জুলাই ০১, ২০২৩ ১৬:৫৭ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা আব্বাসিয় শাসনামলের দু'জন ইরানি মনীষী ও চিকিৎসক আবু যাকারিয়া ইয়াহিয়া বিন মাসভিয়ে খোজি এবং সাইয়্যেদ ইসমাইল জোরজানির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা প্রকৃতি বিজ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করব।

মৌলিক বিজ্ঞানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে জীববিজ্ঞান। এটি এমন এক বিজ্ঞান যা প্রাণীর জীবনপ্রণালী নিয়ে কাজ করে। জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার কারণে প্রকৃতির বহু রহস্য বা তথ্য উদ্ঘাটিত হয়। এই তথ্যগুলোর মধ্যে বংশগতির বিষয় থেকে শুরু করে অণু-পরমাণু, জীব দেহের টিস্যু এবং ক্লোনিং পদ্ধতির মতো বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ক্লোন হল কোন জীব বা কোষ বা বৃহৎ জৈব অণুর হুবুহু নকল। কোন জীবের একটি দেহকোষ হতে হুবুহু ওই জীবটিকে পুনরায় তৈরি করার পদ্ধতি ক্লোনিং নামে পরিচিত।

জীববিজ্ঞান এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Biology, যেটি দুটি গ্রিক শব্দ (bios) বাইওস যার অর্থ জীবন এবং (logia) লোজিয়া যার অর্থ জ্ঞান থেকে এসেছে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তির যুগে জীববিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতি হয়েছে কিন্তু এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা বহুকাল ধরে চলে আসছে। প্রায় ১২ হাজার বছর আগে, মানুষ খাদ্যের জন্য গাছপালা লাগানো ও ফসল চাষ এবং জীবনকে আরো সহজ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পশু পালন শুরু করে।

জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রথম গুরুত্ব পায় সেটা হচ্ছে এ থেকে রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি বের করা। বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ের জন্য স্থানীয় চিকিৎসক ও জাদুকররা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিকিৎসার পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন গাছ গাছড়ার সমম্বয়ে তৈরি ভেষজ ওষুধ দিয়ে রোগ সারানো এবং এর সাথে ছিল অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রতি প্রার্থনার সংমিশ্রণ যা কোনো গবেষণা ছাড়াই তারা কেবল অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন করেছিল। মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রিক, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং চীনের প্রাচীন সভ্যতায় প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানের চর্চা ছিল। তবে, আধুনিক প্রকৃতি ও জীববিজ্ঞানের শেকড় নিহীত রয়েছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার মধ্যে। ওষুধ সংক্রান্ত গবেষণার ইতিহাস অনুসন্ধান করতে হলে খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে ফিরে যেতে হবে। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর গ্রিক বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল জীববিজ্ঞানের বিকাশে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন। প্রাণীজগতের ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি এবং জীবনচক্রের কারণ প্রভৃতি বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা চালান তিনি। অ্যারিস্টটল অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা ছাড়াই সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রাণীজগতকে শ্রেণীবিন্যাস করেছেন।  ১৭ শতকের শেষের দিকে, হল্যাণ্ডের কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন ভ্যান লিউয়েনহোক। তিনি লেন্স কাটার হিসাবে কাজ করতেন। মাইক্রোস্কোপ ছিল তারই আবিস্কার। তখন এর সাহায্যে কেবল দূরের জীবন্ত প্রাণী দেখা যেত। এরপর ১৮৩০ এর দশকে স্নাইড ও শাওয়ান মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে উদ্ভিদ এবং প্রাণীসহ সব ধরণের জীবের মৌলিক কাঠামো ও একক কোষ চিহ্নিত করেছিলেন যেমনটি পরমাণুকে রসায়নের মৌলিক একক হিসেবে ধরা হয়।

১৯ শতক পর্যন্ত জীবের ওপর যে গবেষণা চালানো হতো তখন তাকে প্রাকৃতিক ইতিহাস হিসেবে অভিহিত করা হত। এটি প্রাথমিকভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৈচিত্র্য ও শ্রেণিবিন্যাস এবং সেইসাথে প্রাণীদের অস্ত্রপচার ও শারিরবিদ্যা নিয়ে গবেষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ শাখায় প্রাণীদেহের পুষ্টি, শ্বসন বা বিপাকীয় ক্রিয়া, ক্ষরণ, রেচন, জনন প্রভৃতি শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী আলোচনা করা হয়। তখনকার প্রকৃতি বা জীববিজ্ঞানীরা গবেষণায় পরীক্ষামূলক পদ্ধতির পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ পদ্ধতি অনুসরণ করতেন।

