জুন ১১, ২০২৩ ১৯:৩৭ Asia/Dhaka

'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক গত পর্বের আলোচনায় আমরা ইরানের চবাহার বন্দরের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজকেও আমরা এ বিষয়ে আরো আলোচনা করব।

আয়তনের দিক দিয়ে অন্যান্য সড়কের চেয়ে ইরানের এই করিডোর ব্যবহার করলে যেমন ৪০ শতাংশ সময় বাঁচবে তেমনি প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় কমে আসবে। এই বন্দরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পণ্য সরবরাহ এবং ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখা ছাড়াও মাত্র ৩০০ কিলোমিটার অদূরে ইরানের ম্যাকরন বন্দরের গুরুত্বও বহুগুণে বেড়ে যাবে। ম্যাকরন হচ্ছে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সামরিক ঘাঁটি। এই ঘাঁটিকে ব্যবহার করে ইরান পারস্য উপসাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরসহ অন্য আন্তর্জাতিক সমুদ্র অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে নৌমহড়া চালিয়েছে। এ অঞ্চলে চলাচলকারী জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ইরানের প্রধান লক্ষ্য। চীনের প্রস্তাবিত নতুন সিল্করোড প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্যও এ অঞ্চলের পানি সীমায় ইরানের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে পাকিস্তানের গোয়াদার ও ইরানের চবাহার সমুদ্র বন্দরকে আরো সক্রিয় করার জন্য দুদেশের পানি সীমার নিরাপত্তা জোরদার করা খুবই জরুরি।

কিছুদিন আগেও পাকিস্তানের গোয়াদার সমুদ্র বন্দর উপকূল এলাকা ছিল গ্রাম এলাকা। বেশ কিছু গ্রাম নিয়ে বিশাল ওই এলাকার জনগণ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। ইরানের ম্যাকরন উপকূল পাকিস্তানের ওই এলাকার একেবারে পাশেই অবস্থিত। সমগ্র ওই বন্দর এলাকাটি এক সময় ২০০ বছর ধরে ওমানের শাসনের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে গোয়াদার বন্দরের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। বিশেষ করে ভারতের নৌসেনারা করাচি অবরুদ্ধ করে ফেললে ওই শহর পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী করাচি বন্দরে কৌশলগত দুর্বলতার বিষয়টি বুঝতে পেরে গোয়াদার সমুদ্র উপকূলের দিকে তাদের নজর পড়ে এবং ওই এলাকায় তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেয়। গোয়াদার উপকূল করাচি থেকে অন্তত ৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ ছাড়া, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর পর গোয়াদার বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায় এবং ওই এলাকায় উন্নয়ন কাজে চীন বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। 

দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক ইরানের বিশেষজ্ঞ হেসাম উদ্দিন হুজ্জাত যাদেহ বলেছেন, জেলেদের কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত পাকিস্তানের এই গোয়াদার এলাকাটি খুব শিগগিরি মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের কেন্দ্রে পরিণত হবে। ধারণা করা হচ্ছে চীন ও পাকিস্তানের নৌবাহিনী গোয়াদারে যৌথ নৌঘাঁটি নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌসেনাদের মোকাবেলায় এবং করাচি উপকূলীয় এলাকা রক্ষায় পাকিস্তান অনেক শক্তিশালী অবস্থান পৌঁছে যাবে।

অন্যদিকে চীনও লাভবান হবে। কেননা গোয়াদার বন্দরের মাধ্যমে চীন সহজেই ভারত মহাসাগর থেকে হরমুজ প্রণালীতে প্রবেশ করতে পারবে এবং সহজে আরব দেশগুলো থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারবে। এ ছাড়া ভারত মহাসাগরেও নজরদারি শক্তিশালী করতে পারবে চীন। চীনের অর্থনৈতিক তৎপরতার কারণে ইরানের চবাহার বন্দরের গুরুত্বও বহুগুণে বেড়ে যাবে।

চাবহার বন্দর

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইরানের চবাহার এবং পাকিস্তানের গোয়াদার সমুদ্র বন্দরের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার অর্থ এ নয় যে প্রতিবেশী এই দুই দেশ আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। চীন ছাড়াও আরো অনেক দেশ চবাহার ও গোয়াদার বন্দরে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। ওমান, কাতার ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলো তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিকেল খাত নির্মাণে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া ইরানের চবাহার বন্দরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে।

তাই বলা যায়, ম্যাকরন সমুদ্র উপকূলে চবাহার ও গোয়াদার বাণিজ্য বন্দর যদি পরস্পরকে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যায় তাহলে অযথা প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে না বরং চীনের প্রস্তাবিত সিল্করোড প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজতর হবে এবং সবাই উপকৃত হবে। এ কারণে ইরানের কর্মকর্তারা বহুবার বলেছেন, আঞ্চলিক উন্নয়নে ইরান ও পাকিস্তানের এই দুই বন্দরের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

চীনের প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায় রয়েছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' যা কিনা চীনের মুসলমান অধ্যুষিত শিন জিয়াং প্রদেশের কাশগড় এলাকা থেকে শুরু হয়েছে এবং তা বিতর্কিত কাশ্মির উপত্যকা পার হয়ে গোয়াদার সমুদ্র বন্দরে গিয়ে শেষ হয়েছে। সিল্করোডের আওতায় এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৫৬টি দেশ যুক্ত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দিতে চীন ও আমেরিকা প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে পরিণত হতে পারে। তাদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রভাব ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগর এলাকায়ও পড়তে পারে। কেননা পারস্য উপসাগরীয় এলাকা হচ্ছে তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার। হরমুজ প্রণালীর মধ্য দিয়ে ওমান সাগর ও আরব সাগর পার হয়ে এসব জ্বালানি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বাজারগুলোতে প্রবেশ করে। এই অঞ্চলের গুরুত্বের কারণে চীন ও আমেরিকা এখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে চলেছে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর এবং ইরানের চবাহার বন্দর। 

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থাৎ চীন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যে সর্বাত্মক সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে উঠবে। এই চতুর্পক্ষীয় সহযোগিতার প্রভাব পড়বে দক্ষিণ এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও। এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও বিপুল জনশক্তি বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নে অভাবনীয় ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে সিল্করোডের সাথে ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে। এ কারণে সিল্করোডের সঙ্গে যুক্ত অঞ্চলকে 'নওরোজ এলাকা' হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। সমগ্র এই অঞ্চলের সাথে ইরানি সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ফার্সি ভাষার ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি এ পথ দিয়েই ইসলাম ধর্ম প্রাচ্যে প্রবেশ করেছে।

এ কারণে ফের সিল্করোডের পুনরুজ্জীবন ইরানের সঙ্গে প্রাচ্যের দেশগুলোর সম্পর্ক জোরদারে আবারো সুযোগ এনে দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