কুরআনের আলো
সূরা আর-রহমান : আয়াত ৬২-৭৮ (পর্ব-৬)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা আর-রহমানের ৬১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তাফসির শুনেছি। আজ আমরা এই সূরার ৬২ থেকে ৭৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই ৬২ থেকে ৬৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَمِنْ دُونِهِمَا جَنَّتَانِ (62) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (63) مُدْهَامَّتَانِ (64) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (65) فِيهِمَا عَيْنَانِ نَضَّاخَتَانِ (66) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (67) فِيهِمَا فَاكِهَةٌ وَنَخْلٌ وَرُمَّانٌ (68) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (69)
“ওই দুই [উদ্যানের] নীচে রয়েছে আরো দুটি উদ্যান।” ( (৫৫:৬২)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” (৫৫:৬৩)
“[ওই দুই বাগান] এতটা ঘন সবুজ যেন কৃষ্ণবর্ণ ধারন করেছে।” (৫৫:৬৪)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৬৫)
“উভয় [বাগানে] আছে উচ্ছলিত দুই প্রস্রবণ।”(৫৫:৬৬)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৬৭)
“উভয় [বাগানে] রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফলমূল-খেজুর ও আনার।”(৫৫:৬৮)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৬৯)
গত আসরে আমরা পরকালে মুত্তাকি, পরহেজগার ও পবিত্র আত্মার মানুষদের পুরস্কার সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের এই আয়াতগুলোতে আরো দুটি জান্নাতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যেগুলোর অবস্থান আউলিয়াদের জান্নাতের চেয়ে একটু নীচে। মানুষ ও জিনদের মধ্যে যারা মুমিন ও সৎকর্মশীল তারা এখানে প্রবেশ করবে।
এখানে এসব জান্নাতি-উদ্যানের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো অত্যন্ত সবুজ-শ্যামল ও সতেজ। সবুজের মাত্রা এতটা বেশি যে, মনে হয় গাছপালা ও লতাগুল্মগুলো যেন ঘন কালো হয়ে আছে। এসব উদ্যানে পানির কোনো অভাব নেই। মাটি কিংবা পাহাড় ভেদ করে বিভিন্ন ধরনের ঝর্নাধারা গাছপালার ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে।
এছাড়া, জান্নাতি গাছগুলোতে রয়েছে প্রচুর ফল-মূল যেগুলো জান্নাতবাসীর নাগালের মধ্যেই রয়েছে। ফল-মূলের কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা এখানে খেজুর ও আনারের কথা নাম ধরে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে এই দুই ফলের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। পার্থিব জগতওে এই দুই ফলের রয়েছে প্রচুর পুষ্টি ও ওষুধি গুণ। যখন পৃথিবীতেই এই ফলগুলোর এত গুণ তাহলে পরকালে না জানি এগুলোতে কতো গুণ থাকবে!
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- জান্নাতের গাছগুলো সব সময় সবুজ, শ্যামল ও সতেজ থাকে।
২- সুবজ-শ্যামল প্রান্তর, বন-বনানি, প্রস্রবন ও ঝর্না, নানা রকমের ফলে ভর্তি গাছপালা জান্নাতবাসীর জন্য নির্ধারিত অসংখ্য নেয়ামতরাজির সামান্য অংশ মাত্র।
৩- পার্থিব জীবনে আল্লাহকে অস্বীকার এবং তাঁর নেয়ামতরাজির কুফরি করার মাধ্যমে মানুষ পরকালীন জীবনের চিরস্থায়ী নেয়ামতরাজি থেকে বঞ্চিত হয়।
এবারে সূরা আর-রহমানের ৭০ থেকে ৭৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
فِيهِنَّ خَيْرَاتٌ حِسَانٌ (70) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (71) حُورٌ مَقْصُورَاتٌ فِي الْخِيَامِ (72) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (73) لَمْ يَطْمِثْهُنَّ إِنْسٌ قَبْلَهُمْ وَلَا جَانٌّ (74) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (75) مُتَّكِئِينَ عَلَى رَفْرَفٍ خُضْرٍ وَعَبْقَرِيٍّ حِسَانٍ (76) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (77) تَبَارَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِي الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ (78)
