মে ২৮, ২০২৩ ১৯:৪৪ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।   গত আসরে আমরা সূরা আর-রহমানের আলোচনা শেষ করেছি। আজ থেকে আমরা সূরা ওয়াকিয়া নিয়ে আলোচনা শুরু করব।  মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় অবধারিতভাবে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া এবং কিয়ামত দিবসের ভয়াবহতার কথা বর্ণিত হয়েছে। সূরাটি শুরু হয়েছে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে এবং এরপর আল্লাহর নৈকট্যের ভিত্তিতে মানুষকে আলাদা আলাদা দলে বিভক্ত করা হয়েছে। তো প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

إِذَا وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ (1) لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ (2) خَافِضَةٌ رَافِعَةٌ (3) إِذَا رُجَّتِ الْأَرْضُ رَجًّا (4) وَبُسَّتِ الْجِبَالُ بَسًّا (5) فَكَانَتْ هَبَاءً مُنْبَثًّا (6) 

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”

“যখন সেই অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটি [অর্থাৎ কিয়ামত] সংঘটিত হবে।” ( ৫৬:১)

“এর সংঘটন মিথ্যা কিছু নয় [এবং এটিকে অস্বীকার করার কিছু নেই]।” ( ৫৬:২)

“[অবশ্যম্ভাবী ঘটনাটি কাফেরদের] নীচু করবে এবং [মুমিনদের] করবে সমুন্নত।”( ৫৬:৩)

“যখন পৃথিবী প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে।”( ৫৬:৪)

“এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে।”( ৫৬:৫)

“অতঃপর তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত হবে।”( ৫৬:৬)

পরকাল এমন একটি বিষয় যাকে বহু মানুষ নানারকম উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে। তারা কিয়ামতকে একটি অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে করে। এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে, যখন কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আলামত শুরু হয়ে যাবে তখন তারা আর তা অস্বীকার করবে না কিন্তু ওই স্বীকারোক্তি তাদের কোনো কাজে আসবে না। কারণ, তখন মানুষের আমলনামায় নতুন কিছু অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকবে না বরং পার্থিব জীবনের কৃতকর্ম অনুযায়ী মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। পূণ্যবানরা সেদিন সম্মানিত হবেন এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। আর পাপী ব্যক্তিরা চরম অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।

এরপর পার্থিব জীবনের সমাপ্তি এবং কিয়ামত দিবস শুরু হওয়ার মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলছেন: তখন ভয়াবহ ভূমিকম্পে সারা পৃথিবী প্রকম্পিত হয়ে উঠবে এবং বিশাল বিশাল পর্বতমালা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং আকাশ-বাতাসজুড়ে থাকবে শুধু বিক্ষিপ্ত ধুলিকণা। 

এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- কিয়ামত সংঘটিত হবেই কারণ, এর খবর জানাচ্ছেন বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ। কিয়ামত শুধু তারাই অস্বীকার করে যাদের ওই ভয়াবহ দিনের জন্য কোনো প্রস্তুতি নেই।

২- কিয়ামত দিবসের ব্যবস্থাপনা হবে পার্থিব জগতের তুলনায় আলাদা। পার্থিব জগতে ধন-সম্পদ ও প্রভাব-প্রতিপন্নসম্পন্ন বহু মানুষ সেদিন চরম অপমানিত হবে।

৩- কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার মুহূর্তে ভূপৃষ্ঠ প্রচণ্ড রকম কেঁপে উঠবে। আল্লাহর ইচ্ছায় বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার অবসান ঘটবে এবং একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা চালু হবে।  (তাওয়াশিহ)

وَكُنْتُمْ أَزْوَاجًا ثَلَاثَةً (7) فَأَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ (8) وَأَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ مَا أَصْحَابُ الْمَشْأَمَةِ (9) وَالسَّابِقُونَ السَّابِقُونَ (10) أُولَئِكَ الْمُقَرَّبُونَ (11) فِي جَنَّاتِ النَّعِيمِ (12) ثُلَّةٌ مِنَ الْأَوَّلِينَ (13) وَقَلِيلٌ مِنَ الْآَخِرِينَ (14)

এবারে সূরা ওয়াকিয়ার ৭ থেকে ১৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

আর [সেদিন] তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন দলে।” ( ৫৬:৭)

“সুতরাং [প্রথম দল হবে] সৌভাগ্যবান, সৌভাগ্যবান দলটি কতই না ভাগ্যবান।”( ৫৬:৮)

“আর [দ্বিতীয় দলটি] দুর্ভাগ্যবান, দুর্ভাগ্যবান দলটি কতই না দুর্ভাগা!”( ৫৬:৯)

“আর [তৃতীয় দলটি নেক কাজে] অগ্রগামী [এবং পুরস্কার গ্রহণেও] অগ্রগামী।”( ৫৬:১০)

“তারাই [আল্লাহ তায়ালার] নৈকট্যপ্রাপ্ত।”( ৫৬:১১)

“তারা থাকবে নেয়ামতপূর্ণ উদ্যানসমূহে।”( ৫৬:১২)

“তাদের বহু সংখ্যক হবে পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে [যারা অতীতের নবী-রাসূলদের প্রতি ঈমান এনেছিল।””( ৫৬:১৩)

“এবং অল্প সংখ্যক হবে শেষ [নবীর] উম্মত [যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে।””( ৫৬:১৪)

