জুন ০৬, ২০২৩ ১৯:৪১ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।  আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা ওয়াক্বিয়া নিয়ে আলোচনা শেষ করেছিলাম। আজ থেকে আমরা এর পরের সূরা অর্থাৎ সূরা হাদিদের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুরু করব। মদীনায় অবতীর্ণ এ সূরায় ২৯টি আয়াত রয়েছে। সূরাটির ২৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের মধ্য থেকে লোহা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বলে সূরাটির নাম দেয়া হয়েছে লোহা বা হাদিদ।

লোহা হচ্ছে বল ও শক্তির প্রতীক।  লোহা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একথা বোঝানো হয়েছে, সমাজে নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করতে হবে।  প্রথমেই সূরা হাদিদের ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

 بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (1) لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (2) هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآَخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (3)

“আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।  আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (৫৭:১)

“আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই; তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান; আর তিনিই সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।””( ৫৭:২)

“তিনিই আদি, অন্ত, ব্যক্ত ও গুপ্ত এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।”” (৫৭:৩)

সূরা ফাতিহার মতো কিছু সূরা আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে শুরু হয়েছে এবং সূরা হাদিদের মতো কিছু সূরা শুরু হয়েছে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করে। তবে সমস্ত কুরআনে তাসবিহ বা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহীমা শব্দটি হামদ বা প্রশংসা শব্দের চেয়ে বেশিবার এসেছে। সূরা হাদিদসহ আরো বেশ কিছু সূরার শুরুতে একথা বলা হয়েছে যে, জড়, জীব, গাছপালা ও মানুষসহ সৃষ্টিজগতের সকলে আল্লাহ তায়ালার তাসবিহ পাঠ করে। আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করার অর্থ হচ্ছে এই মহান সত্ত্বাকে সব ধরনের অজ্ঞতা, অক্ষমতা ও দোষত্রুটি থেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা। নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতের এত সব সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞান, ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার নিদর্শন বহন করে এবং সব ধরনের দোষত্রুটি থেকে এই পবিত্র সত্ত্বার মুক্ত থাকার প্রমাণ দেয়।  বিশ্বের সকল সৃষ্টি সারাক্ষণ তাসবিহ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর এই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে যাচ্ছে যদিও আমাদের পক্ষে তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই আয়াতগুলোতে বিশ্বজগতের ওপর আল্লাহর কর্তৃত্বের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই কর্তৃত্বের অর্থ হচ্ছে গোটা সৃষ্টিজগত তার পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- এই সুবিশাল সৃষ্টিজগত মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার নিদর্শন বহন করে এবং তাঁর সৃষ্টিতে যে কোনো ত্রুটি নেই তারও জানান দেয়।

২- বিশ্বজগতের প্রকৃত মালিকানা আল্লাহ তায়ালার। কাজেই আমাদেরকে সামান্য যা কিছুর মালিক বানানো হয়েছে তা নিয়ে যেন আমরা অহংকার না করি।

৩- কেউ কেউ মনে করতে পারে আল্লাহর মতো তারও জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের জীবন ও মৃত্যু তাঁরই হাতে এবং আমরা তাঁর মতো আদি ও অন্ত নই।

এবারে সূরা হাদিদের ৪ থেকে ৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (4) لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ (5) يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَهُوَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ (6)

“তিনিই ছয় দিনে [ও পর্যায়ে] আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর [কুদরতের] আরশে সমাসীন হয়েছেন।  যা কিছু ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা কিছু তা থেকে উদগত হয় এবং আকাশ হতে যা কিছু নামে ও আকাশে যা কিছু উত্থিত হয় [তার সবকিছু] তিনি জানেন। তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন এবং তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।” ”” (৫৭:৪)

“আসমানসমূহ ও যমীনের সর্বময় কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে সব বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।””” (৫৭:৫)

“তিনিই রাতকে দিনে প্রবেশ করান আর দিনকে প্ৰবেশ করান রাতে এবং তিনি অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত।””” (৫৭:৬)

পবিত্র কুরআনের ঘোষণা অনুযায়ী, আমরা যে বিশাল সৃষ্টিজগত দেখতে পাই তা ছয়টি দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে সৃষ্টি করা হয়ছে। মহান আল্লাহ সৃষ্টির যে বিধান নির্ধারণ করেছেন তারই ভিত্তিতে তিনি ক্রমান্বয়ে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। কেউ কেউ ভুল করে একথা ভাবেন যে, আল্লাহ তায়ালা ঘড়ির মতো বিশ্বজগত তৈরি করে তাতে দম দিয়ে দিয়েছেন এবং এখন সেই দমে আপনাআপনি তা পরিচালিত হচ্ছে। বিষয়টি মোটেই এমন নয়। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করার পর বিশ্বজগত পরিচালনার দায়িত্বও নিজে নিয়েছেন।  এই জগতের সমস্ত ব্যবস্থাপনা এবং আসমানসমূহ ও জমিনে ছোট-বড় যত ঘটনা ঘটে তার সবই আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার অধীনে সংঘটিত হয়।