১৯ শতকে এই পদ্ধতিতে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন আসে এবং জীবের ওপর গবেষণার ধরন বদলায়। এই সময়ে, প্রকৃতি বিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের নতুন বিজ্ঞান ও গবেষণা দ্বারা আরো বিকাশ লাভ করে এবং এ সংক্রান্ত গবেষণা কাজ আজও ক্রমবর্ধমান গতিতে অব্যাহত রয়েছে। বলা যায়, ১৯ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়। বিশেষ করে প্রাণীর বিবর্তন বিষয়ে চার্লস ডারউইনের নতুন বিবর্তনবাদ তত্ত্ব হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। প্রকৃতিতে পরিবর্তন বা বিবর্তনের বিষয়টি এখন জীববিজ্ঞানের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বস্তু যা কিনা জীবের বৈচিত্র্য বোঝা এবং তা ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত অব্যাহত গবেষণা শেষ পর্যন্ত ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বকেও চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং অনেকের দৃষ্টিতে এই তত্ত্ব ছিল ভুল।

যাইহোক, ১৯ শতকের শেষের দিকে জীববিজ্ঞানের অভুতপূর্ব বিকাশ ঘটে এবং এর থেকে শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি ও বহু বিশেষজ্ঞ গড়ে ওঠে। সেইসাথে পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য গড়ে ওঠে অত্যাধুনিক গবেষণাগার।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে জীববিজ্ঞান স্থান পেয়েছে। জেনেটিক গঠন, জীবের আচরণ, ফিজিওলজি, কোষবিদ্যা, শরিরবিদ্যা প্রভৃতি জীববিজ্ঞানের অংশ। জীববিজ্ঞানের মূল নীতিগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, সমস্ত জীবন বিবর্তনের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সাধারণ উত্স থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

জীববিদ্যা নিয়ে ইরানিদের জ্ঞান সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন তথ্য জানা যায় একটি ফলকের মাধ্যমে যা  তুরস্কের বোগাজকু থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। এই ফলকটিতে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার ৩৬০ বছর আগে কিকুলিশ বা কিকুল নামে এক ব্যক্তি ঘোড়ার প্রশিক্ষণ সম্পর্কে লিখেছিলেন। বিজ্ঞানের ইতিহাসের জনক হিসেবে পরিচিত জর্জ সার্টন এই ফলকটির লেখা অনুবাদ করেছেন এভাবে যাতে লেখা ছিল, 'সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়াকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোড়া হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এরপর ঘোড়াগুলিকে একটি পশমী কম্বল দিয়ে এমনভাবে পেঁচানো হয় যাতে  ঘোড়াগুলো ঘামে, ওজন হ্রাস পায় ও সতেজ  হয়ে ওঠে এবং এই প্রাণীগুলোকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা যায়। ঘোড়া যাতে ভালোভাবে খাবার চিবিয়ে হজম করতে পারে সে জন্য বিশেষভাব পানির সাথে খড় মিশিয়ে খাওয়ানো হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই ইরানিরা ঘোড়ার প্রশিক্ষণ ও অশ্বারোহণে খুবই দক্ষ ছিল। প্রাচীন অসিরিয়সহ ইরানের অন্যান্য উপজাতিদের মধ্যে ঘোড়ার ব্যাপক ব্যবহার ছিল। জরাথুস্ট্র ধর্মাবলম্বিদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে আবেস্তা যা আবেস্তা ভাষায় রচিত। এতে ইরানিদের প্রাণিবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যার ওপর জ্ঞান থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। প্রাণী ও উদ্ভিদকে একটি বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে যা আধুনিক জ্ঞানের দিক থেকে খুবই আকর্ষণীয়। এই শ্রেণীবিভাগ কোন গ্রিক গ্রন্থে পাওয়া যায় না এবং এটি কেবল ইরানিদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এ সম্পর্কে প্রাচীন তথ্য জানা যায় একটি ফলকের মাধ্যমে যা  তুরস্কের বোগাজকু থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