জুলাই ২১, ২০২৩ ২০:১৩ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি হলো:

প্রাচীনকালের কথা। এক দরবেশ ছিল বেশ গরিব। দারিদ্র্যের মধ্যেই বাস করতে হতো তাকে। তার না ছিল বাড়িঘর, না ছিল ঘর-সংসার। এই বিশাল বিস্তৃত পৃথিবীতে, তার হাত, পা, চোখ, হৃদয়, জিহ্বা ছাড়া আর কোনো সম্পদ ছিল না। কিন্তু জ্ঞানীরা ঠিকই জানেন-এগুলোও ছোটখাটো কোনো সম্পদ নয় এবং জ্ঞানীদের কাছে এইসব নেয়ামত বিশাল সম্পদ। এগুলো হচ্ছে অমূল্য সম্পদ।

যাই হোক আমাদের এই গল্পের দরবেশ খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে পথ চলতো। তার কাছে টাকা-পয়সা না থাকলে কী হবে সে কিন্তু খালি হাত দিয়ে কাজকর্ম করতো। চোখ দিয়ে দেখতো আর মন দিয়ে একমাত্র খোদাকে ভালোবাসতো। সবসময় সে তার জিহ্বা দিয়ে খোদার প্রশংসা করতো এবং তাকে ধন্যবাদ দিতো। আমাদের গল্পের দরবেশ সর্বদা ভ্রমণ করতো। পায়ে হেঁটে হেঁটেই এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতো। এভাবেই সে তার জীবন যাপন করতো। 

একদিন এই দরিদ্র দরবেশ দেখতে পেলো একটি বড়ো কাফেলা কোথায় যেন যাচ্ছে। মুক্ত হৃদয়ের দরবেশ ওই কাফেলার সঙ্গে যাবার জন্য কুফা থেকে বেরিয়ে পড়লো। কাফেলা কোথায় যাচ্ছে এবং কেন যাচ্ছে তার কিছুই না জেনে দরবেশ তাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটে রওনা হলো। দরবেশ হাঁটতে হাঁটতে গুঞ্জন করে কবিতা আওড়াচ্ছিলো।

উটের পিঠে আরোহনকারী কাফেলার একজন কবিতা আবৃত্তি করতে থাকা দরবেশকে বললো: হে দরবেশ! কোথায় যাবে তুমি! খালি হাত পা নিয়ে কী করে যাবে? বিপদে পড়ে যাবে। ক্লান্তি আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা যাবে তুমি। ফিরে যাও যেখান থেকে এসেছো, সেখানে। তোামর কাছে তো কোনো রসদ দেখছি না। তাছাড়া এই পথ তো পায়ে হেঁটে চলার মতো পথও নয়। কী করে তুমি এতো দূরের দূর্গম পথ পাড়ি দেবে।

কিন্তু কে শোনে কার কথা। দরবেশ এক কান দিয়ে শুনেছে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে। আনমনে সে তার পথ চলা অব্যাহত রেখেছে। উটের পিঠে আরোহী লোকটি ছিল যুবক এবং অর্থবিত্তশালী ও সুঠামদেহি। পার্থিব সম্পদের কমতি ছিল না তার। না তার কোনো রোগ-ব্যাধিজনিত দুশ্চিন্তার অবকাশ ছিল, না বেকারত্বের হাহাকারজনিত কোনো পেরেশানি বা দু:খবোধ ছিল তার। সবসময়ই সে ছিল সুস্থ-সবল,আনন্দিত ও তারুণ্যদীপ্ত। সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর ছিল সে। সম্পদের প্রাচুর্য আর বিলাসিতায় নিমজ্জিত এই তরুণ পথে পথে শুধু দরবেশকেই দেখছিল। দরবেশ কখোন ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়ে মারা যায়-সেই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় ছিল সে। অবশেষে যুবক উট সওয়ার ভাবছিল বুড়ো দরবেশ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে মারা যাবে। কখোন পড়ে সেই অপেক্ষায় যুবক দরবেশকে দেখছিল। যুবক তার সঙ্গী-সাথীদের বলছিল: এই দরবেশ খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের পিছে পিছে আসছে। অচিরেই সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে এবং এই পৃথিবী ছেড়ে পরকালীন জীবনে পাড়ি জমাবে। আমি তাকে ফিরে যেতে বলেছিলাম, কিন্তু সে আমার কথায় কান দেয় নি, পিছে পিছে হেঁটে হেঁটে এসেছে। শীঘ্রই সে বুঝতে পারবে-কী ভুলটাই না সে করেছে। উচিত ছিল আমার কথা শুনে বাড়িতে ফিরে যাওয়া। কিন্তু আফসোস! যখন বুঝতে পারবে তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। তখন কোনো অনুশোচনাই কাজে আসবে না।

