মে ০৯, ২০২৩ ১৮:৩৫ Asia/Dhaka

আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী-আ. বলেছেন, সুন্দর তথা প্রশান্ত ও হাস্যোজ্জ্বল মুখ হচ্ছে মানুষের প্রথম ও সহজতম উপহার। তিনি আরও বলেছেন, হাস্যোজ্জ্বল মুখ মানুষের প্রথম দান ও মহত্ত্বের প্রমাণ।

তাই আমাদের উচিত সুন্দর হাস্যজ্জ্বোল চেহারা নিয়ে দিন শুরু করা ও পরিবারকে আনন্দ আর প্রফুল্লতার মাঝে ডুবিয়ে রাখা। যে পরিবারের সদস্যরা টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়া অথবা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে পরিবারের সদস্যদের রোগমুক্ত ও প্রফুল্ল রাখতে কয়েকটি জরুরি প্রাত্যহিক কাজ হল: প্রতিযোগিতার আয়োজন করা ও তাতে পরিবারের সব সদস্যের অংশ নেয়া, প্রতিদিন দশ মিনিট ব্যায়াম করা, সবাই মিলে জনপ্রিয় একটি কবিতা আবৃত্তি করা, কৌতুক বা ধাঁধা পরিবেশন করে সেরা কৌতুক বা ধাঁধার জন্য পুরস্কার মনোনীত করা এবং সুযোগ থাকলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে পার্ক অথবা পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া। এ ছাড়াও বৃষ্টির সময় হাঁটাহাটি করুন। তুষারপাত হলে সবাই মিলে বরফ-মানব তৈরি করুন। সাধারণ খাবার তৈরি করে তা প্রাকৃতিক পরিবেশে সবাই মিলে উপভোগ করুন। সবাই মিলে ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করুন। রান্নার প্রতিযোগিতা করুন, বিশেষ করে বাচ্চাদেরকে রান্নার সুযোগ দিন, অবশ্য তা করতে হবে বড়দের তত্ত্বাবধানে। 

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত আদর্শ, সৎ, সহমর্মী ও পবিত্র দম্পতির দৃষ্টান্ত হিসেবে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ) ও হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.)'র পারিবারিক  জীবনের নীতি ও কয়েকটি দিক তুলে ধরব: হযরত ফাতিমা জাহরা (সা) বড় হয়েছেন মহানবীর পরিবারে ইসলামী আদর্শের সর্বোত্তম পরিবেশে। সামাজিক ও রাজনৈতিক তৎপরতায় অংশ নেয়া সত্ত্বেও সংসার পরিচালনাতেও তিনি ছিলেন নেত্রী। এ ধরনের পরিবারের সদস্যরা সামষ্টিক জীবনে পরস্পরের সহযোগী। এ ধরনের পরিবারে ঘরের বউ যদি পিতামাতা বা তাদের সমতুল্য কারো সেবা করেন তা স্বামীর অধিকারের প্রতি সাংঘর্ষিক হবে না। হযরত ফাতিমা ও হযরত আলীর আদর্শের কাঠামোয় গড়ে ওঠা পরিবারে ধার্মিকতা ও প্রাত্যহিক জীবনের কাজগুলোর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই এবং সন্তানের জন্ম দেয়ার বিষয়টির সঙ্গে আন্তরিকতা ও ভালোবাসার কোনো সংঘাত নেই। 

হযরত আলী ও ফাতিমা সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। কিন্তু তাদের জীবনের সৌন্দর্য ইতিহাসে তাঁদেরকে অমর করেছে। তাদের পরিবারের সবাই ছিলেন আল্লাহর আশেক। হযরত আলীর ভাষায় আল্লাহ যখন তার কোনো বান্দাকে সম্মানিত করতে চান তখন তিনি তাঁকে নিজের প্রেমের বন্ধনে মশগুল করেন। হযরত আলী ও ফাতিমার পরিবারের সবাই ছিলেন খোদা-প্রেমের অনলে পোড়া মানুষ। হযরত আলী ও ফাতিমা বিয়ের রাত কাটিয়েছেন সম্মিলিতভাবে মহান আল্লাহর ইবাদতে। মহানবী (সা) একবার হযরত আলীকে প্রশ্ন করেছিলেন

