গল্প ও প্রবাদের গল্প:
ধনী লোকের কৃপণতার পরিণতি
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজকের আসরে আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি হলো:
বেশ প্রাচীনকালে একজন ধনী লোক ছিল ভীষণ কৃপণ এবং অভদ্র। এতোই কৃপণ যে এক টুকরা রুটি পর্যন্ত সে ফকিরকে দিতো না। এই ধনী লোক কৃপণতা করা ছাড়াও ভীষণ রকমের অকৃতজ্ঞ ছিল। আল্লাহ তাকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন সেসবের জন্য কোনোরকমের শুকরিয়া আদায় করতো না সে।
পাড়া-প্রতিবেশির সঙেগও তার ব্যবহার এমন ছিল যেন সে সবার কাছেই পায় মানে সবাই যেন তার কাছে ঋণী। সারাজীবনে সে কারও কোনো মঙ্গল করে নি, কারও কল্যাণে কোনো কাজ করে নি। সে সবসময় মুখ বেজার করে রাখতো, মেজাজ তার সবসময় খারাপ থাকতো। সে কারণে মানুষের সাথে কখনোই সে সুন্দর ব্যবহার করতো না। সবসময় সে মানুষকে অভিশাপ দিয়ে বেড়াতো। একদিন, ওই ধনী লোকের বাড়ির দরোজায় এক ফকির মানে ভিক্ষুক এসে কিছু সাহায্য চাইলো। বাড়ির চাকর ফকিরকে দেখে বললো: তোমার যদি জীবনের মায়া অবশিষ্ট থাকে তাহলে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও! ফকির বিস্মিত হয়ে বললো: চলে যাবো? কিন্তু কেন?
চাকর ভিক্ষুকের বিস্ময়ের জবাবে বললো: আমার মনিব কাউকে সাহায্য করার মতো লোক না। ভিক্ষুক বললো: কী করে জানো? তুমি বরং তোমার মনিবকে গিয়ে বলো যে এক ভিক্ষুক সাহায্য চাচ্ছে। দিতেও তো পারে! চাকর বললো: আমার মনিবকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। তুমি যদি জীবনের মায়া থাকে তাহলে চলে যাও! ভিক্ষুকদেরকে একদম সহ্য করতে পারে না সে। তুমি যে যাচ্ছো না-এটা জানতে পারলে তোমাকে লাথি-ঘুষি মেরে তাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু ভিক্ষুক কিছুতেই গেল না। নিরুপায় হয়ে চাকর তার মনিবের কাছে গিয়ে ঘটনাটা বললো। কৃপণ মনিব ভীষণ রেগে গিয়ে বললো: কেন খামোখা আমাকে বিরক্ত করছো?
একটা ভিক্ষুকের ঘটনা শোনাতে আমার সময় নষ্ট করছো? চাকর বললো: তার চাহিদা খুবই কম। আল্লাহর সন্তুষ্টির কথা ভেবে সামান্য কিছু দান করতে পারো। মনিব একথা শুনে রেগেমেগে বললো: তুমি যদি তাকে ফেরাতে না পারো তাহলে কী আর করা,আমিই যাই। মনিব চীৎকার করে ভিক্ষুককে ডাকলো। বললো: যাও এখান থেকে। টাকা-পয়সা কি ভালুকের ঘাস যে যাকেতাকে দান করবো? আমি অনেক কষ্টে টাকা কামিয়ে সম্পদের মালিক হয়েছি। তুইও ভিক্ষাবৃত্তির মতো অলসতা বাদ দিয়ে কাজ কর, যাতে ভিক্ষা করার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে যেতে না নয়, হাত পাততে না হয়।
