কুরআনের আলো
সূরা ক্বামার: আয়াত ৪৩-৫৫ (পর্ব-৫)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা কামারের ৪২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা শুনেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ৪৩ থেকে ৫৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপনের চেষ্টা করব। প্রথমেই ৪৩ থেকে ৪৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(43) أَمْ يَقُولُونَ نَحْنُ جَمِيعٌ مُنْتَصِرٌ (44) سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّونَ الدُّبُرَ (45) بَلِ السَّاعَةُ مَوْعِدُهُمْ وَالسَّاعَةُ أَدْهَى وَأَمَرُّ (46) إِنَّ الْمُجْرِمِينَ فِي ضَلَالٍ وَسُعُرٍ
“তোমাদের মধ্যে [মক্কাবাসী] কাফিররা কি ওইসব লোকের চেয়ে ভাল? নাকি কোনো আসমানী গ্রন্থে তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার সনদ আছে?” (৫৪:৪৩)
“নাকি তারা বলে, আমরা এক সংঘবদ্ধ অপরাজেয় দল? [এবং কোনো শক্তিই আমাদের পরাজিত করতে পারবে না। ]”(৫৪:৪৪)
“এই দল তো শীঘ্রই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালাবে।”(৫৪:৪৫)
“বরং কিয়ামত তাদের শাস্তির নির্ধারিতকাল আর সেদিন হবে কঠিনতর ও তিক্ততর।”(৫৪:৪৬)
সূরা কামারের শুরু থেকে এর আগের আয়াত পর্যন্ত অতীতের অবাধ্য ও পাপাচারী জাতিগুলোর পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতগুলোতে মক্কার মুশরিকদের উদ্দেশ করে বলা হয়েছে: তোমরা কেন অতীত জাতিগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মূর্তিপূজাসহ অন্যান্য নিকৃষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকছ না? তোমরা কি একথা ভাবছ যে, তোমরা অতীত জাতিগুলোর চেয়ে ভালো অথবা তাদের চেয়ে তোমাদের গুনাহের মাত্রা কম? নাকি তোমাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তাঁর আজাব থেকে বেঁচে যাওয়ার কোনো নিরাপত্তার গ্যারান্টি এসেছে?
নাকি তোমরা একথা ভাবছো যে, তোমরা এত বেশি শক্তিশালী হয়ে গেছো যে, তোমাদের মোকাবিলা করার শক্তি কারো নেই এবং তোমরা আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে পারবে? অথচ আল্লাহ চাইলে মুসলমানদের এই ক্ষুদ্র দলটির কাছে তোমরা পরাজিত হতে পারো। তোমাদের এই সুসংঘবদ্ধ শক্তি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে এবং তোমরা যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারো। এটি হবে পার্থিব জীবনে তোমাদের কর্মের পরিণতি। আর নিশ্চয় জেনে রেখো কিয়ামতের দিন আরো বেশি কঠিন ও দুর্বিসহ শাস্তি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আত্মম্ভরিতা ও অহংকার মানুষের পতন ও ধ্বংস ডেকে আনে।
২- নিজের বা অপরের শক্তি, সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতার ওপর যেন আমরা মোটেও ভরসা না করি। এর পরিবর্তে আমাদের উচিত আল্লাহ তায়ালার অবিনশ্বর শক্তির প্রতি পরিপূর্ণ নির্ভরশীল থাকা।
৩- কাফির ও জালিমদের পরাজয় মহান আল্লাহর সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি। কাফিররা যত শক্তিমত্তারই অধিকারী হোক না কেন তারা নিজেদের পতন ও ধ্বংস ঠেকাতে পারবে না।
এবারে সূরা কামারের ৪৭ থেকে ৫০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(47) يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ (48) إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ (49) وَمَا أَمْرُنَا إِلَّا وَاحِدَةٌ كَلَمْحٍ بِالْبَصَرِ (50) وَلَقَدْ أَهْلَكْنَا أَشْيَاعَكُمْ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ
“নিশ্চয় অপরাধীরা রয়েছে পথভ্রষ্টতা ও [পরকালে] প্রজ্জ্বলিত আগুনে। ” ৫৪:৪৭)
“যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; [এবং বলা হবে:] জ্বলন্ত আগুন ও জাহান্নামের কঠিন যন্ত্রণা আস্বাদন কর!”৫৪:৪৮)
“নিশ্চয় আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।”৫৪:৪৯)
“আমার আদেশ তো একটি কথায় নিষ্পন্ন হয়, চক্ষুর একটি পলকের মত।”৫৪:৫০)
আগের আয়াতগুলোতে পার্থিব জগতে বিভিন্ন জাতির পরিণাম বর্ণনা করার পর এই আয়াতগুলোতে তাদের পরকালীন পরিণতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে: পৃথিবীতে তারা সরল ও সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথসমূহ অনুসরণ করেছে। ফলে সারাজীবন তারা গুনাহ ও নাফরমানিতে লিপ্ত থেকেছে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের মানুষ কিয়ামতের দিন নিজের ইচ্ছায় জাহান্নামে যেতে চাইবে না। তখন আজাবের ফেরেশতারা তাদেরকে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের আগুনের মধ্যে ফেলবে। ফলে পৃথিবীতে তারা যে জাহান্নামকে অস্বীকার করত সেদিন তারা তাদের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে তা অনুভব করবে।