তোমার স্ত্রীকে কেমন পেলে? হযরত আলী তৎক্ষণাৎ বললেন, আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সহযোগী।  

হযরত ফাতিমা পরিবারের অঙ্গনকে পরিণত করেছিলেন ইসলামী শিক্ষার নজিরবিহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি কেবল সন্তানকে সুশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেই নয় জনগণের কাছেও ইসলামী শিক্ষা পৌঁছে দিতে নিজের ঘরকে পরিণত করেছিলেন ক্লাস ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে! তিনি সেখানে সুস্থ, সফল ও কার্যকর জীবনের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন।

সুরা ইনসান বা সুরা দাহিরের অন্তত ১৭টি আয়াত নাজিল হয়েছিল নবী-পরিবারের  আত্মত্যাগের প্রশংসায়।

সুরা ইনসান বা সুরা দাহিরের অন্তত ১৭টি আয়াত নাজিল হয়েছিল নবী-পরিবারের পারিবারিক দান বা আত্মত্যাগের প্রশংসায়। একবার হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত আলী (আ.) মানত করেন যে তাঁরা সুস্থ হলে তিন দিন রোজা রাখবেন। একই মানত করেন হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) ও তাঁর সন্তান হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) এবং পরিচারিকা ফিজ্জা। ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) সুস্থ হলে তারা মানত বা প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য রোজা রাখেন। ইফতারের জন্য কিছুই ছিল না ঘরে। হযরত আলী (আ.) এক রাত ধরে শ্রমিকের কাজ করে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে সামান্য আটা কিনে আনেন। সেই আটার এক তৃতীয়াংশ দিয়ে ৫টি রুটি বানান হযরত ফাতিমা (সা. আ.)।

 কিন্তু ইফতারির সময় একজন নিঃস্ব বা হত-দরিদ্র ব্যক্তি এসে খাবার চাইলে ৫ জনই তাঁদের ৫টি রুটি দিয়ে দেন ওই নিঃস্ব ব্যক্তিকে। তাঁরা শুধু পানি পান করে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটান এবং পরদিনও রোজা রাখেন। হযরত ফাতিমা (সা.) পরের দিনের ইফতারের জন্য সেই আটার অন্য এক তৃতীয়াংশ দিয়ে আরো ৫টি রুটি বানান। এই দিন ইফতারের সময় আসে এক ইয়াতিম। সবাই তাঁদের রুটিগুলো ওই ইয়াতিমকে দিয়ে দেন এবং কেবল পানি পান করে রাত কাটান। তৃতীয় দিনেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। এবার এসেছিলেন মুক্তিপ্রাপ্ত অমুসলিম এক বন্দী। তাকে রুটিগুলো দিয়ে দেয়ায় ঘরের সব আটা শেষ হয়ে যায়। ফলে তারা তিন দিন ইফতার ও সাহরির সময় কেবলই পানি পান করেছেন। কোনো প্রতিদান ও এমনকি সামান্য মৌখিক কৃতজ্ঞতারও আশা না করে নিজের  জরুরি খাদ্যও এভাবে দান করার নজির ইতিহাসে বিরল। 

