সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ৩৭
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সংযম সাধনা জরুরি। যারা সংযমী তারা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সফল এবং তারা চাহিদা পূরণে মাত্রাতিরিক্ত তাড়াহুড়োর আশ্রয় নেন না। সংযম সাধনায় সফলতার অর্থ হলো আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার নানা গুণের বিকাশ।
আসলে পৃথিবীতে খুশি বা আনন্দ, সুখ বা দুঃখ অনেক ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক ব্যাপার। তাই উভয় অবস্থায়ই মানুষের উচিত সংযম অবলম্বন করা এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে সংযত রাখা যে, খুশি ও আনন্দের ফলে যেন মনে-প্রাণে অহংকার ও অহমিকার ভাব সৃষ্টি না হয়। অপরদিকে দুঃখ ও বেদনার সময়ও যেন অধীর, উদাস ও বিষণ্ণ হয়ে থাকতে না হয়। এই উভয় অবস্থায় সীমার ভেতরে থাকার অবলম্বন হচ্ছে আত্মসংযম। মানবজীবনের বহুমুখী প্রবৃত্তিকে সুসংহত করার পথ এটি।
পবিত্র আল কুরআনের সূরা হুদের ৯, ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আর যদি আমি মানুষকে স্বীয় অনুগ্রহ আস্বাদন করিয়ে তার নিকট হতে তা ছিনিয়ে নিই, তাহলে সে নিরাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। আর যদি তার উপর আপতিত দুঃখ কষ্টের পরে তাকে সুখভোগ করতে দেই, তবে সে বলতে থাকে যে, আমার অমঙ্গল দূর হয়ে গেছে, আর সে আনন্দে আত্মহারা হয়, অহংকারে উদ্ধত হয়ে পড়ে। কিন্তু যারা ধৈর্য ধরে ও ভাল কাজ করে (তারা এ রকম হয় না); এমন লোকদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং মহা প্রতিদান।
যারা সংযমী তারা রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে পারদর্শী। পৃথিবীতে অনেক অনিষ্টের মূলে রয়েছে রাগ বা ক্রোধ। মানুষ এ রাগের বশবর্তী হয়ে অনেক নির্দয় ও অত্যাচারমূলক কাজ করে ফেলে। এ রাগের ফলে মানুষ সম্মানিত হওয়ার পরিবর্তে লজ্জা ও অবজ্ঞার শিকার হয়। তাই কারও দ্বারা কোনো ক্ষতি বা অন্যায়মূলক কাজ হয়ে গেলেও রাগ না করে ক্ষমা করা উচিৎ এবং ধৈর্য ধারণ করা উচিত। মনে রাখতে হবে, আত্মসংযম এক ধরনের আত্মশৃঙ্খলা। এ শৃঙ্খলাবোধ বা চর্চা মানুষের জীবনে নানাভাবে সাহায্য করে।
মূলত সংযমের চর্চা মানুষের বিষণ্ণতা, ভয়, খারাপ কাজের প্রতি আসক্তি এবং যেকোনো ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ থেকে মুক্তি পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংযম মানুষকে শেখায় ধ্বংসাত্মক, অতিরঞ্জিত, বদ্ধমূল ধারণা এবং নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করা থেকে বিরত থাকা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার এবং সারা জীবনের ভারসাম্য রক্ষার জ্ঞান দেয়। অতি আবেগকে দমন করে পরিমিতিবোধ বা সংযত আচরণ করতে সাহায্য করে। নিজের অসহায়ত্ব দূর করে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করে। মানসিক ও আবেগী নিরাসক্তিকে সুস্পষ্ট করতে সাহায্য করে। মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে। নেতিবাচক ধারণা ও ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অবদান রাখে। আত্মসংযমী মানুষ জীবনভর যেকোনো অবস্থায় সুদৃঢ়ভাবে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারে। পৃথিবীতে ভালো কাজ করার জন্য মানসিক সুদৃঢ়তা খুবই দরকার। অপরদিকে, খারাপ কাজ চিত্তাকর্ষক ও আরাম-আয়েশে পরিপূর্ণ হলেও তা পরিহার করাও অপরিহার্য।