“সেই জান্নাতসমূহে থাকবে উত্তম চরিত্রবতী অনিন্দ্য সুন্দরী স্ত্রীগণ।” (৫৫:৭০)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৭১)
“তারা হূর, তাঁবুতে তারা থাকবে সুরক্ষিতা।”(৫৫:৭২)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৭৩)
“তাদেরকে জান্নাতিদের পূর্বে কোন মানুষ অথবা জ্বিন স্পর্শ করেনি।”(৫৫:৭৪)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?”(৫৫:৭৫)
“তারা সবুজ বালিশে ও সুন্দর কারুকার্য খচিত দুর্লভ গালিচার উপর হেলান দেয়া অবস্থায় থাকবে।”(৫৫:৭৬)
“কাজেই তোমরা তোমাদের রবের কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” ৫৫:৭৭)
“কত বরকতময় আপনার রবের নাম যিনি মহিমাময় ও মহানুভব!”(৫৫:৭৮)
এই আয়াতগুলোতে জান্নাতের আরো কিছু নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। পার্থিব জীবনের একটি নেয়ামত হচ্ছে স্ত্রী। হালাল ও বৈধ উপায়ে কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করা এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা এই নেয়ামত দান করেছেন। কিন্তু এমন বৈধ নেয়ামত থাকতে বহু মানুষ অন্যায় ও হারাম উপায়ে তাদের প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। আরেক দল মানুষ আছে যারা উগ্রপন্থা ও বাড়াবাড়ির পথ অনুরসণ করে মনে করে পার্থিব জীবনে বিয়ে করারই দরকার নেই। তারাও বিবাহ করার বৈধ রীতি পরিত্যাগ করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।
এই আয়াতগুলোতে জান্নাতের অন্যতম নেয়ামত হিসেবে এমন উত্তম চরিত্রবতী স্ত্রীগণের কথা বলা হয়েছে যারা অপরূপ সুন্দরী এবং তারা বিলাসবহুল ও সুসজ্জিত প্রাসাদে অবস্থান করছে। মানুষ ও জিনরূপী এসব নারী তাদের মনভোলানো কথা ও আচরণ দিয়ে জান্নাতবাসীর মন জয় করে নেবে। এসব নারীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হবে জান্নাতবাসীর আগে তাদেরকে কোনো মানুষ অথবা জিন স্পর্শ করেনি। তাদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে জান্নাতবাসী স্বামীদের জন্য। কাজেই তাদেরকে পরপুরুষের দৃষ্টি ও আয়ত্বের বাইরে রাখা হয়েছে।
সূরা আর-রহমানে প্রথম অংশে পার্থিব জগতে প্রদত্ত নেয়ামত ও দ্বিতীয় অংশে পরকালীন নেয়ামতরাজি বর্ণনা করা হয়েছে। আর এসব বর্ণনার মাঝখানে বারবার মানুষ ও জিনদের কাছে এই প্রশ্ন করা হচ্ছে যে, তোমরা এসব নেয়ামতের কোনটি অস্বীকার করতে পারবে? যদি না পারো তাহলে এসব নেয়ামত উপভোগ করা সত্ত্বেও কেনো তোমার আল্লাহ তায়ালার শোকরগুজার ও কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হচ্ছো না? নিঃসন্দেহে এসব নেয়ামত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে রয়েছে অসংখ্য-অগণিত রহমত ও বরকত। যে আল্লাহ দয়ালু, মহানুভব ও মহিমাময় তিনিই তার বান্দাদেরকে ভালোবেসে এসব দান করেছেন যাতে তারা কৃতজ্ঞ হয়।
এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- পরকালে মানুষের প্রবৃত্তি ও কামনা-বাসনা পার্থিব জগতের মতোই থাকবে। সেখানে আল্লাহ তায়ালা সর্বোত্তম উপায়ে এই কামনা বাসনা চরিতার্থ করার সুযোগ দেবেন।
২- জান্নাতের সঙ্গীগণ যেমন সচ্চরিত্রের অধিকারী তেমনি অপরূপ সুন্দরী। তারা একদিকে যেমন কুমারি অন্যদিকে তাদের তেমনি বাহ্যিক বেশভুষা এমন যাতে কোনো পরপুরুষ তাদেরকে দেখতে না পায়।
৩- মহাবিশ্বের প্রতিপালক মহিমান্বিত ও মহাপরাক্রমশালী হওয়ার একইসময়ে দয়া, কল্যাণ এবং করুণার আধার।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আজকের এ আলোচনার মাধ্যমে সূরা আর-রহমানের তাফসির শেষ হলো। আগামী আসর থেকে আমরা সূরা ওয়াকিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করব। আশা করছি সে আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাব।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।