জুলাই ০৬, ২০২৩ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা ভাষাবিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ভাষাবিজ্ঞানে ইরানি চিন্তাবিদদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করবো।

"ইবনে সিবুয়েহ" হচ্ছেন একজন ইরানি ভাষাবিদ এবং ফার্সি ও আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি আরবি ভাষার ব্যাকরণের গভীরে প্রবেশ করে এই ভাষাকে করেছেন আরো সমৃদ্ধ। তার পুরো নাম "আবু বাশার আমরু বিন ওসমান বিন কানবার" এবং ডাকনাম "সিবুয়েহ"। কিশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন। তিনি ৭৬০ খ্রিস্টাব্দে শিরাজের বিজায়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষার জন্য ইরাকের বসরায় গমন করেন। সেখানে তিনি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি আরবি ভাষাও রপ্ত করেন। বসরায় আরবি ব্যাকরণ শিক্ষা শেষ করে তিনি বাগদাদে ইয়াহিয়া বিন খালেদ বারমেকির কাছে যান। সেখানে তিনি কুফার ব্যাকরণবিদ ও হারুন আল-রশিদের পুত্র আমিনের শিক্ষক "কাসাই" -এর সাথে ভাষা নিয়ে বিতর্কের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান। বাগদাদে এ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু ব্যাকরণের পদ্ধতিগত বিষয় নিয়ে "ইবনে সিবুয়েহ" ও "কাসাই"-এর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় সেকারণে হারুন আল-রশিদের পুত্র আমিন তার শিক্ষক "কাসাই" এর পক্ষ অবলম্বন করে এবং শেষ পর্যন্ত অনেক চালাকি করে ও কূটকৌশলে কাসাইয়ের অনুকূলে এই বিতর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

ইরানি এই ভাষাবিদ এবং ফার্সি ও আরবি ভাষা-সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তি "ইবনে সিবুয়েহ" সম্পর্কে বর্তমান যুগের চিন্তাবিদ ও গবেষকদের মন্তব্য  থেকে বোঝা যায় ইবনে সিবুয়েহ তার যুগে অত্যন্ত খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানার্জনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। ইয়াকুত হামাভি তার 'মোয়াজ্জেম আল আদাবায়ে' গ্রন্থে লিখেছেন, "ইবনে সিবুয়েহ"এর ভাষাতত্ব সংক্রান্ত গবেষণামূলক গ্রন্থ একটি অমূল্য সম্পদ। এ ছাড়া আরো অনেকে বলেছেন, সিবুয়েহ গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বিশেষ করে তার লেখা 'আল কেতাব' বইটি থেকে ভাষাতত্ব বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ মেলে। এ বইটির মাধ্যমে তিনি শুধু যে আরবি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তাই নয় হিব্রু ভাষার উন্নয়নেও তিনি যথেষ্ট অবদান রাখেন। এ কারণে হিব্রু ভাষার পণ্ডিতেরা হিব্রু ভাষার ব্যাকরণের নিয়মের ক্ষেত্রে "ইবনে সিবুয়েহ"কে তাদের গুরু হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদিও হিব্রু ভাষার এসব পণ্ডিতেরা এর আগে তাদের ভাষাকে তৌরাতের ভাষার অলঙ্করণের সাথে হিব্রু ভাষাকে মিলিয়ে ফেলার চেষ্টা করতেন কিন্তু, তাদের সে চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি।

হিব্রু ভাষার ইতিহাসবিদরা মনে করতেন, "ইবনে সিবুয়েহ" খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর একজন পণ্ডিত এবং তার আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত হিব্রু ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্য গঠন রীতির সাথে কেউ ভালোভাবে পরিচিত ছিল না। অনেক প্রাচ্যবিদ এবং ১৯ শতকে জার্মানির ভাষাবিদরা মুসলিম ভাষাবিদদের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন এবং এ লক্ষ্যে তারা "ইবনে সিবুয়েহ"-এর লেখা ভাষাবিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থ পর্যালোচনা করেছেন। কারণ "ইবনে সিবুয়েহ"- তার এ বইটির মাধ্যমে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ পদ্ধতিকে সুশৃঙ্খল রূপ দান করেছিলেন।

