‘সোনার খাঁচায় ময়না পাখি’ (১)
এক বাদশার সাত ছেলে ছিল। অনেক আগের কথা। ছয় ছেলে ছিল এক মায়ের সন্তান। বাকি এক সন্তান ছিল অন্য মায়ের। বাদশা ওই ছেলের নাম রাখলো মালেক মুহাম্মাদ। এক রাতে বাদশা তাঁর প্রাসাদে আরামে ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুমের ভেতর চমৎকার এক স্বপ্ন দেখেন তিনি।
স্বপ্নটা হলো: বাদশার মাথার ওপরে ঝুলছে একটি সোনার খাঁচা। খাঁচার ভেতর বসে আছে চমৎকার একটা তোতা পাখি। ঘুম ভেঙে যাবার পর বাদশা চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবছিলো এই সোনার খাঁচার মানে কী কিংবা ওই তোতা পাখিরই বা কী অর্থ। অর্থ যা-ই হোক বাদশা কিন্তু ওই তোতা পাখির প্রেমে পড়ে গেছে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর থেকেই ভাবতে শুরু করেছে কী করে ওই তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা হাতে পাওয়া যায়।
অপরদিকে বাদশা কিছুদিন থেকেই ভাবছিল বাদশাহির দায়িত্ব কোনো এক ছেলের হাতে সোপর্দ করবে যাতে তার অবর্তমানে বাদশাহি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না দেখা দেয়। স্বপ্ন দেখার পর বাদশা ভাবলো:ভালোই হলো। এবার সাত সন্তানকেই পরীক্ষা করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সাত সন্তানের মধ্যে যে সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে তার হাতে বাদশাহীর দায়িত্ব দিয়ে দেবে। বাদশা তাই তাঁর সাত সন্তানকেই ডেকে পাঠালো। সন্তানরা সবাই এসে পৌঁছলে বাদশা তাদের উদ্দেশে বললো: তোমরা সবাই আমার সন্তান। আমি তোমাদের সবাইকেই এক দৃষ্টিতে মানে সমানে চোখে দেখি। আমি বুঝতে পারছি না তোমাদের মধ্য থেকে কার হাতে এই বাদশাহির দায়িত্ব হস্তান্তর করবো। সেজন্যে তোমাদের সবাইকে একটা কাজ দেবো আমি। ওই কাজটা যে সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেবে তাকেই আমি আমার স্থলাভিষিক্ত করবো।
সবাই জানতে চাইলো: কাজটা কী!
বাদশা বললো: তোমরা আমার জন্য সোনার খাঁচায় বসে থাকা একটা তোতা পাখি নিয়ে আসবে। যে আনতে পারবে সে-ই হবে আমার পরবর্তী বাদশা।
একই স্ত্রীর পেটের ছয় ভাই বাদশার কথা শুনে উঠে দাঁড়ালো এবং একসাথে বেরিয়ে পড়লো সোনার খাঁচা আর তোতা পাখির সন্ধানে। অনেক দূর-দূরান্তে গেল তারা। শহর নগর গ্রাম গঞ্জ সবখানেই খুঁজলো। এমনকি নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশেও গেল। কত মানুষের কাছে যে জানতে চেয়েছে পথ কিংবা সোনার খাঁচা আর তোতা পাখির সন্ধান, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনো কাজেই আসে নি সেসব। অবশেষে খালি হাতেই ফিরতে হলো তাদের। ফিরে এসে বাদশাকে বললো: ‘হে বাদশা! আমরা সারা পৃথিবী ঘুরেছি,কিন্তু তুমি যে জিনিস চেয়েছো তা খুঁজে পাই নি’।
বলছিলাম ছয় ছেলে ফিরে এসে বাদশাকে তাদের অপারগতার কথা বললো। আর বাদশা মনে মনে ভাবলো: আমি কি এমনই কঠিন কোনো কাজ দিলাম ছেলেদেরকে যা করা তাদের জন্য অসম্ভব! এ রকম ভাবনার মাঝেই মালেক মুহাম্মাদ উঠে দাঁড়ালো এবং বললো: হে শ্রদ্ধেয় পিতা আমার! আপনি অনুমতি দিলে আমি ওই তোতা পাখি আর সোনার খাঁচার সন্ধানে যেতে চাই।
বাদশা বললো: ওরা ছয় জনই তোমার চেয়ে বড়। তারা একসাথে গিয়েও তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা আনতে পারলো না আর তুমি একা গিয়ে কী করবে?
মালেক মুহাম্মাদ বললো: আল্লাহ চাইলে আনতেও তো পারি!
বাদশা বললো: ঠিক যেতে চাচ্ছো যখন যাও! যদি আনতে পারো, তাহলে বাদশাহি তোমার হাতে সোপর্দ করবো।
মালেক মুহাম্মাদ সফরের প্রস্তুতি নিয়ে কটি মণিমুক্তা সঙ্গে নিলো। এরপর দ্রুতগামী একটি ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ছয় ভাইয়ের মধ্যে যে বড় সে ছিল ভীষণ হিংসুক। সে তার বাকি পাঁচ ভাইকে ডেকে বললো: আমি জানি মালেক মুহাম্মাদ তোতা পাখি আর সোনার খাঁচা আনতে পারবে। তাই চলো, ওর পেছনে পেছনে আমরাও যাই। বলা তো যায় না ও যদি আমাদের টেক্কা দিয়ে বসে! পাঁচ ভাই কথাটা মেনে নিলো এবং সবাই ঘোড়ায় চড়লো। যেতে যেতে একটা নির্জন প্রান্তরে গিয়ে মালেক মুহাম্মাদের নাগাল পেল। মালেক মুহাম্মাদকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে ছয় ভাই মিলে মারলো। মারতে মারতে মালেক ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মণিমুক্তাময় জিনটা তার মাথার পাশে রেখে দিলো যাতে মারা গেলে দাফন কাফনের ব্যবস্থা হয়। তারপর ছয় ভাইয়ের সবাই ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত পালিয়ে গেল যাতে কেউ তাদের দেখতে না পায়। মালেক মুহাম্মাদ সন্ধ্যা পর্যন্ত মাটিতেই পড়ে ছিল। সে ঘুমের ভেতর হযরত আলি (আ) কে স্বপ্নে দেখতে পেল।
আলী (আ) তাকে বলছিলো: হে যুবক! জেগে ওঠো! ভালো করে কোমর বাঁধো।
এতোক্ষণ পর্যন্ত মালেকের গোংরানোরও শক্তি ছিল না। অথচ স্বপ্ন দেখার পর সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো দাঁড়িয়ে গেল সে। স্বপ্নের ভেতরেই একরাশ বিস্ময় চোখে মেখে হযরতের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। হযরত আলি (আ) তাকে বললো: এর পর থেকে যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে তখনই বলবে: ‘ইয়া আলি’! তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ বলেই আলি (আ) অদৃশ্য হয়ে গেল।
মালেক মুহাম্মাদের ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখলো তার শরীরে কোনোরকম ব্যথা-বেদনা নেই। পুরোপুরি সুস্থ সে। এদিক সেদিক তাকালো। দেখলো তার ঘোড়া এবং জিন সব কিছুই ঠিক আছে। প্রশান্ত মনে দৃঢ় বিশ্বাস বুকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়লো এবং সতেজভাবে ঘোড়া ছুটালো।#