দুঃখ ও বেদনার ভয় থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনকালে সত্য কথা বলা এবং সত্যমত ও পথকে কবুল করা এবং সত্যের পথে সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে মনের আনন্দে অগ্রসর হওয়া, সুদ ও অসদুপায়ে অর্থ উপার্জন পরিত্যাগ করা, রূপ ও যৌবনের অশুভ পাঁয়তারাকে বর্জন করা ইত্যাদি ভালো কাজ তখনই করা সহজ ও সম্ভব হবে যখন আমরা সংযম চর্চা করব। আত্মসংযমের অভ্যাসটা গড়ে তুলতে হবে শিশুকাল থেকেই। বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের সংযমের শিক্ষা দেওয়ার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। তবে প্রথমেই বাবা-মাকে হতে হবে সন্তানদের আদর্শ। কারণ শিশুরা সব সময় বাবা-মাকে দেখে, তাদের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম অনুসরণ ও অনুকরণ করে। তবে তারা যে অনুসরণ ও অনুকরণ করছে তা তারা নিজেরাও বুঝতে পারে না। কাজেই সন্তানদেরকে এই গুণে গুণান্বিত করতে বাবা-মাকেও এই গুণ ধারণের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। শিশুদেরকে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং কখনো কখনো 'না' শব্দটির সম্মুখীন হওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তাদেরকে এটা বুঝাতে হবে যে, কখনো কখনো প্রয়োজনে নিজের ইচ্ছার বাস্তবায়ন থামিয়ে দিতে হয়। 'না' বলার মাধ্যমে অথবা 'মানা' করার মাধ্যমে এই চর্চার সূচনা হতে পারে।(মিউজিক)
আপনার সন্তান যদি নির্ধারিত মাত্রায় চেয়ে বেশি চকলেট খেতে থাকে তাহলে তাকে মানা করুন, বলে দিন আর খাওয়া ঠিক হবে না। শিশুদের কাছে চকলেট খাওয়া বন্ধ রাখা অথবা টিভি দেখা থেকে বিরত থাকা খুব কঠিন বিষয়। এ কারণে বাবা-মা এই কাজের জন্য শিশুদেরকে পুরস্কৃত করতে পারেন। এই পুরস্কার মৌখিক উৎসাহও হতে পারে। এর ফলে শিশুর মধ্যে ক্রমেই এই অভ্যাস গড়ে ওঠবে যে, তারা যেকোনো কাজ করার আগে একটু হলেও এর ভালো-মন্দ দিক ভেবে নেবে। নিজের মধ্যে এই দক্ষতা সহজেই বাড়ানো সম্ভব। ব্যক্তিকে নিজের প্রতি নিজেকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। তবে প্রতিশ্রুতি হতে হবে নিজের শক্তি-সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ব্যক্তিকে তার নিজের কর্ম ও আচরণের বিষয়ে দায়িত্ববান হতে হবে অর্থাৎ নিজের কাজ ও আচরণের ফল নিজেকে বহন করার মানসিকতা গড়তে হবে। নিমিষেই চাহিদা মেটানোর প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে এবং উসকানিমূলক অবস্থা থেকে দূরে থাকতে হবে। এছাড়া চাহিদা ও ইচ্ছা পূরণের জন্য তাড়াহুড়ো না করার কারণে এবং ধৈর্য ধরার কারণে নিজেকেই পুরস্কৃত করতে হবে। এছাড়া আত্মসংযমী হওয়ার জন্য যেকোনো কাজ করার আগে এর পরিণতি ভেবে নেওয়া, ইতিবাচক শব্দ ও বাক্য ব্যবহার ও পুনরাবৃত্তি করা, চিন্তা-চেতনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা মেডিটেশন এ ক্ষেত্রে আপনার কাজে আসতে পারে।
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।