মে ০৬, ২০২৩ ২০:১৭ Asia/Dhaka

উৎফুল্ল পরিবার মানে সুখের সোনালী নীড় তথা দ্রুত বেহেশতের সন্ধান লাভ। অন্যদিকে তালাক মানে বিচ্ছিন্নতা ও সংসার নামক সুখের আশ্রয়স্থলকে সাগরের উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে ও অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ভাসিয়ে দেয়া। 

গত পর্বে আমরা বিয়ের গুরুত্ব, তালাকের ইতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক দিক এবং বর্তমান যুগে তালাকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকার কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলাম। আজ আমরা তালাক সংক্রান্ত বিষয়ের আরও কয়েকটি দিক তুলে ধরব। 

তালাক ঘটনাক্রমিক কোনো ব্যাপার নয়। বহু বছরের জটিলতা, শীতল সম্পর্ক ও ভুল নীতির সম্মিলিত প্রক্রিয়ার পরিণতি হল তালাক। বর্তমান যুগে দুই ধরনের তালাক দেখা যায়: আনুষ্ঠানিক তালাক ও অনানুষ্ঠানিক তালাক। আনুষ্ঠানিক তালাক আদালতে সরাসরি ঘোষণা করা হয় এবং এর মাধ্যমে স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্কের অবসান ঘটে। তালাকের পর স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি আর কোনো অঙ্গীকার বা দায়িত্ববোধ থাকে না। 

দ্বিতীয় ধরনের তালাক তথা অনানুষ্ঠানিক তালাক হচ্ছে নীরব তালাক বা ঘোষণা-বিহীন শীতলতম সম্পর্ক।  দ্বিতীয় ধরনের তালাকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে স্বামী ও স্ত্রী একই ঘরে বা একই ছাদের নীচে বসবাস করছেন কিন্তু তাদের মধ্যে আবেগ-অনুভূতির সব বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেছে। নীরব তালাকের রয়েছে জটিল মানসিক ও সামাজিক দিকসহ   অনেক কারণ। স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরকে ভালোভাবে না জানা, ভুল বোঝাবুঝি, অবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক কারণও তালাকের সঙ্গে সম্পর্কিত। আজ আমরা মূলত নীরব তালাক ও এর পরিণতি সম্পর্কে কথা বলব। -স্বামী ও স্ত্রী যখন মনে করেন যে তাদের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন ও মাত্রা শূন্য হয়ে পড়েছে এবং কেবল ছেলে-মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে একই ঘরে বসবাস অব্যাহত রেখেছেন তখনই তা আসলে নীরব তালাক হিসেবে বিবেচিত। ছেলে মেয়েরা অবশ্য বুঝতে পারে যে তাদের বাবা ও মা আর আগের মত পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিক সুরে কথা বলেন না এবং পরস্পরকে এড়িয়ে চলেন ও খুব কম কথা বলেন; তারা যেন একই ঘরের অধিবাসী হয়েও পরস্পরের প্রতি অচেনা পথিকের মত হয়ে আছেন! অন্য কথায় তারা যেন অভ্যাসের বশেই একই ঘরে বসবাস করে যাচ্ছেন! এভাবেই একটি সংসার হয়ে পড়ে মরুভূমির মত নীরস ও পরিত্যক্ত ঘরের মতই শ্রীহীন! 

যদি স্বামী-স্ত্রী কথা বলা অব্যাহত রাখেন এবং পরস্পরকে কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকেন তাহলে সেই সংসারে বন্ধুত্ব ও ভালবাসা অব্যাহত থাকে। এ অবস্থায় তারা নীরব তালাকেরও শিকার হবেন না।  কিন্তু যদি তারা একে অপরকে খোঁচা দেয়া ও কটু কথা বলা এবং কষ্ট দেয়া অব্যাহত রাখেন তাহলে সংসারটিতে পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ বাড়তেই থাকবে। ফলে সংসারটি হয়ে পড়বে যুদ্ধক্ষেত্রের মত। এক সময় উভয়ই ক্লান্ত ও পরস্পরের প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ হয়ে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। 

মানুষের রুচি ও ভালো লাগা বা পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো এক ধরনের নয়। তাই স্বামী ও স্ত্রীও অনেক সময় পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকেন। আলোচনার মাধ্যমে তারা এ বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতায় উপনীত হতে পারেন। কিন্তু অনেক স্বামী-স্ত্রী কোনোভাবেই পরস্পরের সঙ্গে আপোষ বা সমঝোতায় উপনীত হতে পারেন না বরং তারা পরস্পরের ওপর নিজেদের পছন্দ বা রুচি জোর করে চাপিয়ে দিতে চান। অনেকেই কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া স্ত্রী বা স্বামীকে বকাঝকা করেন ও অকারণে বা প্রমাণ ছাড়াই নানা সমস্যার বিষয়ে একে-অপরকে দোষারোপ করেন! ফলে তাদের সম্পর্কে নেমে আসে শীতলতা তথা নীরব তালাকের পরিস্থিতি। 

