এপ্রিল ০২, ২০২৩ ১৯:৩৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠান কুরআনের আলোর এ পর্বে সূরা আন নাজম-এর ৩১ থেকে ৪২ নম্বর আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩১ থেকে ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

(31) الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلَّا اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ هُوَ أَعْلَمُ بِكُمْ إِذْ أَنْشَأَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَإِذْ أَنْتُمْ أَجِنَّةٌ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى (32) أَفَرَأَيْتَ الَّذِي تَوَلَّى

“আর আসমানসমূহে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে তা আল্লাহরই; যাতে তিনি মন্দ কর্মশীলদেরকে তাদের কাজের শাস্তি দিতে পারেন এবং যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকে দিতে পারেন সর্বোত্তম পুরস্কার।” (৫৩:৩১)

“যারা বিরত থাকে গুরুতর পাপ ও প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ থেকে, অনাকাঙ্ক্ষিত অপরাধ ব্যতীত৷ নিশ্চয় আপনার রবের ক্ষমা অপরিসীম। তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত—যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্ৰূণরূপে ছিলে। অতএব তোমরা নিজেদের ত্রুটিমুক্ত মনে করো না [এবং আত্মপ্ৰশংসা করো না], তিনিই তাকওয়া অবলম্বনকারীদের সম্পর্কে ভালো জানেন।” (৫৩:৩২)

এই দুই আয়াতে আল্লাহ তায়ালার শাস্তি ও পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থাপনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে: যে আল্লাহ আসমানসমূহ ও পৃথিবীর স্রষ্টা তিনি মানুষকে তার ইচ্ছেমতো চলার স্বাধীনতা দিয়ে ছেড়ে দেননি। বরং তিনি এমন একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছেন যার ফলে সৎকর্মশীলরা তাদের কাজের পুরস্কার ও মন্দ কর্মশীলরা তাদের কাজের শাস্তি পেতে পারে। অবশ্য সব মন্দ কাজের ধরন এক রকম নয়। কোনোটি বড় বা কবিরা গুনাহ এবং কোনোটি ছোট বা সগিরা গুনাহ। কোনো গুনাহের কাজ মানুষ ইচ্ছাকৃত ও পূর্বপরিকল্পিতভাবে করে এবং কোনো কোনো গুনাহ অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই ধরনের গোনাহের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা একই ধরনের শাস্তি দেবেন না।

যে গোনাহ অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায় বান্দা তা করার জন্য অনুতপ্ত হয় এবং তার পুনরাবৃত্তি করবে না বলে আল্লাহর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এটিকে তওবা বলে। তওবা করলে আল্লাহ তার বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে গোনাহ করে বারবার তার পুনরাবৃত্তি করতে থাকলে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা যায় না। এই দুই আয়াতে আরো বলা হয়েছে, তোমরা যদি সৎকাজ করতে পারো এবং প্রকাশ্য গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে পারো তাহলে সমাজে নিজেদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করবে না। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অন্তরের খবর জানেন এবং প্রকৃতপক্ষে কে সৎকর্মশীল তা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- এই বিশ্বজগত মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।

২- ভালো ও সৎকর্মশীল মানুষের দ্বারাও যেকোনো সময় গোনাহের কাজ হয়ে যেতে পারে। তবে তাদের অন্তর পবিত্র বলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে গোনাহ করেন না এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে গোনাহের পথ থেকে ফিরে আসেন।

৩- আমরা যেন কখনোই নিজেদেরকে ত্রুটিমুক্ত মনে না করি এবং অহংকারে লিপ্ত না হই। প্রকাশ্যে মানুষের সামনে হয়তো আমরা গোনাহ করছি না কিন্তু আমাদের অন্তরে কলুষতা আছে কিনা সে খবর আল্লাহ তায়ালা ভালো করে জানেন।

এবারে সূরা নাজমের ৩৩ থেকে ৩৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

33) وَأَعْطَى قَلِيلًا وَأَكْدَى (34) أَعِنْدَهُ عِلْمُ الْغَيْبِ فَهُوَ يَرَى (35) أَمْ لَمْ يُنَبَّأْ بِمَا فِي صُحُفِ مُوسَى (36) وَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى (37) أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى(38) وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى

সুতরাং আপনি কি দেখেছেন সে ব্যক্তিকে যে [সত্য থেকে] মুখ ফিরিয়ে নেয়?” (৫৩:৩৩)

“এবং দান করে সামান্যই, পরে বন্ধ করে দেয়?”(৫৩:৩৪)

“তার কাছে কি গায়েবের জ্ঞান আছে যে, সে প্রত্যক্ষ করে [ভবিষ্যতে কি হবে]?”(৫৩:৩৫)

“তাকে কি অবগত করা হয়নি যা আছে মূসার কিতাব তাওরাতে?”(৫৩:৩৬)

“এবং ইবরাহীমের সহীফায়, যিনি পূর্ণ করেছিলেন [তার অঙ্গীকার]?”(৫৩:৩৭)

“তা এই যে, কেউ অন্যের [গোনাহের] বোঝা বহন করবে না।”(৫৩:৩৮)