কেউ কেউ মনে করেন ইরানের এই খ্যাতনামা মনীষী ও ভাষাতত্ববিদ সিবুইয়েহ যদি আরবি ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্যগঠন পদ্ধতি নিয়ে কাজ না করতেন তাহলে বহুল প্রচলিত এই ভাষাটি উচ্চারণের মতোই লেখার ক্ষেত্রেও তার মৌলিকত্ব হারিয়ে ফেলতো এবং ভাষার শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য থাকতো না।  

ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী "ইবনে সিবুয়েহ" ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জানুয়ারি ইরানের শিরাজ শহরে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবরের উপর একটি কালো পাথর রয়েছে, যা কাজরুন গেটের একটি দোকানের পাশে অবস্থিত।

এতক্ষণ আরবি ভাষার ব্যাকরণ ও বাক্যগঠন রীতি উন্নয়নে ইরানের ভাষাবিজ্ঞানী "ইবনে সিবুয়েহ"-এর অবদান নিয়ে আলোচনা শুনলেন। এবারে আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার জন্য ইরানে স্থাপিত প্রথম কেন্দ্রের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।

ঐতিহাসিকদের ভাষ্যমতে ইরানিরা বহু প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। বেশিরভাগ ইতিহাসবিদরা মনে করেন, বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ আজকের ইরান প্রাচীন পারস্য সভ্যতার কাছে ঋণী।

হাখামানেশিয় যুগে বিভিন্ন শিল্প ও পেশার বিকাশ এবং প্রশাসন ও নানা সংস্থা পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবলের জরুরি প্রয়োজন ছিল। এ কারণে হাখামানেশিয় শাসকরা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা স্কুলগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় শিক্ষাদান কর্মসূচির ব্যবস্থা করেছিল। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে তা ইরানে ধীরে ধীরে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান  গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিল।

এই ধরনের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি নিদর্শন হচ্ছে প্রথম শাহপুরের নির্দেশে জান্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যেখানে সর্বোচ্চ স্তরে শিক্ষা ও গবেষণার কাজ চালানো হতো। কয়েক শতাব্দী ধরে জান্দিশাপুর বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো। এখানে চিকিৎসাবিদ্যা, ওষুধ তৈরি, পশু চিকিৎসা পদ্ধতি, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত, যুক্তিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি পড়ানো হত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সাফল্যের সাথে অনেক বড় বড় গবেষণাকর্ম চালিয়েছেন। ইতিহাস গবেষকরা লিখেছেন, প্রাচীন ইরানে অত্যাচারী ও অবিচারমূলক শাসন ব্যবস্থার কারণে সাধারণ মানুষ জ্ঞানার্জন থেকে বঞ্চিত হতো। এ কারণে সাসানিয় যুগে জ্ঞান শিক্ষার অধিকার কেবল জরথুস্ত্র ধর্মযাজকদেরই ছিল। ইতিহাসে দেখা যায় জ্ঞান গবেষণার অনেক কেন্দ্র ও সুযোগ সুবিধা থাকলেও কেবলমাত্র রাষ্ট্রের ধর্মযাজক ও সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরাই শিক্ষার সুযোগ পেত। কিন্তু তারপরও সাধারণ মানুষের মধ্যে সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষা অর্জনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। ইরানে ইসলাম ধর্মের আগমন এবং সাসানিয় শাসনের পতনের পর সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ তৈরি হয় এবং বহু ইরানী মনীষীর আবির্ভাব ঘটে।

'জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান' শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার গত বেশ কিছু পর্বে আমরা প্রাক ইসলামি যুগে ইরানি বেশ ক'জন মনীষী ও তাদের মূল্যবান গবেষণাকর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। তাদের রেখে যাওয়া অনেক মূল্যবান গ্রন্থের কথাও উল্লেখ করেছি যা কিনা বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশ ও মানব সভ্যতা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছে।

তবে ইরানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার ধারা কবে থেকে শুরু হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সে বিষয়ে আমরা আগামী কয়েক পর্বে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