কুরআনের আলো
সূরা আর-রহমান : আয়াত ৪৬-৬১ (পর্ব-৫)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আজ আমরা এই সূরার ৪৬ থেকে ৬১ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই ৪৬ থেকে ৫৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ (46) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (47) ذَوَاتَا أَفْنَانٍ (48) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (49) فِيهِمَا عَيْنَانِ تَجْرِيَانِ (50) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (51) فِيهِمَا مِنْ كُلِّ فَاكِهَةٍ زَوْجَانِ (52) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (53)
“আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সুউচ্চ মর্যাদাকে ভয় পায়, তার জন্য রয়েছে [জান্নাতের] দু’টি বাগান।” (৫৫:৪৬)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৪৭)
“দুটি বাগানই বহু শাখা-পল্লব বিশিষ্ট বৃক্ষে পূর্ণ।”(৫৫:৪৮)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৪৯)
“উভয় বাগানে রয়েছে প্রবাহমান দুই প্রস্রবণ।”(৫৫:৫০)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৫১)
“উভয় বাগানে রয়েছে প্রত্যেক ফল দুই দুই প্রকার।”(৫৫:৫২)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৫৩)
গত আসরে আমরা পরকালে গুনাহগার ব্যক্তিদের শাস্তির বর্ণনা দিয়েছি। এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসীর পুরস্কারসমূহের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ও বিস্ময়কর পুরস্কারের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তবে অন্য অনেক আয়াতের মতো এখানে জান্নাত লাভের জন্য ঈমান ও সৎকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়নি বরং এখানে শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার নিদেশ অমান্য করাকে ভয় করে এবং বিনিময়ে সে পায় জান্নাত।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, কিছু মানুষ জাহান্নামে যাওয়ার ভয়ে আল্লাহকে ভয় করে এবং কেউ কেউ জান্নাতে যাওয়ার আশায় এ কাজ করে। কিন্তু মুমিনদের একাংশ আছেন এমন যারা আল্লাহকে আল্লাহর জন্যই ভয় করেন এবং তাঁর নাফরমানি করা থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য এই ভয় আল্লাহর সুউচ্চ মর্যাদা ও অবস্থানের কারণে হয়। মুত্তাকি ব্যক্তিরা যে কারণে আল্লাহকে ভয় করেন তা হলো, তারা মনে করেন, তাদের সব কাজ আল্লাহর চোখের সামনে হচ্ছে।
এটি হচ্ছে সেই শিশুর মতো যে খারাপ কাজ করার সময় তার বাবার শাস্তির কথা মনে রেখে ওই কাজ থেকে বিরত থাকে। যাই হোক, আল্লাহকে ভয় করার সঙ্গে পাপ ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি নবী-রাসূল ও আউলিয়াগণ গুনাহ নয় কিন্তু অর্থহীন কাজ করা থেকেও বিরত থাকতেন।
আল্লাহকে ভয় করে এবং গুনাহমুক্ত জীবনযাপন করে যদি কেউ নিজের মর্যাদা এতটা উঁচুতে ওঠাতে পারে তাহলে এমন মানুষকে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা একটি নয় বরং দুটি জান্নাত দান করবেন। সেই জান্নাতসমূহে রয়েছে নানারকম ঝরনা এবং অসংখ্য ফল-মূলের গাছ।
এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
(১) মহান আল্লাহর সত্ত্বা বান্দার প্রতি দয়াশীল, কাজেই তাঁর সত্ত্বাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক হিসেবে তাঁর সুউচ্চ মর্যাদাকে ঈমানদার মানুষেরা ভয় পায় এবং যেকোনো কাজ করার সময় আল্লাহর কথা স্মরণ করে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে।
২- জান্নাতের নিয়ামতরাজি জান্নাতবাসীকে সারাক্ষণ আনন্দ দিতে থাকবে এবং সেখানে জান্নাতিরা কখনও ক্লান্ত বা পরিশ্রান্ত হবে না।
এবারে সূরা আর-রহমানের ৫৪ থেকে ৬১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
