কুরআনের আলো
সূরা ক্বামার: আয়াত ৩৩-৪২ (পর্ব-৪)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা কামারের ৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা শুনেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ৩৩ থেকে ৪২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপনের চেষ্টা করব। প্রথমেই ৩৩ থেকে ৩৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(33) إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ حَاصِبًا إِلَّا آَلَ لُوطٍ نَجَّيْنَاهُمْ بِسَحَرٍ (34) نِعْمَةً مِنْ عِنْدِنَا كَذَلِكَ نَجْزِي مَنْ شَكَرَ (35) وَلَقَدْ أَنْذَرَهُمْ بَطْشَتَنَا فَتَمَارَوْا بِالنُّذُرِ
“লূত সম্প্রদায়ও প্রত্যাখ্যান করেছিল সতর্ককারীদেরকে।” (৫৪:৩৩)
“আমি তাদের উপর পাঠিয়েছিলাম প্রস্তরবর্ষী প্রচন্ড বাতাস, [যা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল] এবং আমি কেবল লূতের পরিবারকে রাতের শেষ প্রহরে উদ্ধার করেছিলাম।” (৫৪:৩৪)
“[এই উদ্ধার ছিল] আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, আমি এভাবেই তাকে পুরস্কৃত করে থাকি।” (৫৪:৩৫)
অতীতের যেসব জাতি নবীদের সতর্কবাণী না শোনার কারণে করুণ পরিণতির শিকার হয়েছে এই সূরায় তাদের কয়েকটির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সূরা কামারে বর্ণিত চতুর্থ জাতি হিসেবে লূত জাতির নাম এসেছে। এই জাতির পুরুষেরা সমকামিতার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিল যে, এই নোংরা কাজের পরিণতি সম্পর্কে তাদের নবী যত সতর্কবাণীই উচ্চারণ করুক না কেন তাতে কোনো ফল হচ্ছিল না। হযরত লূত (আ.) এর সাবধানবাণী শোনার পরিবর্তে তার উপদেশ যাতে আর শুনতে না হয় সেজন্য তারা তাঁকে তাদের শহর থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মহান আল্লাহ এ অবস্থায় ভয়ানক এক ঘুর্ণিঝড় প্রেরণ করেন যা মরুভূমি থেকে পাথর ও ধুলিকণা উৎক্ষেপণ করে নোংরা কর্মে লিপ্ত লূত জাতির উপর নিক্ষেপ করে। এর ফলে পাথর চাপা পড়ে ওই জাতির সব মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এই ভয়ানক আজাব পাঠানোর আগে হযরত লূত (আ.)কে আল্লাহ তায়ালা তার পরিবারের সদস্যসহ শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। নবীর স্ত্রী সমকামীদের সহযোগীতে পরিণত হয়েছিল বলে আল্লাহর নির্দেশে তাকে সঙ্গে নেননি হযরত লূত।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- যুগে যুগে নবী-রাসূলদের প্রধান দায়িত্ব ছিল মানুষকে তাদের খারাপ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ওই সতর্কবাণীতে কান দেয়নি।
২- আল্লাহ তায়ালার অমোঘ বিধান হচ্ছে আজাব নাজিল করার সময় ঈমানদার ব্যক্তিদের উদ্ধার করা।
৩- নবীর দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করে তাঁর নির্দেশাবলী মেনে চলাই হচ্ছে আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় করা। আর শোকর আদায়কারীদের জন্য এই পার্থিব জগতেই রয়েছে পুরস্কার।
এবারে এই সূরার ৩৬ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(36) وَلَقَدْ رَاوَدُوهُ عَنْ ضَيْفِهِ فَطَمَسْنَا أَعْيُنَهُمْ فَذُوقُوا عَذَابِي وَنُذُرِ (37) وَلَقَدْ صَبَّحَهُمْ بُكْرَةً عَذَابٌ مُسْتَقِرٌّ (38) فَذُوقُوا عَذَابِي وَنُذُرِ (39) وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآَنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ (40) وَلَقَدْ جَاءَ آَلَ فِرْعَوْنَ النُّذُرُ
“[লূত] আমার কঠোর পাকড়াও সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছিল, কিন্তু তারা সতর্কবাণীর বিষয়ে বাক বিতন্ডা শুরু করেছিল।” (৫৪:৩৬)
“আর তারা [অসদুদ্দেশ্যে চরিতার্থ করার লক্ষ্যে] লুতের কাছ থেকে তাঁর মেহমানদেরকে দাবি করল, তখন আমি তাদের দৃষ্টি শক্তি লোপ করে দিলাম [এবং বললাম], আস্বাদন করো আমার শাস্তি এবং ভীতির পরিণাম।” (৫৪:৩৭)
“আর প্রত্যুষে তাদের উপর বিরামহীন শাস্তি আঘাত করেছিল।” (৫৪:৩৮)
“সুতরাং আস্বাদন করো আমার শাস্তি এবং ভীতিপ্রদর্শনের পরিণাম।” (৫৪:৩৯)
“আর অবশ্যই আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি [শিক্ষা ও] উপদেশ গ্রহণের জন্য; অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” (৫৪:৪০)
