপহার হিসেবে টাকা ছুঁড়ে দেয়া হয় এবং সেসব জমা করে বরকে দেয়া হয়।
মরহুম অধ্যাপক আল্লামা মুহাম্মাদ তাক্বি জাফরি ছিলেন খ্রিস্টিয় গত শতকের একজন বড় ইরানি আলেম ও দার্শনিক। তিনি ১৯৯৮ সনে ৭৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ইরানি অযেরি এই মনীষী এ যুগে সফল দাম্পত্য জীবনের এক অনুকরণীয় আদর্শ। জ্ঞান-গবেষণায় ব্যাপক ব্যস্ততার কারণে তিনি পরিবারকে কম সময় দিতেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এ জন্য কখনও স্বামীর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন না এবং এ বিষয়ে তাঁর জন্য ভাবনা ও উদ্বেগ সৃষ্টির কারণ হননি। আর তাই জনাব জাফরি তাঁর প্রতি ছিলেন বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল। আর কথাবার্তা ও আচরণে তিনি এই কৃতজ্ঞতা ফুটিয়ে তুলতেন। পারিবারিক কাজেকর্মে বা কথোপকথনে কখনও অতি সামান্য ভুল-বোঝাবুঝি হলে তিনি স্ত্রীর কাছে কিছুক্ষণ পরই ক্ষমা চাইতেন। স্ত্রীর যে তিনটি গুণ তাঁকে স্ত্রীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ও অনুরাগী করেছিল সেসব হল: প্রথমত তাঁর স্ত্রী আযানের পরপরই নামাজ আদায় করতেন, দ্বিতীয়ত নানা সমস্যার সময় তিনি ধৈর্যশীল ছিলেন ও তৃতীয়ত মেহমানদের খুব সযত্নে আপ্যায়ন করতেন। জনাব জাফরিও এমনভাবে তার পড়াশুনা ও গবেষণায় লিপ্ত হতেন যাতে পারিবারিক বিষয় ও কাজের ক্ষতি না হয়। অন্য কথায় জনাব জাফরি ও তার স্ত্রী সব কাজ যথাসময়ে করতেন বলে তাদের পারিবারিক জীবনে কখনও সমস্যা দেখা দেয়নি। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।