مُتَّكِئِينَ عَلَى فُرُشٍ بَطَائِنُهَا مِنْ إِسْتَبْرَقٍ وَجَنَى الْجَنَّتَيْنِ دَانٍ (54) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (55) فِيهِنَّ قَاصِرَاتُ الطَّرْفِ لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ (56) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (57) كَأَنَّهُنَّ الْيَاقُوتُ وَالْمَرْجَانُ (58) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (59) هَلْ جَزَاءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ (60) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (61)
“সেখানে [জান্নাতবাসী] হেলান দিয়ে বসবে পুরু রেশমের আস্তরবিশিষ্ট বিছানায় এবং দুই বাগানের ফল হবে তাদের নিকটবর্তী।” ৫৫:৫৪)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”৫৫:৫৫)
“তার মধ্যে থাকবে সতীসাধ্বী সংযত-নয়না [কুমারী]রা, যাদেরকে পূর্বে স্পর্শ করেনি কোন মানুষ আর কোন জ্বিন।”৫৫:৫৬)
কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”৫৫:৫৭)
“[সৌন্দর্যে] তারা যেন পদ্মরাগ ও প্রবালসদৃশ। ”৫৫:৫৮)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”৫৫:৫৯)
“উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ব্যতীত আর কি হতে পারে?”৫৫:৬০)
“কাজেই তোমরা উভয়ে তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৬১)
আগের আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসীর জন্য জান্নাতে প্রস্তুত কিছু নিয়ামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর এই আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসীর অবস্থা সম্পর্কে আরো বলা হচ্ছে- তারা মনোমুগ্ধকর বিছানায় হেলান দিয়ে বসবে এবং এখান থেকে তাদের পরিপূর্ণ প্রশান্ত মন ও নিরাপদ অবস্থার বর্ণনা পাওয়া যায়। এরপর এমন সব গাছের কথা বলা হয়েছে যেগুলোর ফল মানুষের হাতের নাগালে থাকে।
এরপর আল্লাহ বলছেন, মুমিন ব্যক্তিরা জান্নাতে একা থাকবেন না বরং তাদেরকে সঙ্গ দেয়ার জন্য সেখানে থাকবেন পবিত্র স্ত্রীগণ। এসব স্ত্রী একদিকে পবিত্র ও কুমারি এবং অন্যদিকে অত্যন্ত কোমল, নমনীয় ও সুন্দরী। এসব স্ত্রী পেয়ে মুমিন ব্যক্তিদের জান্নাতি জীবন পরিপূর্ণ সুখের হয়ে উঠবে।
মহান আল্লাহ জান্নাতি স্ত্রীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন: এসব স্ত্রী শুধুমাত্র তাদের স্বামীর দিকে তাকাবেন এবং পরপুরুষের দিকে নজর দেয়া থেকে বিরত থাকবেন। স্বামীর পূর্বে এসব নারীর অন্য কারো সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না এবং শুধুমাত্র তাদের স্বামীকেই ভালোবাসবেন। জান্নাত যেহেতু হারাম দৃষ্টি কিংবা অবৈধ সম্পর্কের স্থান নয় তাই এই আয়াত দিয়ে হয়তো পার্থিব জীবনের মুমিন নারীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যেসব বৈশিষ্ট্যের কারণে তারা জান্নাতে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।
এই আয়াতগুলোর শেষাংশে একটি সার্বিক আইন বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: কোনো ভালো কাজই আল্লাহর দৃষ্টির অগোচরে থাকে না। তিনি সৎকর্মশীলদের উত্তম পুরস্কার দান করেন। পার্থিব জীবনের পুরস্কার হয় পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পরকালে সৎকর্মশীলদের জন্য রয়েছে জান্নাতের মতো বিশাল নেয়ামত।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- যে ব্যক্তি পার্থিব জগতে হারাম দৃষ্টি দেয়ার গুনাহ থেকে বিরত থাকে, তার জন্য আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে চরম সুখের ব্যবস্থা রেখেছেন।
২- জান্নাতি স্ত্রীগণের বৈশিষ্ট্য হবে পবিত্র, কোমল ও সুন্দরী। আর পার্থিব জীবনেও যেসব নারী এসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তারা তাদের সংসারটাকে জান্নাতের এক টুকরা বাগানে পরিণত করবে।
৩- আল্লাহর কাছ থেকে আমাদের একথা শেখা উচিত যে, যে ব্যক্তি সৎকাজ করে বা অপরের প্রতি সদয় আচরণ করে তার সঙ্গেও যেন আমরা সদ্ব্যবহার করি এবং কখনোই তার অবদানের কথা ভুলে না যাই।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দিন।
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।