কুরআনের আলো
সূরা আর-রহমান : আয়াত ৩১-৪৫ (পর্ব-৪)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। গত আসরে আমরা সূরা আর-রহমানের ৩০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তাফসির শুনেছি। আজ আমরা এই সূরার ৩১ থেকে ৪৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই ৩১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَا الثَّقَلَانِ (31) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (32) يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوا لَا تَنْفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ (33) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (34) يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌ مِنْ نَارٍ وَنُحَاسٌ فَلَا تَنْتَصِرَانِ (35) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (36)
“হে মানুষ ও জিন, আমি অচিরেই তোমাদের (হিসাব-নিকাশ গ্রহণের) প্রতি মনোনিবেশ করব।” (৫৫:৩১)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৩২)
“হে জ্বিন ও মানুষ সম্প্রদায়! তোমরা যদি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করতে পার, তাহলে অতিক্রম কর, কিন্তু কোন [অতিন্দ্রীয়] শক্তি ছাড়া তোমরা তা অতিক্রম করতে পারবে না।”(৫৫:৩৩)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৩৪)
“সেদিন তোমাদের উভয়ের প্রতি প্রেরিত হবে আগুনের শিখা ও গলিত তামা, তখন তোমরা পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবে না।”(৫৫:৩৫)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৩৬)
আগের আসরে এই পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালার কিছু নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিন মানুষের কর্মের হিসাব-নিকাষ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: বিশ্বজগতে অসংখ্য জড় বস্তু ও প্রাণী সৃষ্টি করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মানুষ এবং জ্বীনকেই বোধশক্তি ও উপলব্ধি করার এবং কর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কাজেই অন্যান্য সৃষ্টির তুলনায় মানুষ ও জ্বীন বেশি মর্যাদাবান এবং এ কারণে তাদেরকে পরকালে তাদের কর্মের হিসাব দিতে হবে। কাজেই তোমরা নিজেদের কাজের ব্যাপারে সতর্ক থেকো এবং একথা মনে করো না যে, তোমরা আল্লাহর শক্তির ওপর বিজয়ী হতে পারবে। তোমরা একথা ভেবো না যে, তোমরা আসমান-জমিনের সীমারেখা ভেদ করে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের বাইরে চলে যেতে পারবে। জাহান্নামের আগুনের শিখা ও ধুম্রজাল তোমাদেরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখবে যাতে সেখান থেকে যেমন তোমরা নিজেরা বের হতে পারবে না তেমনি কেউ তোমাদেরকে বের হওয়ার কাজে সাহায্যও করতে পারবে না।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে:
১- বোধশক্তি ও জ্ঞান মানুষ ও জ্বিনের জন্য দায়িত্বশীলতা তৈরি করে। এই দু’টি থাকার কারণে মানুষ ও জ্বীনকে পার্থিব জীবনে আল্লাহর বিধিবিধান পালনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে।
২- জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করে মহাবিশ্ব সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেই যেন মানুষ একথা ভাবতে শুরু না করে যে, সে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পেরেছে।
৩- জ্বিন আগুনের তৈরি হলেও জাহান্নামের আগুনে তাকে নিক্ষিপ্ত করা হলে সেখানে সে মানুষের মতোই কষ্ট পাবে। এখান থেকে বোঝা যায়, পার্থিব জীবনের আগুন ও পরকালের আগুনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
এবারে সূরা আর-রহমানের ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ (37) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (38) فَيَوْمَئِذٍ لَا يُسْأَلُ عَنْ ذَنْبِهِ إِنْسٌ وَلَا جَانٌّ (39) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (40)
“অতঃপর যে দিন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাবে, অতঃপর তা রক্তিম গোলাপের ন্যায় লাল চামড়ার মত হবে।”(৫৫:৩৭)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” (৫৫:৩৮)
