জুলাই ১৮, ২০২৩ ১৬:৪৯ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানে আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে জ্ঞানচর্চা শুরুর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত আমির কাবিরের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্র দারুল ফুনুনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ ছাড়া তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইরানে আধুনিক শিক্ষার প্রসার এবং একাডেমিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের অবদান নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা আধুনিক ইরানের কিছু বৈজ্ঞানিক সাফল্যের বর্ণনা দিয়ে এ সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানবো।

বিশ্ব উদ্ভাবনী সূচক বা 'গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স ২০২২' রিপোর্ট অনুসারে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের অন্যতম দ্রুততম উদ্ভাবনী কর্মক্ষমতার অধিকারী এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দ্বিতীয় সর্বাধিক উদ্ভাবনী দেশ হয়ে উঠেছে। দ্রুততম উদ্ভাবনের দিক থেকে আগের বছরের তুলনায় এ বছর ইরানের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।

জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে মৌলিক বিজ্ঞানের ভূমিকাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও গণিতের মতো বিজ্ঞান সবসময়ই মানবসমাজের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিল। মানুষ সবসময়ই প্রকৃতিতে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার উপযুক্ত কারণ অনুসন্ধান ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য উদগ্রীব থাকে। ইউনেস্কো প্রতিবছর 'টেকসই উন্নয়নে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান দিবস' পালনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে যাতে মানুষ মৌলিক বিজ্ঞান অর্থাৎ পদার্থ, রসায়ন, গণিত, ভূগোল, পরিবেশ ও জীববিদ্যা, পরিসংখ্যান, জেনেটিক বা বংশগতি বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

ইসলামপূর্ব ও ইসলাম পরবর্তী প্রাথমিক যুগে জ্ঞানবিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে বিশ্বজুড়ে ইরানের খ্যাতি ছিল। আজকের যুগে চিকিৎসা শাস্ত্র, গণিত, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি আমরা লক্ষ্য করছি তার পেছনে সে সময়কার ইরানি মনীষীদের বিরাট অবদান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রসায়ন ও অ্যালজেবরা শাস্ত্রে ইরানি মনিষীদের অবদানের কথা উল্লেখ করা যায়। জ্ঞানবিজ্ঞানে ইরানীদের অবদান শীর্ষক এ দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় মৌলিক বিজ্ঞানে ইরানি অনেক মনীষীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছি। আজকে এ সংক্রান্ত আলোচনার শেষ পর্বে আমরা খুব সংক্ষেপে বর্তমান বিশ্বে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে ইরানের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

একটি দেশের গবেষণা, নিবন্ধ, তথ্যপ্রমাণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, গবেষকদের কার্যকলাপ ও শিক্ষার ওপর সেদেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও উৎপাদনের বিষয়টি নির্ভর করে। একটি দেশ কতটুকু উন্নতি করলো তা বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে, বৈজ্ঞানিক উৎপাদন এবং বিজ্ঞানীদের দক্ষতা ও কর্মতৎপরতার ওপর।

২০২১ সালে ইরানে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অবস্থা যাচাই করা সম্ভব হয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে। ওয়েব অব সায়েন্স, স্কোপাস, ন্যাচার ইনডেক্স এবং ইসলামিক ওয়াল্ড সায়েন্সের দেয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ইরানের অগ্রগতির বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। ডাব্লুউ ও এস বা ওয়েব অব সায়েন্সের দেয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১  সালে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান ছিল ১৫তম। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে গত পাঁচ বছরে ইরানের বিজ্ঞান গবেষণাগুলোর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং, রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে।

নানা ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির সাথে সাথে প্রযুক্তিগত ও প্রকৌশল সেবা রপ্তানিতে ইরান অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। ২০১৮ সালে ইরান বছরের প্রথম আট মাসে প্রযুক্তি ও প্রকৌশল সেবা রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছিল ৮০ শতাংশ। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থার (টিপিও) এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এই তথ্য জানিয়েছেন।

