এপ্রিল ০৪, ২০২৩ ১৫:০৩ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।  গত আসরে আমরা সূরা নাজ্‌মের আলোচনা শেষ করেছি। আজ আমরা পবিত্র কুরআনের পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা কামার নিয়ে আলোচনা শুরু করব।  এই সূরাটিও কাফির ও মুশরিকদের সতর্ক করার জন্য মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের দাওয়াতের বাণীর বিপরীতে অতীত জাতিগুলোর অবাধ্যতা ও পরিণতিতে তাদের ধ্বংস বর্ণনা করা হয়েছে।

মহানবী (সা.)-এর জামানার কাফিররা যাতে অতীত জাতিগুলোর পরিণতি শুনে অবাধ্যতা পরিত্যাগ করে সত্য গ্রহণে সম্মত হয় সেজন্য এসব সত্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আজকের আসরে আমরা এই সুরার ১ থেকে ৮ পর্যন্ত আয়াতের অর্থ এবং শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।  

প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ (1) وَإِنْ يَرَوْا آَيَةً يُعْرِضُوا وَيَقُولُوا سِحْرٌ مُسْتَمِرٌّ (2) وَكَذَّبُوا وَاتَّبَعُوا أَهْوَاءَهُمْ وَكُلُّ أَمْرٍ مُسْتَقِرٌّ (3) وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنَ الْأَنْبَاءِ مَا فِيهِ مُزْدَجَرٌ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”

“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে এবং চন্দ্র খন্ডিত হয়েছে।” ( ৫৪:১)

“এবং [কাফিররা] যখন কোন মুজিযা দেখে, তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় আর বলে- ‘এটা তো সেই আগে থেকে চলে আসা চিরাচরিত যাদু।’” ( ৫৪:২)

“আর তারা [আপনার ও কুরআনের প্রতি] মিথ্যারোপ করে এবং নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে।  অথচ প্রতিটি বিষয়ই শেষ লক্ষ্যে পৌঁছাবে [এবং আপনার রিসালাতের সত্যতা প্রমাণিত হবে]।” ( ৫৪:৩)

সূরা কামারের এই প্রথম আয়াতগুলোতে ইসলামের নবীর বিশাল মুজিযাগুলোর একটি বর্ণিত হয়েছে।  মক্কার মুশরিকরা রাসূলের দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করার জন্য এমন একটি পূর্বশর্ত নির্ধারণ করে দিয়েছিল যা তাদের দৃষ্টিতে বাস্তবায়ন করা ছিল রাসূলের পক্ষে অসম্ভব। তারা বলেছিল: তুমি যদি সত্যিই আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকো তাহলে আকাশের চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখাও! তারা ভেবেছিল ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন জিনিসের ওপর যাদুর প্রভাব খাটানো যায় কিন্তু আসমানে যাদুর কোনো প্রভাব নেই। যদি মুহাম্মাদ (সা.) চাঁদকে দ্বিখণ্ডিত করে দেখাতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে এটি যাদু নয়। এ সময় আল্লাহর রাসূল কাফিরদের দাবি পূরণ করে দেয়ার জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন জানান। মহান আল্লাহ তাঁর দরখাস্ত কবুল করেন এবং পূর্ণিমার এক রাতে রাসূলের আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। মক্কার সব মানুষ এই দৃশ্য অবলোকন করার পর চাঁদ আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

কাফিররা কখনও এমন দৃশ্য দেখার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্বের বশবর্তী হয়ে তারা দাবি করে, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়নি বরং নবী তাদের চোখগুলোকে এমনভাবে যাদু করেছেন যার প্রভাবে তারা চাঁদকে দ্বিক্ষণ্ডিত হতে দেখেছে।

তবে কাফিররা যাই বলুক, প্রকৃতপক্ষেই সেই রাতে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল। শুধু মক্কা শহরের মানুষ নয় সেই রাতে ইয়েমেন ও সিরিয়া থেকে আগত যাত্রীরা পথিমধ্যে চাঁদের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য দেখেছে। এমনকি কথিত আছে, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষও সেই রাতে চাঁদের দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করেছে। পবিত্র কুরআনের এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে, কাফিররা তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করার কারণে এমন চাক্ষুষ সত্য অস্বীকার করতে পেরেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই যেদিন কাফিরদের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়বে।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- কিয়ামত একটি অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতা এবং তা নিকটবর্তী। যারা কিয়ামত দিবসের হিসাব-নিকাশকে অস্বীকার করে এটি তাদের জন্য সতর্কবার্তা। শেষ নবীর আগমন কিয়ামত ঘনিয়ে আসার অন্যতম আলামত।

২- পবিত্র কুরআন ছিল মহানবী (সা.)-এর প্রধান মুজিযা। এছাড়া, তিনি আরো অনেক মুজিযা দেখিয়েছেন যার অন্যতম হলো চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা।

৩- অবাধ্য ও উদ্ধত মানুষেরা নিজ চোখে মুজিযা দেখা সত্ত্বেও তাকে যাদু অভিহিত করতে দ্বিধা করে না এবং রিসালাতের সত্যতা প্রত্যাখ্যান করে।

এবারে সূরা কামারের ৪ ও ৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(4) حِكْمَةٌ بَالِغَةٌ فَمَا تُغْنِ النُّذُرُ (5) فَتَوَلَّ عَنْهُمْ يَوْمَ يَدْعُ الدَّاعِ إِلَى شَيْءٍ نُكُرٍ