শুষ্ক, লতাপাতাহীন, গাছপালাহীন, পানিবিহীন এই মরুভূমিতে বেচারা দরবেশ অবশ্যই মারা পড়বে। একাকী, নি:সঙ্গ এই অপরিচিত মরুপ্রান্তরে বেচারার সমাধি হবে। কাফেলা তাদের গতিতেই সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলো। খালি পায়ে দরবেশও ওই কাফেলাকে অনুসরণ করে দ্রুত হাঁটছিলো। ব্যাপক ক্লান্তি, শ্রান্তি আর ক্ষুধা তৃষ্ণায় হাঁপাচ্ছিল। বেশ লম্বা সময় পর কাফেলা একটা চমৎকার জায়গায় গিয়ে পৌঁছলো। ওই স্থানে সবুজ গাছ-গাছালি আর ঘাস-লতাপাতা যেমন ছিল তেমনি ছিল পানির ব্যবস্থাও। এটা ছিল একটা খেজুর বাগান-বেশ সুন্দর এবং বিশ্রাম নেওয়ার মতো। কাফেলা ওই জায়গায় থামলো। খানিক বিশ্রাম নিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে আবারও যাত্রা শুরু করবে-এই চিন্তায়। কিন্তু এখানেই ঘটলো বিপর্যয়।

বিপর্যয়টা হলো সুন্দর ওই খেজুর বাগানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে উট-সওয়ারি সম্পদশালী যুবকের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলো এবং সে মারা গেল। দরবেশ ওই যুবকের কাছে গিয়ে বললো: আমরা কিন্তু পথের ক্লান্তি আর ক্ষুধা তৃষ্ণার কষ্টে মারা যাই নি! অথচ তুমি এতো আরামে উটের পিঠে চড়ে এসে, তৃষ্ণায় পানি খেয়ে মারা গেছো। কিন্তু ওই যুবক তো আর বেঁচে নেই। সুতরাং দরবেশের কথাই বা কে শুনবে আর কে বুঝবে ভুলটা কার ছিল। দরবেশ সম্পর্কে সম্পদশালী ওই যুবকের কথাগুলো যারা শুনেছে তারা এই ঘটনায় হতবাক হয়ে গেছে। দরবেশ এবার তাদের দিকে ফিরে বললো: এতে অবাক হবার কিচ্ছু নেই। একজন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো: কেন অবাক হবো না? ওই যুবক তরতাজা একটা উটের পিঠে চড়ে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট না পেয়ে এ পর্যন্ত এসে কী করে মারা গেল?

অথচ তুমি বৃদ্ধ মানুষ, খালি পায়ে হেঁটে, না খেয়ে না দেয়ে, কত কষ্ট করে কাফেলার পেছনে পেছনে এসেছো। তুমি দিব্যি ভালো আছো। মরে যাও নি! তারপরও বলছো-এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই? দরবেশ এসব কথা শুনে হাসলো। বললো: তোমরা এ বিষয়টি ভুলে যাচ্ছো যে যার যার মৃত্যুর সময় নির্ধারিত আছে। হাসপাতালে কত মুমূর্ষু রোগী সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যায় অথচ সুস্থ সবল নার্স হঠাৎ করেই মারা যায়। ওই নার্স তো একদম সুস্থ ছিল, তরুণ ছিল। কাফেলার সবাই যে-যার দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।#

পার্সটুডে/এনএম/২১/৬৯

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