“অতঃপর সেদিন মানুষ কিংবা জ্বিন কাউকেই তাদের অপরাধ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হবে না [কারণ, সেদিন সবকিছু থাকবে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। ]”(৫৫:৩৯)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৪০)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতগুলোতে কিয়ামত দিবসের সূচনার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: পার্থিব জগতের মেয়াদ শেষ হলে বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। গোটা বিশ্বজগতে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটতে থাকবে। গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ, গ্যালাক্সি- যেগুলো বর্তমানে নিজ নিজ কক্ষপথে ঘুর্ণয়মান সেগুলো কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরস্পরে সংঘর্ষে হয়ে গলিত লাভার মতো ছড়িয়ে পড়বে যার রং হবে গোলাপের মতো লাল। এরপর নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠবে। মানুষ কবর থেকে বেরিয়ে এসে কিয়ামতের ময়দানে সমবেত হবে।
সেই দিবসে মানুষকে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হবে। একটি অবস্থানে তাকে পার্থিব জীবনের কর্ম সম্পর্কে জবাবদিহী করতে হবে। এ সময় তার বাকশক্তি বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে থাকবে। বিশেষ করে এখানে বলা হচ্ছে, সেদিন কারো কাছে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। কারণ, সেদিন গোনাহগার ব্যক্তির আমলনামা সবার সামনে স্পষ্ট থাকবে এবং অপরাধী ব্যক্তি কোনো কিছুই অস্বীকার করতে পারবে না। কাজেই প্রশ্ন করে কোনো কিছু জানার প্রয়োজন থাকবে না।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কিয়ামত দিবসের বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার কোনো মিল থাকবে না। এই জগতের কোনো আইন-কানুন বা নিয়ম-শৃঙ্খলা পারলৌকিক জীবনে কাজে লাগবে না।
২- গোনাহ করলে প্রকারান্তরে আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞা প্রকাশ করা হয়।
এবারে এই সূরার ৪১ থেকে ৪৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يُعْرَفُ الْمُجْرِمُونَ بِسِيمَاهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَالْأَقْدَامِ (41) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (42) هَذِهِ جَهَنَّمُ الَّتِي يُكَذِّبُ بِهَا الْمُجْرِمُونَ (43) يَطُوفُونَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ حَمِيمٍ آَنٍ (44) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (45)
অপরাধীদের পরিচয় পাওয়া যাবে তাদের চেহারা থেকে, অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে মাথার সামনের চুল ও পা ধরে [এবং তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে]।” (৫৫:৪১)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৪২)
“এটাই সেই জাহান্নাম যাকে অপরাধীরা অস্বীকার করত। (৫৫:৪৩)
“তারা জাহান্নামের আগুন ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ঘুরাঘুরি করবে। (৫৫:৪৪)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন্ অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৪৫)
কিয়ামত দিবসের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেদিন মানুষের অন্তরের সব অভিব্যক্তি প্রকাশ হয়ে পড়বে। তাদের মুখমণ্ডলে তাদের সকল চিন্তাভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যাবে। সেদিন পবিত্র আত্মা ও পুণ্যবান ব্যক্তিরা হাস্যোজ্জ্বল থাকবে এবং অপরাধী ও জালিমরা থাকবে ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায়।
আগের আয়াতগুলোতে কিয়ামতের দিন পাপী ব্যক্তিদের কাছে প্রশ্ন করা হবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলোতে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে: এ ধরনের মানুষের কাছে কোনো প্রশ্ন করার প্রয়োজন হবে না। কারণ, তাদের সমস্ত অপরাধ তাদের মুখয়বে ধরা পড়ে যাবে যা তারা অস্বীকার করতে পারবে না। এ সময় জাহান্নামের ফেরেশতারা তাদেরকে অপমানজনক অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে।
এই পাঁচ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- যারা পরকালকে অস্বীকার করে এবং পা থেকে মাথা পর্যন্ত আল্লাহর বিধিবিধানের বিরোধিতা করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন মাথা ও পা ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তাদের জন্য এর চেয়ে অপমানকর ও লজ্জাজনক কোনো বিষয় থাকতে পারে না।
২- পরকালকে অস্বীকার ও পাপকাজ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর একটির সঙ্গে জড়ালে অপরটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসে যায় যার ফলে সমাজ অপরাধী কর্মে ছেয়ে যায়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।