এ ছাড়া, ইরানি স্থপতি মোহাম্মদ রেজা কানেই'এর নকশায় তৈরি ভবন জার্মানির মিলানে আন্তর্জাতিক নকশা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছে। কানেই'এর ভবনটি আবাসিক। ইরানের ইসফাহানে পলশির আর্কিটেক্ট প্রতিষ্ঠান ওই ভবনটি নির্মাণ করে যা ইতালিতে আর্কিটেকচার, বিল্ডিং অ্যান্ড স্ট্রাকচার ডিজাইন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার লাভ করে। মিডিল ইস্ট প্রিমিয়ার ওয়েবসাইট ফর আর্কিটেকচার অ্যান্ড ইন্টেরিওর ডিজাইন যে প্রভাবশালী ৫০ জন প্রকৌশলীর নাম ঘোষণা করেছে তার মধ্যে ৫ শীর্ষ প্রকৌশলীই ইরানি।

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক গবেষকদের তালিকায় নাম রয়েছে ইরানের সাত বিজ্ঞানীর। ‘২০১৭ হাইলি সাইটেড রিসারচারস'- শীর্ষক তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন এসব ইরানি বিজ্ঞানী। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ও অ্যাকাডেমিক গবেষণা বিষয়ক কোম্পানি ক্লারিভেট অ্যানালিটিক্স প্রকাশিত তালিকায় এই চিত্র উঠে এসেছে।

এ ছাড়া, ইরানের বিজ্ঞানি ও স্ট্রিং তত্ত্ববিদ কারমান ভাফা আরো তিন বিজ্ঞানীর সঙ্গে মৌলিক পদার্থ বিদ্যায় 'ব্রেকথ্রু পুরস্কার' পেয়েছেন। এসব বিজ্ঞানী স্ট্রিং তত্ত্ব ব্যবহার করে বিশ্বের চার মৌলিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে আসছেন। এ চারটি মৌলিক শক্তি হচ্ছে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় শক্তি, সবল পারমাণবিক শক্তি, দুর্বল পারমাণবিক শক্তি ও মহাকর্ষ।

ইরানের আরো সাফল্যের মধ্যে রয়েছে, বিমানের টারবোজেট ইঞ্জিন তৈরি, পার্সেল ডেলিভারির ড্রোন তৈরি, রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম দূর পাল্লার ড্রোন তৈরি, সমুদ্রের পানি লবণমুক্ত করার মেশিন তৈরি, পানির মান পরীক্ষায় টেস্টিং কিট তৈরি, ন্যানো জ্বালানি কোষ তৈরি, ন্যানো-প্রযুক্তি খাতে ইরানি অধ্যাপিকার ইউনেস্কোর পদক লাভ, ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন সমন্বিত থেরাপি পদ্ধতির উদ্ভাবন, ক্ষতস্থানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওষুধ লাগানোর স্মার্ট ব্যান্ডেজ তৈরি, বেদনানাশক ক্রিম তৈরি, নিরাপদ কোয়ান্টাম যোগাযোগ প্রযুক্তি অর্জন প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়া মহাকাশবিজ্ঞানে মধ্যপ্রাচ্যে শীর্ষে রয়েছে ইরান।   

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী সম্প্রতি এক গবেষণা কেন্দ্র পরিদর্শন করে বলেছেন, 'বিজ্ঞান ও গবেষণাই অগ্রগতি অর্জনের চাবিকাঠি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করাকে তিনি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাথমিক যাত্রা হিসেবে অভিহিত করেন এবং এ যাত্রাকে প্রাথমিক পর্যায়েই সীমিত না রাখার আহ্বান জানান'। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, 'কোনো কোনো বৃহৎ শক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একচেটিয়া কর্তৃত্বাধীনে রাখতে চাইছে এবং বিশ্বকে উন্নত ও পশ্চাদপদ এ দুই অংশে চিরকালের জন্য বিভক্ত করে রাখতে আগ্রহী। জাতিগুলোর সচেতনতা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জনের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের ওপর চাপিয়ে রাখা এই আধিপত্যকামী ব্যবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রতিভা ও উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী ইরানের মুসলিম জাতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে'। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, 'জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি গবেষকদের বিস্ময়কর সব সাফল্য ওই কাঙ্ক্ষিত আত্মবিশ্বাস, প্রতিভা ও শক্তিমত্তারই প্রমাণ'।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