স্বামী স্ত্রী যদি পরস্পরের প্রতি গঠনমূলক সমালোচনাও অশালীন ভঙ্গিতে, বিদ্রূপের সুরে বা উপহাসের ভঙ্গিতে করেন তাহলেও সম্পর্কে তিক্ততা দেখা দেয়। এ ধরনের আচরণের ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস জন্ম দেয় এবং এর ফলে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিও বাড়তে থাকে। 
নীরব তালাকের আরেকটি বড় কারণ হল পরপুরুষ বা দ্বিতীয় কোনো নারীর সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা কিংবা পরকিয়া সম্পর্ক। এ বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর অনেকে অনুতপ্ত হলেও বছরের পর বছর তা উভয় পরিবারের স্বামী বা স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 
স্বামী-স্ত্রীর অনানুষ্ঠানিক তালাক বা শীতলতম সম্পর্কের আরেকটি বড় কারণ হল ধর্মীয় বিশ্বাসের গভীরতার অভাব। দেখা গেছে পরকিয়া বা অশালীন সম্পর্কে তারাই বেশি জড়ায় যাদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস অগভীর। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যাতে চরম শীতলতার দিকে না গড়ায় সে জন্য পরস্পরের প্রতি অনুরাগ, ত্যাগ ও শ্রদ্ধার ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি। এ ছাড়াও পরস্পরের রুচিবোধ, চাহিদা, মানসিকতা, প্রত্যাশা ও সুবিধা-অসুবিধার দিকেও নজর রাখা জরুরি।

আজকের আলোচনার শেষাংশে তালাক সংক্রান্ত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান তুলে ধরব। এ বিধানটি হল ইসলাম ধর্ম তালাকের পরও পুনরায় সংসারে ফিরে আসার তথা আগের স্ত্রী বা স্বামীর সঙ্গে আবারও বিয়ে করার পথ খোলা রেখেছে। ইসলামী বিধান অনুযায়ী প্রথমবার তালাকের পর স্ত্রীকে তিন মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিয়ের আগে। অন্য কথায় নতুন করে বিয়ের আগে নারীকে তিনটি মাসিক বা ঋতুস্রাব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। (সুরা বাকারা-২২৮ নম্বর আয়াত দ্র.)  এই বিধানের অন্যতম কারণ বা দর্শন হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আবারও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বা সম্পর্ক-উন্নয়নের সুযোগ করে দেয়া। তালাকের নোটিশ পাওয়ার পর যদি শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক দিক থেকে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা না থাকে তাহলে স্ত্রী স্বামীর ঘরেই থাকতে পারেন। এ সময় স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি আবারও আকর্ষণ অনুভব করেন তাহলে তার সঙ্গে হেসে কথা বলে বা কৌতুকের মাধ্যমে অথবা এমনকি তার শরীরকে হাল্কাভাবে স্পর্শ করে আনুষ্ঠানিক কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়াই আবারও সংসার শুরু করতে পারেন। 

তাই প্রথম তালাককে বলা হয় তালাকে রাজয়ি বা প্রত্যাবর্তনযোগ্য তালাক। স্বামী এ ধরনের তালাকের পর কোনো শর্ত ছাড়াই আবারও স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারেন নিজ সংসারে। তবে এ অবস্থা তখনই প্রযোজ্য হবে যখন স্বামী তার প্রথম তালাকের জন্য আন্তরিকভাবেই অনুতপ্ত হবেন এবং সংসারকে আবারও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে দৃঢ়-সংকল্প হবেন। অন্য কথায় স্ত্রীর ক্ষতি করবেন না ও তার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিকে অস্পষ্ট রাখবেন না এই শর্তেই নিজ স্ত্রীকে প্রথম তালাকের পরও ফিরিয়ে আনতে পারেন ঘরে। 

পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ২৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও তথা তাদের সঙ্গে আপোস কর অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যে আটকে রেখো না। আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদেরই ক্ষতি করবে।

অর্থাৎ স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পর আবারও তার সঙ্গে সংসার শুরু করার উদ্দেশ্য যেন তার ক্ষতি করার জন্য না হয় তথা সামাজিক, মানসিক ও শারীরিক কোনো দিক থেকেই স্ত্রীর ক্ষতি করার চিন্তা যেন মাথায় না থাকে। বরং পুনর্বিবাহ বা আপোষের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নিজেকে সংশোধন করা ও সংসারে শান্তি ফিরিয়ে আনা যাতে স্ত্রী, স্বামী ও সন্তানরা প্রশান্তি আর নিরাপত্তা অনুভব করেন এবং মানসিক, নৈতিক ও চিন্তাগত বা বিশ্বাসের সংকটগুলো কেটে যায়।  #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