জুলাই ১২, ২০২৩ ১৫:২২ Asia/Dhaka

গত অনুষ্ঠানে আমরা ভাষাবিজ্ঞান ক্ষেত্রে ইরানি মনীষীদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম ইরানে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও জ্ঞানচর্চার ধারা কবে থেকে শুরু হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করবো এবং প্রসঙ্গে বিখ্যাত আমির কাবিরের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ভবন দারুল ফুনুনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আজকের পর্বে আমরা নানা ক্ষেত্রে আমীর কাবিরের অবদান সম্পর্কে কথা বলবো।

ইরানের কাজার যুগের প্রধানমন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন মীর্যা তাকি খান-এ ফারাহানি যিনি আমির কাবির নামে পরিচিত। তিনি ১৮০৭ সালে ইরানের আরাক প্রদেশের হাযাভে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কাজার বাদশাহ নাসিরুদ্দিন শাহের সময়কালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী।

ইরানের অভ্যন্তরীণ সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের স্বল্প সময়ে অর্থাৎ তিন বছরের কিছু বেশি সময়ে আমির কবির যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং বাস্তবায়িত করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে ছিল সংস্কৃতিকে উন্নত করা, অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিশুদ্ধ করা, ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং সমাজে ন্যায়বিচার সম্প্রসারণের পদক্ষেপ নেওয়া, বিদেশী ও ঔপনিবেশিক শক্তির প্রভাব ছিন্ন করা এবং দেশের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা।

উল্লেখিত সংস্কারের ব্যাপারে আমির কবিরের আরো কিছু পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র দারুল ফুনুন প্রতিষ্ঠা, নতুন বিজ্ঞানের প্রসার, নতুন শিল্পের প্রসার, ইরানিদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে প্রেরণ এবং তাদের প্রত্যাবর্তনের পর ইরানে শিক্ষকতায় নিয়োগ করা, বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিভিন্ন বইয়ের অনুবাদ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা দান, সংবাদপত্র চালু করা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যা কিনা একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিসাবে ইরানের জনজীবনের সমস্ত অঙ্গনে অনুপ্রবেশ করেছিল। এ ছাড়া, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করা, খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের কাজ সম্প্রসারণ, কৃষি ও সেচের সম্প্রসারণ, দেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো থেকে বিদেশী হস্তক্ষেপকে প্রতিহত করা, দেশের স্বার্থ বজায় রেখে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করা, ইরানের সশস্ত্র বাহিনীকে সংগঠিত করা, অস্ত্র কারখানা স্থাপন, বিচারিক বিষয়ের সংস্কার, ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু, রেলপথ, হাসপাতাল এবং ব্যাংক প্রতিষ্ঠা  ইত্যাদি পদক্ষেপ নেন আমির কবির।

মীর্যা তাকি খান আমির কাবির ইরানের শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণের জন্য বিভিন্ন স্কুল ও বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৮৫১ সালে বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা 'দারুল ফুনুন' প্রতিষ্ঠা করেন। তার এ অসামান্য উদ্যোগের ফলে ইরানিরা পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাষা ও সাহিত্যের সংস্পর্শে আসতে পারে। তবে 'দারুল ফুনুন' প্রতিষ্ঠার আগে তিনি তার প্রতিনিধিদেরকে সাথে নিয়ে নতুন শিক্ষা, সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফরে যেতেন। তিনি ইউরোপের স্কুলগুলো পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পেলেন সেখানে মুখ ও বধির অর্থাৎ কানে শুনতে পারে না কথাও বলতে পারে না এমন ব্যক্তিদেরও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ানদের মাধ্যমে পরিচালিত রাশিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রগুলোও পরিদর্শন করেন যেখানে সব ধরনের বিজ্ঞান ও শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হতো এবং ছাত্ররা দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে গড়ে উঠতো।