হযরত লূত (আ.) তার জাতিকে তাদের জঘন্য অপকর্মের পরিণতির ব্যাপার সারাক্ষণ সতর্ক করে আসলেও তারা আল্লাহর আজাবের কথা বিশ্বাস করেনি বরং সন্দেহ পোষণ করেছে। এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা শেষ পরীক্ষা হিসেবে ফেরেশতাদেরকে সুদর্শন কিশোরদের বেশে হযরত লুতের বাড়িতে পাঠান। এ সময় লাম্পট্যের চরম সীমায় অধোঃপতিত কিছু মানুষ এসব অতিথিকে তাদের হাতে সমর্পন করার জন্য হযরত লুতের প্রতি আহ্বান জানায়।
আল্লাহর নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে এসব অসভ্য মানুষের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাদের পাশাপাশি তাদের সহচরদের কেউই এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি। উল্টো তারা হযরত লূত (আ.)কে হত্যা করতে উদ্যত হয়। আল্লাহ তায়ালা ভোররাতের দিকে নবীকে তার পরিবারসহ শহর থেকে সরিয়ে নেন এবং সকালবেলা ওই নিকৃষ্ট জাতিকে ধ্বংস করে দেন।
এই পাঁচ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালা প্রথমে নবীদের মাধ্যমে অপরাধীদের সতর্ক করেন এবং এরপর অস্বীকারকারীদের ধ্বংস করেন।
২- কোনো সমাজে যদি নোংরা কর্ম মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তাহলে ওই সমাজের পবিত্র ও ঈমানদার মানুষেরাও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পায় না।
৩- পবিত্র কুরআন কোনো ইতিহাসগ্রন্থ নয়। তবে এতে অতীতের জাতিগুলোর পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে যাতে বর্তমান যুগের মানুষের জন্য তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সত্য গ্রহণ করা সহজ হয়।
এবারে সূরা কামারের ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(41) كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا كُلِّهَا فَأَخَذْنَاهُمْ أَخْذَ عَزِيزٍ مُقْتَدِرٍ (42) أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِنْ أُولَئِكُمْ أَمْ لَكُمْ بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ
“আর অবশ্যই ফিরআউন সম্প্রদায়ের কাছে এসেছিল সতর্ককারীগণ।” (৫৪:৪১)
“[কিন্তু তারা] আমার সব মুজিযা বা নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, সুতরাং আমি মহাপরাক্রমশালী ও সর্বশক্তিমানরূপে তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” (৫৪:৪২)
এই সূরায় পঞ্চম যে জাতির ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে সেটির নাম ফেরাউনের জাতি। এই জাতি আল্লাহর পরিবর্তে ফেরাউনের উপাসনা করত এবং বিনা বাক্যব্যয়ে ফেরাউনের নির্দেশ পালন করত। ফেরাউনের জাতি বনি-ইসরাইল জাতিকে নিজেদের দাস ও বন্দি বানিয়ে রেখেছিল। তারা বনি ইসরাইলের উপর ভয়াবহ ও অকথ্য নির্যাতন চাপিয়ে দিয়েছিল।
হযরত মূসা (আ.) ফেরাউন ও তার পারিষদবর্গকে এক আল্লাহর ইবাদত করার এবং বনি ইসরাইল জাতিকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে দেয়ার আহ্বান জানাতে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। এ সময় তিনি আল্লাহর নির্দেশে ফেরাউন ও তার দরবারের লোকদের বেশ কয়েকটি মুজিযা প্রদর্শন করেন। কিন্তু মুজিযা দেখার পরও তারা কুফর ও জুলুম থেকে বিরত থাকেনি বরং হযরত মূসা ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের হত্যা করতে উদ্যত হয়। এ অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা অত্যাচারী ফেরাউন ও তার সম্প্রদায়কে নীল নদীতে ডুবিয়ে মারেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- অত্যাচারী ও দাম্ভিক শাসকদের আনুগত্য করলে ও তাদেরকে সমর্থন জানালে মানুষকে পার্থিব ও পরকালীন জীবনে ওইসব শাসকের অপরাধের অংশীদার হতে হবে।
২- মানুষকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিদর্শন হিসেবে মুজিযা দেখানো হয়। কিন্তু মুজিযা দেখার পরও যদি কেউ ঈমান গ্রহণ না করে তাহলে সে এই দুনিয়াতেই কঠোর আজাবের সম্মখীন হয়।
৩- এই বিশ্বজগতে একমাত্র অজেয় শক্তির অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। তার শক্তির তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের শক্তিও তুচ্ছ।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।