অবশ্য কিছু মানুষ পার্থিব জীবনের গোনাহের সঙ্গে পরকালের কঠিন শাস্তির যোগসূত্র খুঁজে পায় না বরং আল্লাহ তায়ালার এই বিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এ ধরনের সংশয়কারীদের প্রশ্নের উত্তরে পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: ঠিক যেভাবে পার্থিব জগতের সকল সৃষ্টি সুনির্দিষ্ট পরিমাণে ও পরিমাপে সৃষ্টি করা হয়েছে পরকালীন শাস্তিও নির্ধারিত রয়েছে সুনির্দিষ্ট মাত্রা ও পরিমাণে। কাজেই আল্লাহ তায়ালা যে বিচার করবেন সেখানে কারো প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম করা হবে না। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য বিষয়টি সবার পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনের চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকে অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হবে যাতে আমরা পরকালীন কল্যাণ পেতে পারি। তা না হলে আমাদেরকে ভ্রান্ত পথের অনুসারী হতে হবে যেখানে হতাশা ও অনুশোচনা ছাড়া আর কিছু থাকবে না।
২- পার্থিব জগতের সকল সৃষ্টি যেমন সুনির্দিষ্ট পরিমাপে ও সুচিন্তিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি পরকালীন জান্নাত ও জাহান্নামও আল্লাহ তায়ালার ন্যায়বিচার অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। সেখানকার বিচারে পুরস্কার ও শাস্তির বিষয়টিও পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে দেওয়া হবে।
এবারে এই সূরার শেষ পাঁচ আয়াত অর্থাৎ ৫১ থেকে ৫৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(51) وَكُلُّ شَيْءٍ فَعَلُوهُ فِي الزُّبُرِ (52) وَكُلُّ صَغِيرٍ وَكَبِيرٍ مُسْتَطَرٌ (53) إِنَّ الْمُتَّقِينَ فِي جَنَّاتٍ وَنَهَرٍ (54) فِي مَقْعَدِ صِدْقٍ عِنْدَ مَلِيكٍ مُقْتَدِرٍ (55)
“আমি অবশ্যই [অতীতে] ধ্বংস করেছি তোমাদের মত [কাফির] দলগুলোকে, অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?”৫৪:৫১)
“আর তারা যা কিছু করেছে, তার প্রত্যেকটাই আমলনামায় [লিপিবদ্ধ] আছে।”৫৪:৫২)
“আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সবকিছুই লিপিবদ্ধ।”৫৪:৫৩)
“নিশ্চয় মুত্তাকীরা থাকবে [জান্নাতের] বাগ-বাগিচা ও ঝর্ণাধারার মধ্যে।”৫৪:৫৪)
“যথাযোগ্য আসনে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মহা অধিপতি [আল্লাহর] সান্নিধ্যে।”৫৪:৫৫)
এই আয়াতগুলোতে সৎকর্মশীল ও গুনাহগারদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ ও হুঁশিয়ারি। বলা হচ্ছে, তোমরা জেনে রেখো, তোমাদের কোনো কর্মই আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানের বাইরে নয় বরং তোমাদের প্রতিটি ভালো ও মন্দ কর্ম তা যত ছোট বা যত বড়ই হোক না কেন, আমলনামায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।
কাজেই কিয়ামতের দিন ওই লিপিবদ্ধ আমলনামার ভিত্তিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুরস্কার ও শাস্তির প্রতিবিধান নিশ্চিত করা হবে। সৎকর্মশীলদের যেসব কর্ম শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে অপরের দৃষ্টির অগোচরে করা হয়েছে সেসব কর্মের পুরস্কার দেওয়া হবে। তাদেরকে মহামহিম আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে এমন উচ্চ মর্যাদা দান করা হবে যা তাদের পক্ষে দুনিয়াতে কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না।
এই পাঁচ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহর শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। একই রকম কর্ম সম্পাদনকারী জাতিগুলো একই রকম পরিণতি ভোগ করবে।
২- মহান আল্লাহ নিজে সবকিছু জানেন এবং তিনি হবেন কিয়ামতের বিচার দিবসের একচ্ছত্র অধিপতি; তারপরও তিনি বিচার করবেন মানুষের আমলনামার ভিত্তিতে। যে আমলনামা আল্লাহর আদেশেই সুচারুরূপে লিখে রেখেছেন ফেরেশতারা।
৩- জান্নাতের অধিবাসীদের জন্য যে শুধুমাত্র বস্তুগত পুরস্কার প্রদান করা হবে তাই নয়। বরং আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী অবস্থান করা এবং আম্বিয়া ও আউলিয়া আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করা হবে জান্নাতবাসীর আত্মিক পুরস্কার। এখানে তারা যে মানসিক তৃপ্তি লাভ করবে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।