এসব মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জনের পর আমির কাবির খ্রিস্টীয় ১৮৪৯ সালে রাজধানী তেহরানে বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা 'দারুল ফুনুন' প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। ভবনটির ডিজাইন পরিকল্পনা করেছিলেন প্রকৌশলী মির্জা রেজাঈ এবং এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে সবাইকে পরিচিত করানো এবং তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া। 'দারুল ফুনুন' কেন্দ্রের শিক্ষা কর্মসূচী শুরু হয়েছিল ছয় অস্ট্রিয়ান এবং একজন ইতালিয় শিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে। এই গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষার বিষয়বস্তু ছিল সামরিক বিষয়াদি, পদাতিক বাহিনীর রণকৌশল, অশ্বারোহী, কামান পরিচালনা, প্রকৌশল, চিকিৎসা, সার্জারি ও ফার্মেসি এবং খনিজ  সম্পদ বিষয়ক জ্ঞানার্জন। এসব বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জনের জন্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষার ওপর বিশেষ জোর দেয়া হতো। শিক্ষার্থীরা এখানে ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিকভাবে পড়ালেখা করতো। এই শিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রদের প্রাথমিকভাবে রাজপুত্র ও অভিজাতদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হতো যারা পড়তে এবং লিখতে জানতেন এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকেও অল্প সংখ্যক ছাত্র নেয়া হতো। 

ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের অগ্রনায়ক আমির কাবিরের বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপের কারণে দুর্নীতিবাজরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং অবশেষে কাজার শাসক নাসিরুদ্দিন শাহ তাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে। মির্জা তাকি খান আমির কাবির বরখাস্ত হওয়ার মাত্র দুই দিন পর অস্ট্রিয়ার শিক্ষকরা তেহরানে এসে পৌঁছান। পদ হারানোর পরও আমির কাবির প্রশাসনের একজনকে অনুরোধ করেছিলেন শিক্ষকদের সাথে যেন সদাচরণ করা হয় এবং কোনো কারণে যেন তারা অসন্তুষ্ট না হন। পরে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। আমির কাবির ১৮৫১ সালের ২৭ ডিসেম্বর কাশান শহরের ফিন বাথহাউসে শহীদ হন। ইরানে তাঁর নামে অসংখ্য স্থান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

যাইহোক, আমির কাবিরকে হত্যার ১৩দিন আগে নাসিরউদ্দিন শাহ, ইরানী ও ইউরোপীয় বিজ্ঞানী ও শিক্ষকদের একটি দল এবং ৩০ জন ছাত্র ও মির্জা মুহাম্মদ আলী খান শিরাজীর উপস্থিতিতে 'দারুল ফুনুন' কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়েছিল। এটি পরিচালনার জন্য তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

তেহরানের নাসের খোসরু স্ট্রিটে অবস্থিত 'দারুল ফুনুন' শিক্ষাকেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে সংস্কার করা হয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রভৃতি পদের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক  ব্যক্তিত্বরা এই কেন্দ্র পরিচালনা করার সৌভাগ্য লাভ করেন। 'দারুল ফুনুন' শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার শুরুতে সাধারণ ব্যক্তিদের পক্ষে সেখানে পড়ালেখার সুযোগ ছিল না। পড়তে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের নামের তালিকা প্রথমে রাষ্ট্রের প্রধান কর্ণধার শাহের কাছে পাঠানো হতো এবং এসব ব্যক্তিরা ছিলেন দেশের গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তান। দারুল ফুনুনে আট বছরের শিক্ষা সমাপ্ত করে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ইউরোপীয় শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। ফলে এর পরের দশকগুলোতে দারুল ফুনুনে অধ্যয়নকারী শিক্ষার্থীরা সবসময়ই ইরানের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

অনেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং তারা ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অনেকে এখানে অধ্যাপনা শুরু করেন। আবার অনেকে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এ থেকে ওই সময় দারুল ফুনুন শিক্ষা কেন্দ্রের গুরুত্ব ফুটে ওঠে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