রাসূল (সা.) এসে দেখেন যে সদ্য রোগমুক্ত তাঁর প্রিয় দুই নাতি হযরত হাসান ও হুসাইন (আ.) ক্ষুধার কষ্টে কাতর হয়ে কাঁপছেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বললেন, তোমার অবস্থায় আমি খুবই দুঃখিত। তিনি ফাতিমা (সা.)’র কাছে গিয়ে দেখলেন দুর্বল হয়ে পড়া ফাতিমা (সা.)’র চোখ দুটি গর্তে নেমে গেছে। ফাতিমা (সা.)-কে কাছে টেনে নিয়ে তিনি বললেন: আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইছি! তোমরা তিন দিন ক্ষুধার্ত! এ সময় আবির্ভূত হন হযরত জিবরাইল (আ.)। তিনি সুরা দাহরের প্রথম থেকে ২২ নম্বর আয়াত পর্যন্ত পড়ে শোনান রাসূল (সা.)-কে। ইমাম ফাখরে রাজি, আবুল ফারাজ জাওজি ও জালাল উদ্দিন সিয়ুতিসহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সুন্নি মনীষী এই শা’নে নাজুলকে সমর্থন করেছেন।-দান খয়রাত পরিবারের জন্য বরকত ও প্রাচুর্য বয়ে আনে। অন্যদিকে কার্পণ্য হচ্ছে বরকত ও নেয়ামত বন্ধ হওয়ার মাধ্যম। 

হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) ছিলেন ফাদাক নামক বাগানের মালিক। এ বাগানের বার্ষিক আয় ছিল ৭০ হাজার থেকে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার দিনার বা স্বর্ণমুদ্রা। তিনি এ সম্পদের আয় থেকে কেবল সংসারের অতি জরুরি খরচের অর্থ ছাড়া বাদবাকি সব অর্থ মদিনার দরিদ্র মানুষের কাছে বিলিয়ে দিতেন। ফলে যেদিন ফাদাকের সম্পদের মাসিক আয় হযরত ফাতিমার কাছে তুলে দেয়া হত সেদিনটি হতো মদিনার দরিদ্রদের জন্য যেন ঈদ উৎসবের দিন!

পরিবারকে সুখী করতে হলে এর  সিনিয়র সদস্যদের হতে হবে গভীরভাবে আন্তরিক ও দয়ালু। নিষ্প্রাণ ও শুষ্ক মন নিয়ে পরিবারের সদস্যদের হৃদয় জয় করা যায় না, পরিবারের কর্তারা এমন শুষ্ক ও উদাসীন হলে জুনিয়র সদস্যরা, বিশেষ করে নারী ও কন্যারা পরিবারের বাইরেই শান্তি ও সুখ খুঁজতে যাবেন। ফলে ঘরের বাইরে তারা সুযোগ-সন্ধানীদের হাতে প্রতারিত হতে পারেন। শিশুদের জন্য পিতার বিশেষ স্নেহ ও যত্ন খুব জরুরি এবং কন্যা শিশুর জন্য তা আরও জরুরি। যেসব কন্যা শিশু শৈশবে পিতার যথাযথ আদর পায় তারা বড় হলে কর্মক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী হন এবং ভবিষ্যতে আদর্শ মা হিসেবেও তারা বেশি সফল হন।-

কন্যা শিশুর পড়াশুনার ব্যাপারে বাবার অথবা মায়ের যত্ন নেয়াও বিশেষভাবে জরুরি। কন্যার বান্ধবীদের ভালোভাবে চিনে রাখা বাবা-মায়ের কর্তব্য যাতে তাদের সঙ্গে কোনো সমস্যা দেখা দিলে পথ-নির্দেশনা দেয়া যায়। কন্যা শিশুদেরকে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় বিষয়ে উৎসাহ দিন। ধর্মীয় সমাবেশগুলো থেকে কন্যা সন্তানরা অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো বান্ধবী পেতে পারেন।  কন্যারা মায়ের পবিত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। তারা যদি এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ না পেয়ে থাকে তাহলে তা তাদের আধ্যাত্মিক বিকাশের পথে বাধা হয়ে থাকবে। কন্যাদেরকে আদর-যত্ন ও নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বড় করতে হয়। এটা কন্যা শিশুদের ন্যায্য অধিকার।  #

পার্সটুডে/ এমএএইচ/৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