তিনি তার সকল সৃষ্টির সঙ্গে আছেন। তিনি শুধু তাঁর বান্দাদের কৃতকর্মই দেখতে পান না সেইসঙ্গে বান্দাদের অন্তরে কি আছে এবং তারা কী করতে চায় সে সম্পর্কেও সম্যক অবহিত। এছাড়া, দিন-রাতের সৃষ্টি এবং দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য কমিয়ে ও বাড়িয়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন ঋতুর উৎপত্তি তিনিই ঘটান। নিঃসন্দেহে ঋতুর বৈচিত্র বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার একটি বড় অনুগ্রহ।  দিন ও রাতের সৃষ্টি হয় ধীরে ধীরে যা আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞার পরিচায়ক। সৃষ্টিজগত যেন রাতের অন্ধকার থেকে আস্তে আস্তে আলোর জগতে প্রবেশ করে এবং সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে আবার আলো থেকে অন্ধকারে প্রবেশ করতে পারে সেজন্য এই প্রক্রিয়ায় ধীরগতির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞার কারণে বিশ্বজগত দীর্ঘ সময় ধরে আস্তে আস্তে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে এর পরিবর্তনগুলিও হচ্ছে ক্রমান্বয়ে; হঠাৎ করে নয়।

২- মহান আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল।

৩- মানুষের বাহ্যিক কাজকর্মের পাশাপাশি আল্লাহ যে তার অন্তরের খবরও রাখেন এই বিশ্বাস থাকলে মানুষ নিজের চরিত্রকে সমুন্নত রাখতে উদ্বুদ্ধ হবে।

এবারে সূরা হাদিদের ৭ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

آَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَنْفِقُوا مِمَّا جَعَلَكُمْ مُسْتَخْلَفِينَ فِيهِ فَالَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَأَنْفَقُوا لَهُمْ أَجْرٌ كَبِيرٌ (7) وَمَا لَكُمْ لَا تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالرَّسُولُ يَدْعُوكُمْ لِتُؤْمِنُوا بِرَبِّكُمْ وَقَدْ أَخَذَ مِيثَاقَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ (8) هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ عَلَى عَبْدِهِ آَيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَإِنَّ اللَّهَ بِكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (9)

“তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় কর। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও ব্যয় করে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” (৫৭:৭)

“আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর উপর ঈমান আন না? অথচ রাসূল তোমাদেরকে তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আনার জন্য আহ্বান করছেন। আর আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।”(৫৭:৮)

“তিনিই তাঁর বান্দার [অর্থাৎ রাসূলের] প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেন যাতে তোমাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে আনতে পারেন।  আর নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু।”(৫৭:৯)

ঈমান শুধু অন্তরে উপলব্ধি ও মুখে উচ্চারিত কিছু শব্দ বা বাক্যের নাম নয়। বরং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত করণীয় কর্তব্যগুলি পালন করা এবং তিনি যা কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকার নাম ঈমান।  এই আয়াতগুলোতে ঈমানদারদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো অর্থাৎ তাঁদের নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করো। এসব নির্দেশের একটি হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা। পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তোমরা যেসব সম্পদের অধিকারী হয়েছো তা থেকে খরচ করো। একদিন তোমরা থাকবে না এবং তখন এই সম্পদ তোমাদের অধঃস্তন পুরুষদের হাতে চলে যাবে।

কাজেই তোমরা যদি ঈমানের দাবি করো তাহলে তিনি তাঁর কিতাবে তোমাদের কাছ থেকে যে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন তা পালন করো। কুরআন হচ্ছে হিদায়াতের এমন কিতাব যা মানুষের অন্তর থেকে অজ্ঞতা, জুলুম ও কফুরের অন্ধকার দূরীভূত করে এবং সেখানে ঈমান, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আলো জ্বালিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে মানুষ যদি কুরআনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সত্য পথে পা ফেলে তাহলে সে আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমত অর্জন করতে সক্ষম হয়।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

১- আল্লাহর সৃষ্টির প্রয়োজন মেটানোর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে যদি কেউ শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাবি করে তবে সে মিথ্যা বলেছে।

২-  নবী-রাসূলগণ মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন নিজেদের দিকে নয়।  এ আহ্বান জানাতে গিয়ে তাঁদের অনেকে শহীদ হয়েছেন।

৩- অজ্ঞতা, কুসংস্কার, শিরক ও কুফর থেকে মুক্ত হয়ে আলোকিত পথ পাওয়ার একমাত্র উপায় পবিত্র কুরআনের আশ্রয় নেওয়া।

৪- নবী-রাসূল ও আসমানি কিতাব পাঠিয়ে মানুষকে হেদায়েতের দিকে আহ্বান জানিয়ে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির প্রতি অনেক বড় অনুগ্রহ করেছেন।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  #

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