“আর নিঃসন্দেহে তাদের কাছে এসেছে [অতীত জাতিগুলোর] সংবাদসমূহ, যাতে আছে [কুফর থেকে বিরত থাকার] কঠোর নিষেধাজ্ঞা।” ( ৫৪:৪)

“[যদিও এসব খবর ছিল] সুস্পষ্ট হিকমত, কিন্তু সেই সতর্কবাণী [উদ্ধত লোকদের] কোন কাজে আসেনি।”( ৫৪:৫)

এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: শত্রুরা অজ্ঞতার কারণে রাসূলের দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করেছে- বিষয়টি এমন নয়।  অতীত জাতিগুলো কীভাবে আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে সেকথা তাদের ভালো করে জানা আছে। এছাড়া, তারা অতীতের ঐশী ধর্মের অনুসারীদের কাছে থেকে একথা শুনেছে যে, মৃত্যুর পরে কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সেখানে বিচার শেষে একদলকে জান্নাতে এবং আরেক দলকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও তারা পাপকাজ থেকে বিরত থাকেনি। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে সত্য প্রকাশ করা। কিন্তু বহু মানুষ এসব সতর্কবাণীতে ভ্রুক্ষেপ করেনি।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস অধ্যয়ন করলে মানুষ প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধ্বংসের কারণ জানার পাশাপাশি কুফর, জুলুম ও গোনাহের হাত থেকে বেঁচে থাকতে পারে।

২- পবিত্র কুরআনের বাণীগুলো যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি-ভিত্তিক। বেশিরভাগ মানুষই তাদের বিবেক দিয়ে এই বাণীর সারমর্ম উপলব্ধি করতে পারে।

৩- মহানবী (সা.) তাঁর রিসালাতের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব সমাপ্ত করেছেন। তবে তিনি কাউকে দাওয়াতের বাণী মানতে বাধ্য করেননি। মানুষকে এই বাণী গ্রহণ করতে হবে স্বেচ্ছায়।

এবারে সূরা কামারের ৬ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

(6) خُشَّعًا أَبْصَارُهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ كَأَنَّهُمْ جَرَادٌ مُنْتَشِرٌ (7) مُهْطِعِينَ إِلَى الدَّاعِ يَقُولُ الْكَافِرُونَ هَذَا يَوْمٌ عَسِرٌ (8) كَذَّبَتْ قَبْلَهُمْ قَوْمُ نُوحٍ فَكَذَّبُوا عَبْدَنَا وَقَالُوا مَجْنُونٌ وَازْدُجِرَ

“অতএব, আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন! [এবং অপেক্ষা করুন সেদিনের] যেদিন আহ্বানকারী [তাদেরকে] আহবান করবে এক অজানা ভয়াবহ পরিণামের দিকে।” ( ৫৪:৬)

“[ভয় ও শঙ্কায়] অবনমিত নেত্রে তারা তাদের কবর থেকে বের হয়ে আসবে- মনে হবে যেন তারা বিক্ষিপ্ত পঙ্গপাল।”( ৫৪:৭)

“তারা আহবানকারীর দিকে ছুটে আসবে ভীত-বিহ্বল হয়ে।  কাফিররা বলবে, ‘বড়ই কঠিন এ দিন’!”( ৫৪:৮)

কাফিরদের চরম গোঁয়ার্তুমি ও ঔদ্ধত্ব বর্ণনা করার পর এই আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আপনি এসব অবাধ্য লোককে পরিত্যাগ করে তাদের কাছে যান যারা দাওয়াতের বাণী মেনে নিতে প্রস্তুত। অবাধ্য লোকগুলো সেদিন সত্য উপলব্ধি করবে যেদিন নিজ চোখে কিয়ামতের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করবে। যেদিন আল্লাহর নির্দেশে মৃত মানুষেরা কবর থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসবে এবং ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় নির্দিষ্ট দিকে দৌড়াতে থাকবে। কিয়ামতের এই দিনটিকে তারা পার্থিব জগতে বিশ্বাস করত না বলে তাদের জন্য সেদিন হবে অজানা-অচেনা দিন। যেকোনো শব্দ শুনলে তারা সেদিকে দৌড়াতে শুরু করবে এমন কিছু শোনার আশায় যাতে তাদের হৃদয় শান্ত হয়। কিন্তু উল্টো যতই তারা ছুটবে ততই তাদের পেরেশানি বেড়ে যাবে এবং তারা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করত শুরু করবে যে, এই হচ্ছে সেই দিন যেদিনের কথা দুনিয়াতে তাদেরকে বারবার বলা সত্ত্বেও তারা অস্বীকার করেছিল।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- কাফিরদের কাছে দাওয়াতের বাণী পৌঁছে দেয়ার পর তাদের থেকে দূরে সরে যেতে হবে যাতে তারা একথা না ভাবে যে, তাদের ঈমান আনায় আমাদের কোনো স্বার্থ আছে যা অর্জনের জন্য আমরা তাদের সঙ্গে আঠার মতো লেগে আছি।

২- কাফির ও পাপী ব্যক্তিদের জন্য কিয়ামতের আলোচনা ভীতিকর। তারা কখনও কল্পনাও করতে পারে না তাদেরকে এমন একটি দিনের মুখোমুখি হতে হবে।

৩- এই আয়াত অনুযায়ী কিয়ামত হবে সশরীরে এবং মানুষ মাটির নীচ থেকে জেগে উঠবে।  কিয়ামত শুধু রুহের জগতে হবে বলে কেউ যেন ভুল না করে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।

 

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।