সূরা ফাতিরের ৩২ নম্বর আয়াতের মতো এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে, কিয়ামতের দিন মানুষকে তিন দলে বিভক্ত করা হবে। তাদের প্রথম দলভুক্ত মানুষ নিজেদের ঈমান ও সৎকাজের মাধ্যমে সৌভাগ্যবান হবে অর্থাৎ জান্নাতের অসীম নেয়ামতের অধিকারী হবে। দ্বিতীয় দলে থাকবে অপরাধী ব্যক্তিরা যারা তাদের কুফরি, জুলুম ও গোনাহের কারণে দুর্ভাগায় পরিণত হয়েছে। জাহান্নামে যাওয়ার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। তবে তৃতীয় দলে থাকবেন সৎকর্মশীল ঈমানদার মানুষেরা। তারা নেক ও সৎকর্মশীল বান্দাদের অনুকরণীয় আদর্শ। তারা আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দা। নবী-রাসূল, ইমাম ও আউলিয়াগণ এই দলের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।

আল্লাহ ও পরকালের প্রতি তাঁদের ঈমান সর্বোচ্চ পর্যায়ের; তাঁরা উত্তম নৈতিক চরিত্রের অধিকারী এবং মানুষের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা ন্যায়পূর্ণ ও উদার আচরণ করেন। ইবাদত, বীরত্ব, ন্যায়বিচার, ক্ষমাসহ সকল ঐশী ও মানবীয় গুণাবলীতে তাদের জুড়ি নেই এবং দ্বীনের প্রয়োজনে তারা নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হন না। সৃষ্টির শুরু থেকে এই বৈশিষ্ট্যের মানুষ ছিল, এখনও আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। অতীত নবী-রাসূলদের অনুসরণ করে বহু মানুষ জান্নাত লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছে আবার বহু মানুষ শেষ নবীর উম্মত হয়েও তাঁর প্রতি ঈমান না আনায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।

এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে:

১- প্রকৃত ও চিরস্থায়ী সৌভাগ্য কেবলমাত্র পরকালেই অর্জন করা সম্ভব হবে।

২- সৎকাজ আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উপায়। আর সৎকাজে অপরের চেয়ে এগিয়ে থাকার মর্যাদা আল্লাহর কাছে আরো বেশি। পার্থিব জগতে যারা সৎকাজে পরস্পরে প্রতিযোগিতা করেছে তারা পরকালে পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে হবে সবচেয়ে অগ্রগামী।

৩- জান্নাত হচ্ছে মুমিনদের সফলতা অর্জনের স্থান। তবে জান্নাতবাসী বস্তুগত সব নেয়ামতে পরিপূর্ণ থাকলেও তাদের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার হবে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ।

এবারে সূরা ওয়াকিয়ার ১৫ থেকে ১৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

عَلَى سُرُرٍ مَوْضُونَةٍ (15) مُتَّكِئِينَ عَلَيْهَا مُتَقَابِلِينَ (16) يَطُوفُ عَلَيْهِمْ وِلْدَانٌ مُخَلَّدُونَ (17) بِأَكْوَابٍ وَأَبَارِيقَ وَكَأْسٍ مِنْ مَعِينٍ (18) لَا يُصَدَّعُونَ عَنْهَا وَلَا يُنْزِفُونَ (19

“স্বর্ণখচিত আসনে।”( ৫৬:১৫)

“তারা হেলান দিয়ে বসবে, পরস্পর মুখোমুখি হয়ে।”( ৫৬:১৬)

“তাদের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে চির-কিশোরেরা।”( ৫৬:১৭)

“পানপত্র, জগ ও [প্রস্রবণ নিঃসৃত সুরাপূর্ণ] পেয়ালা নিয়ে [তারা জান্নাতবাসীকে আপ্যায়ন করবে]।”( ৫৬:১৮)

“সেই [সুরা] পানে তাদের মাথাব্যথা হবে না, তারা জ্ঞান-হারাও হবে না।”( ৫৬:১৯)

এই আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসীর আনন্দ ও সুখময় জীবনের বর্ণনা দিয়ে বলা হচ্ছে: জান্নাতবাসী পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে আলাদা আলাদা জীবনযাপন করবে না বরং তাদের মধ্যে একত্রে মিলিত হওয়ার এবং সেখানে একসঙ্গে পানাহার করার ব্যবস্থা থাকবে। তারা স্বর্ণখচিত আসনে উপবিষ্ট হয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলাপচারিতায় সময় কাটাবে। মহান আল্লাহ জান্নাতবাসীকে আপ্যায়নের জন্য সুদর্শন যুবকদের ব্যবস্থা রাখবেন। তারা নানা ধরনের খাবার ও পানীয় দিয়ে জান্নাতবাসীকে আপ্যায়ন করবে। এসব সুস্বাদু পানীয় খেলে পার্থিব জীবনের মদের মতো কেউ জ্ঞানহারা হয়ে যাবে না।

এই আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- জাহান্নামবাসীরা পরস্পরকে ভর্ৎসনা করবে কিন্তু জান্নাতবাসীরা একসঙ্গে বসে পরস্পরে গল্পগুজব করবে এবং জান্নাতি আহার গ্রহণ করে ন্য হবে।

২- পার্থিব জগতের খাদ্য ও পানীয়তে অনেক সময় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। কিন্তু জান্নাতি খাবারে আনন্দ ও সুখানুভূতি ছাড়া অন্য কিছু থাকবে না।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  #

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।