পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখা ছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়
সুখের নীড়-৫২ (ইসলাম, মিডিয়া, আধুনিকতা ও পরিবার)
ব্যক্তি,পরিবার ও সমাজের সুস্থতা আর উন্নয়নে পরিবারের ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরার লক্ষ্যে সুখের নীড় অনুষ্ঠানে আমরা এতদিন ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার ব্যবস্থার গুরুত্ব, যোগ্য নাগরিক ও সুসন্তান প্রতিপালনে পরিবারের অসাধারণ ভূমিকা, দক্ষতা, দায়িত্ব ও গুরুত্ব এবং স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক স্থায়ী করার গুরুত্ব ও তা অর্জনের নানা কৌশল ও এ সংক্রান্ত দায়িত্বশীলতা নিয়ে কথা বলেছি।
পরিবার মানবজাতির প্রাচীনতম প্রথা ও প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ধরনের নানা পরিবর্তনের ফলে পরিবার ব্যবস্থা নানা হুমকির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও মানব সমাজের সুস্থতা, সুশিক্ষার বিস্তার ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য পরিবারের ভূমিকা এখনও আগের মতই গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর রয়ে গেছে। তাই এ অনুষ্ঠানে সুস্থ ও সুখী পরিবার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের এবং ইরানি সমাজ-ব্যবস্থার পরিবার বিষয়ক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও দিক-নির্দেশনার নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীদের নানা অভিমত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ। এ ধারাবাহিকের শেষ পর্বেও প্রাসঙ্গিক আরও ক'টি কথা ও উপসংহার তুলে ধরব।
আধুনিকতা বা আধুনিকায়নের প্রভাব বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলের মত ইরানি সমাজে ও ইরানি পরিবারগুলোতেও নানা সমস্যা সৃষ্টি করেছে। যেমন, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশাল মিডিয়া তথা সাইবার জগতও এখন আধুনিকতার বাহন হিসেবে পরিবারের জন্য বড় ধরনের নানা চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ইরানি যুবক যুবতিদের মধ্যে অনেক দেরিতে বা বেশি বয়সে বিয়ে করার প্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রকামিতা এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক নানা প্রত্যাশার ধরণ! বাড়ছে তালাক ও বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক। আর এসবের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ইন্টারনেট ও সাইবার জগতের!
তাই পরিবারের সদস্যদেরকে এখন আরও বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। সাইবার মিডিয়াগুলোর নানা নেতিবাচক দিক উপেক্ষা করে এসব মিডিয়াকে আধুনিক জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে মেনে নিয়েই স্বাভাবিক পারিবারিক জীবন অব্যাহত রাখার কৌশল রপ্ত করতে হবে পরিবারের সদস্যদেরকে। অতীতের পরিবারগুলোর মতই পরিবারে বজায় রাখতে হবে প্রেম-প্রীতি, সহনশীলতা, সুশিক্ষা, সুসন্তান গড়ার দৃঢ়-সংকল্প, নানা সংকট মোকাবেলায় পারস্পরিক সহযোগিতা, ত্যাগ ও ক্ষমাশীলতা ইত্যাদি।
নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অন্য অনেক দেশের মত ইসলামী ইরানেও টিকে আছে পরিবার প্রথা। ইরানি সমাজে এখন পরিবার গঠনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুসহ নানা ইস্যুতে নারীর মতামতও বেশ গুরুত্ব পায়। ইরানি পরিবারগুলোতে এখন নারী ও পুরুষের ভূমিকা মোটামুটি সমান বা অংশীদারিত্বমূলক এবং পুরুষের বলদর্পিতার পরিবর্তে অনেক ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ও অধিকারই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। পুরুষ ও নারী একইসঙ্গে সফরে যাচ্ছেন।
অথচ অতীতে সফরে কেবল পুরুষ সদস্যরাই যেতেন! ইরানি দম্পতিরা এখনও সন্তান নিচ্ছেন এবং সন্তানের নৈতিক ও সামাজিক শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইরানি বাবা-মায়েরা এখনও কম বয়স্ক ও বয়স্ক সন্তানকে সহায়তা দিয়ে থাকেন বেশ জোরালোভাবে, তাদেরকে সময় দিচ্ছেন এবং তাদের পারস্পরিক আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের কারণেই ইরানি পরিবারগুলো টিকে আছে আজো বেশ দৃঢ়তা নিয়েই। ইসলাম পবিত্র পরিবার ব্যবস্থা রক্ষা করাকে সামাজিক সুস্থতার নিয়ামক হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
ইসলাম পরিবারকে কেবল প্রেম, বন্ধুত্ব ও স্নেহের ছায়ায় মানুষের বস্তুগত বা বৈষয়িক সুখের মাধ্যম হিসেবেই দেখে না, ইসলাম পরিবারকে আধ্যাত্মিক প্রশান্তির জন্যও গুরুত্ব দেয়। ইসলাম পরিবারের সদস্যদের অধিকার রক্ষা ও তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। স্বামী ও স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও অধিকারের সীমানাগুলোও তুলে ধরেছে পবিত্র কুরআন। পরিবার যাতে টিকে থাকে সে জন্য বাবা মা যখন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা হয়ে পড়েন তখনও দাদা দাদী হিসেবে সক্রিয় ও সচেষ্ট থাকেন। দুঃখজনক ব্যাপার হল আধুনিকতার অনেক কাঠামো পশ্চিমা সমাজের পরিবারগুলোতে নানা সংকট সৃষ্টি করছে। সেখানে সুস্থ জীবনের নানা মূল্যবোধ উপেক্ষিত। ফলে পরিবারগুলো ধ্বসে পড়ছে এবং সেখানে দেখা দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও নৈরাজ্য। ফলে পশ্চিমা সমাজবিদরা আবারো পরিবার প্রথাকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিচ্ছেন। একমাত্র ঈমান বা বিশ্বাসের ছায়াতলেই পারিবারিক মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
পরিবার প্রথা টিকিয়ে রাখা ছাড়া সভ্যতা ও সংস্কৃতির চাকাকে অগ্রগতির দিকে নেয়া সম্ভব নয় এবং সম্ভব নয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুফলকে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর কাছে পৌঁছে দেয়া। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির ভাষায় : শরীরের কোষগুলো রোগাক্রান্ত হলে গোটা শরীর যেমন অসুস্থ হয়ে পড়ে তেমনি পরিবারগুলো সুস্থ না হলে গোটা সমাজই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মতে ব্যক্তিকে যোগ্য নাগরিক ও সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে যথাসম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় কাজে লাগানো জরুরি। দম্পতিদেরকে সৌভাগ্য আর উন্নতির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সঠিক ও পরিপূর্ণ মানবীয় গুণগুলো হয় বিকশিত। তারা যদি যোগ্য ও ইমানদার নাগরিক গড়ে তুলতে না পারেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে গড়ে উঠবে না। এ অবস্থায় উচ্চতর লক্ষ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলো অর্জনেও ব্যর্থ হবে নতুন প্রজন্ম। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।