আগের আয়াতগুলোতে মানুষের কৃতকর্মের জবাবদিহির কথা বলা হয়েছে। এরপর এই ছয় আয়াতে একই বিষয় ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: কেউ কেউ মনে করে, তারা কিয়ামতের দিন নিজেদের গোনাহের বোঝা অন্যে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে মুক্তি পেয়ে যাবে। এ ধরনের মানুষ একদিকে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তকে দান করার দায়িত্ব পালন করে না বরং কৃপণতা করে। অন্যদিকে নিজেদের সকল অপকর্মের দায় বিভিন্ন অজুহাতে অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়।

অথচ সকল ঐশী ধর্মের একটি মূলনীতি হচ্ছে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের কৃতকর্মের জন্য দায়ী। টাকাপয়সা খরচ করা বা অন্য কোনো উপায়ে নিজের পাপকাজের দায় অন্যের ওপর চাপানোর কোনো সুযোগ আল্লাহর দরবারে নেই।

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- দরিদ্রকে দান-খয়রাত করা একটি চলমান প্রক্রিয়া, এটি থামিয়ে দেওয়া যাবে না। মাঝেমধ্যে দানখয়রাত করা বা হাতে টাকাপয়সার আমদানি বেশি হলে কিছু দান করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় দান করতে হবে।

২- দান করা ও আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার আদর্শ হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। তিনি আল্লাহর প্রতি নিজের অঙ্গীকার পূরণ করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে উৎসর্গ করেন।

৩- যারা পাপকাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং বলে তোমার পাপকাজের দায় আমার- আমরা যেন তাদের প্রতারণার শিকার না হই। কারণ, আল্লাহর বিধানে কেউ অপরের পাপকাজের দায় গ্রহণ করতে পারে না।

এবারে সূরা নাজমের ৩৯ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(39) وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى (40) ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَى (41) وَأَنَّ إِلَى رَبِّكَ الْمُنْتَهَى (42) وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَأَبْكَى

“আর তা এই যে, মানুষ যা পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে তাছাড়া কিছুই পায় না।” (৫৩:৩৯)

“আর তা এই যে, তার চেষ্টা সাধনার [ফল] শীঘ্রই তাকে দেখানো হবে।”(৫৩:৪০)

“তারপর তাকে দেয়া হবে এর পূর্ণ প্রতিদান।”(৫৩:৪১)

“আর তা এই যে, [সবকিছুর] সমাপ্তি তো তোমার প্রতিপালকের নিকট।”(৫৩:৪২)

সকল ঐশী ধর্মের আরেকটি বিধান হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ন্যায়বিচার। যে ব্যক্তি তার দ্বীনি দায়িত্ব পালনে যতটা সচেষ্ট হবে কিয়ামতের দিন সে ততটা প্রতিদান লাভ করবে। পার্থিব জীবনেও মানুষ তার প্রচেষ্টার মাত্রা অনুযায়ী বৈষয়িক উন্নতি লাভ করবে। নিজের পাপের দায় যেমন অন্যের কাঁধে চাপানো যাবে না তেমনি অপরের সৎকাজের প্রতিদান নিজের দিকে টেনে আনা যাবে না।

তবে সৎকাজের জন্য প্রচেষ্টা চালানো সত্ত্বেও কেউ যদি পার্থিব জীবনে কাঙ্ক্ষিত ফল না পায় তাহলে সে যেন হতাশ না হয়। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তার আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখেছেন এবং তিনি ওই ব্যক্তির সৎকর্মের পূর্ণ প্রতিদান কিয়ামত দিবসে মিটিয়ে দেবেন।

এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- ঐশী বিধিবিধান পালনের জন্য চেষ্টা চালানো আমাদের কর্তব্য। কিন্তু এর ফলাফল দানের মালিক আল্লাহ। কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসুক বা না আসুক আমাদেরকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।

২- বিশ্বজগতে কোনো আমলই হারিয়ে যায় না। কিয়ামত দিবসের বিচারের দিন যেকোনো আমলের পুরস্কার ও শাস্তি পাওয়ার বিধানের প্রতি বিশ্বাস থাকলে মানুষ যেমন ভালো কাজে উৎসাহিত হয় তেমনি সে মন্দ কর্ম করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকে।

৩- পার্থিব জগতে একজন মানুষের সব কর্মের পুরস্কার ও শাস্তি দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই এমন একটি জগত থাকা প্রয়োজন যেখানে মানুষের সব কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া সম্ভব; আর সেটিই হলো পরকাল।

৪- মহান আল্লাহ আমাদের কর্মসমূহ প্রত্যক্ষ করছেন এবং তিনি এসব কাজের লক্ষ্য ও প্রচেষ্টা বিবেচনা করে তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান দেবেন।

৫- যদি কিয়ামত দিবস এবং সেই দিবসে আল্লাহর মুখোমুখি হওয়ায় আমাদের বিশ্বাস থাকে তাহলে আমরা যেন সৎকাজে কার্পণ্য না করি বিশেষ করে দান-খয়রাত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।