মনিব ভিক্ষুককে কিছু উপদেশ দিলো। কিন্তু উপদেশ শুনেও ভিক্ষুক গেল না, দাঁড়িয়ে রইলো। রেগে গিয়ে চাকরকে বললো: ওকে চড় মেরে এখান থেকে সরিয়ে দাও! ফকির বেচারা শেষ পর্যন্ত চলে গেল। মনিবও ফিরে গেল তার ঘরে। কিন্তু সেই সময় থেকে ধনী মনিবের জীবন থেকে যেন সুখ শান্তি বিদায় নিলো। বহু বছর কেটে গেল এবং কৃপণ লোকটির সম্পদও দিনের পর দিন কমতেই থাকলো। আল্লাহর শুকরিয়া তো সে কখনোই করতো না। এখন আরও খোদাদ্রোহী কথা বলতে শুরু করলো। কেন তার আয় কমে গেল? কেন সে স্বর্ণমুদ্রা জমাতে পারছে না-ইত্যাদি? যত যা-ই করলো তার সম্পদ আর কিছুতেই বাড়লো না, কমতেই লাগলো। এমন অবস্থা হলো যে তার আর চাকর পালার মতো অবস্থা রইলো না। এমনকি কিছুদিন পর তার বাড়িটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলো।
এক কথায় সে একরকম দেউলিয়া হয়ে পড়লো। তার জীবনে নেমে এলো বিষাদ, দু:খ-ক্লেশের নিদারুণ অন্ধকার। অবশেষে সে নিজেই একদিন ভিক্ষুকে পরিণত হলো। বাজার-ঘাটে, মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা করতে হলো তাকে। মানুষের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো যে এতো সম্পদ আর বিত্ত-বৈভবের মালিক এখন এরকম ময়লা পোশাকে ভিক্ষা করছে? তার চাকর একজন সদয়, দানশীল লোকের বাসায় কাজ নিলো। কৃপণের বাসা ছেড়ে এসে এই বাসায় সে আরামেই আছে এখন। একরাতে ওই চাকর তার নতুন মনিবের সঙ্গে গল্প করছিলো। এমন সময় বাসায় দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। চাকর দরোজা খুলে দেখলো ময়লা জামা পরা এক ভিক্ষুক। কিছু সাহায্য চাইলো। চাকর তার মনিবকে খবর দিলো।
মনিব চাকরকে বললো ভিক্ষুককে যেন যথাসাধ্য সেবা করে। চাকর ভিক্ষুককে বাসায় নিয়ে এলো। দস্তরখান বিছিয়ে মজার মজার খাবার খেতে দিলো। ভিক্ষুক পেট পুরে খেয়ে হেলান দিয়ে বসলো। চাকর চা নিয়ে এসে তাকাতেই ভিক্ষুককে চিনতে পারলো। কান্নাকাটি শুরু করলো সে। নতুন মনিব কান্না শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো: কী হয়েছে? কাঁদছো কেন? চাকর বললো: এই ভিক্ষুকের অবস্থা দেখে কাঁদছি। আমি ওকে চিনি। সে এক সময় আমার মনিব ছিল। এই শহরের সবচেয়ে ধনী ছিল সে। কিন্তু ভীষণ কৃপণ ছিল। একজন ভিক্ষুককেও সে কোনোদিন সাহায্য করতো না। এইতো সেইদিন মাত্র এক ভিক্ষুককে সে তার দরোজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মনিব জানতে চাইলো: কোন ভিক্ষুককে?
চাকর পুরো গল্পই শোনালো। নতুন মনিব সব শুনে বললো: হুমম.. আমি তোমাদের দু'জনকেই চিনি। কিন্তু তোমরা আমাকে চেনো না। কারণ আমার বর্তমান অবস্থা, চেহারা সবই সেদিনের তুলনায় পুরোই পাল্টে গেছে। আমি সেই ভিক্ষুক যাকে সে খুব কষ্ট দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল। আল্লাহ তা সহ্য করতে পারেন নি। সে তো জানতো না মানুষের দিন সবসময় একরকম যায় না। আল্লাহ যে কখোন কাকে কী অবস্থায় রাখবেন-তিনিই ভালো জানেন। সুতরাং সর্বাবস্থায় আল্লাহর অনুগ্রহ চেয়ে তার দেয়া নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কৃপণতা না করে ভিক্ষুকের ক্ষুধা-তৃষ্ণায় সাহায্য করা উচিত।#
পার্সটুডে/এনএম/৩১/৭৫
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