রংধনু আসর : নতুন বন্ধু মৌমাছি
রংধনু আসর : নতুন বন্ধু মৌমাছি
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদেরকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, আজকের আসরের শুরুতেই থাকবে নরওয়েতে প্রচলিত একটি রূপকথা। এর পর থাকবে দুটি কবিতা ও একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।
জনি নামে ১৩ বছরের এক কিশোর একটা বাড়িতে রাখালের কাজ করে। প্রতিদিন সকালে ছাগলগুলোর দুধ দোহানোর কাজে সহায়তা করতে হয় তাকে। তারপর ওদেরকে দূরের পাহাড়ের ঢালে নিয়ে যায় ঘাস খাওয়ানোর জন্য। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগেই ছাগল নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে জনি। রাতে আবার ছাগলের দুধ দোহানো হয়। তখনও এই কাজে সহায়তা করে রাখাল বালকটি।
ছাগলগুলো এমনিতে বেশ ভালো। জনির কথা মেনে চলে। কিন্তু একদিন বিগড়ে গেল ওরা। ছাগলগুলো হঠাৎই কেমন যেন বেয়াড়াপনা শুরু করে দিল। কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না ওদের। রাগে–দুঃখে জনির নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে।
হয়েছে কী, ওই দিন দাদির শালগম বাগানের দরজাটা খোলা ছিল। কেউ হয়তো দরজাটা সময়মতো বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। তাতেই মহাসমস্যার সূত্রপাত। ছাগলগুলো করল কী, হুড়মুড় করে দৌড়ে ঢুকে গেল দাদির বাগানে। ঢুকেই তারা মহা আনন্দে শালগম বাগান সাবাড় করার কাজে লেগে গেল। জনি এই কাণ্ড দেখে হতবাক!
জনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল : এই হতচ্ছড়া ছাগলের দল! বাঁচতে চাইলে শালগমগাছ খাওয়া বন্ধ কর। বাড়ি চল এক্ষুনি। কথা না শুনলে বেদম পিটুনি খাবি কিন্তু!
একথা বলে একটা বাঁশের কঞ্চি জোগাড় করল জনি। কঞ্চির পিটুনি দেওয়ার সুযোগই পেল না। ছাগলগুলো এলোপাতাড়ি দৌড়াতে লাগল। জনিও পেছনে পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। হতচ্ছাড়া ছাগলের দল থেমে নেই। কচকচ করে তারা শালগমের কচি সবুজ পাতা খেয়েই চলেছে। মনে হচ্ছে, প্রতিটি গাছ সাবাড় না করা পর্যন্ত থামবে না ওরা।
দস্যি ছাগলগুলোর সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে জনি হতাশ। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে তাই। ওই সময় ওখান দিয়ে যাচ্ছিল একটা শিয়াল। কী ভেবে থমকে দাঁড়ায় প্রাণীটি। জনিকে জিজ্ঞেস করল: কাঁদছ কেন বাছা? কী, হয়েছে কী তোমার?
জনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দিল: আর বলো না ভাই। শয়তান ছাগলগুলোকে নিয়ে আর পারছি না। এক একটা যা ত্যাঁদড় হয়েছে না। দাদি আম্মার শালগমের বাগান ওরা উজাড় করে ফেলছে। কিছুতেই থামাতে পারছি না। অপমানে, রাগে, দুঃখে তাই কাঁদছি।
শিয়াল বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল: ও আচ্ছা, এই ব্যাপার? তুমি বাছা এখানটায় চুপ করে বসে থাকো। আমি দেখছি, কদ্দুর কী করা যায়।
যেমন কথা তেমন কাজ। শিয়াল 'হক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া' ডাক ছেড়ে ছাগল তাড়ানোর চেষ্টা শুরু করে দিল। দুষ্টু ছাগলগুলো তাড়া খেয়ে বাগানেই ছোটাছুটি করতে থাকল। ঘণ্টাখানেক শিয়ালে-ছাগলে হুটোপুটি চলল। শেষ পর্যন্ত বিফল হলো অভিযান। শিয়াল ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা যে অত কঠিন হবে, তা আগে আন্দাজ করতে পারেনি সে।
ক্লান্ত–শ্রান্ত শিয়াল একপর্যায়ে জনির পাশে এসে বসল। নিজেও কান্না শুরু করে দিল। খানিক পর সেখানে আসল এক কুকুর। শিয়ালকে জিজ্ঞেস করল: তোমরা কাঁদছ কেন? কী হয়েছে, আমাকে খুলে বলো।
শিয়াল হুক্কা হুয়া বলে বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে বলল: আমি কাঁদছি, কারণ জনি কাঁদছে। ওর দুঃখে আমি সমব্যথী। জনি কাঁদছে, কারণ সে বদমাশ ছাগলগুলো তাড়াতে পারেনি। দাদির সাধের শালবাগান ওদের দ্বারা তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও ছাগলগুলোকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছিলাম। পারিনি। মনের দুঃখে তাই কাঁদছি।
কুকুর কী যেন একটু চিন্তা করল। তারপর সবজান্তার মতো বলল: "আমার মনে হয়, এই সমস্যাটার সমাধান আমি করতে পারব। এ নিয়ে তোমরা একটুও ভেবো না। চুপটি করে বসো। দ্যাখোই না কী করি।
কুকুর দৌড়াতে শুরু করল ছাগলের পালের পেছন পেছন। ছাগলগুলোও তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে থাকে। লাফানো না শুধু, রীতিমতো দৌড়ানো। শুরু হয় কুকুর-শিয়ালে দৌড়াদৌড়ির খেলা।
জোরেশোরে ছুটতে পারার জন্য কুকুরের সুনাম আছে। কিন্তু কুকুর এই দফায় ফেল মেরে গেল। পারল না কিছু করতে। ছাগলগুলো এমন জোরে জোরে দৌড়াল যে কারও নাগালই পাওয়া গেল না।
বেজার মুখে রণে ভঙ্গ দিল কুকুর। অপমানের জ্বালায় মুখটা তার কাঁদো কাঁদো। শিয়াল ও জনির সঙ্গে সেও এসে যোগ দিল। শুরু করে দিল সমবেত কান্নাকাটি।
এমন সময় দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে চলে এল এক খরগোশ। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলে, মড়াকান্না কাঁদছে তিনজনা। সে কৌতূহলী মুখ করে জানতে চাইল: "বলি, এত কান্নাকাটির কী হয়েছে বাপুরা? কী এমন ঘটনা ঘটেছে যে এমন করে এতিমের মতো কাঁদতে হবে? তোমাদের আপনজন কেউ মারাটারা গেছে নাকি"?
কুকুর ও শিয়াল কাতরকণ্ঠে জানাল: "জনি একটা মহাবিপদের মধ্যে আছে। দাদির শালগমের বাগান সাফ করে ফেলছে দস্যি ছাগলের দল। ও সেটা থামাতে পারেনি। বাড়ি ফিরলে বকাঝকা খেতে হবে। তাই সে দিশেহারা হয়ে কান্নাকাটি করছিল। আমরাও ছাগল তাড়ানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সুবিধা করতে পারিনি। তাই আমরাও কাঁদছি। "
খরগোশ এ কথা শুনে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর মাথা চুলকে বলল: ও আচ্ছা, ব্যাপার তাহলে এই! আমি ভেবেছিলাম, কী–না–কী। ঠিক আছে, আমিও একটু চেষ্টা করে দেখি না কেন। আমাকে একটা সুযোগ দাও দিকি। যদি কিছু করা যায় তাহলে আমিও তোমাদের সঙ্গে কান্নাকাটি করব।
সবাই ওর কথায় সায় দিল। খরগোশ দেরি না করে তক্ষুনি কাজে লেগে পড়ল। কিন্তু ছাগলগুলো মহা ধড়িবাজ। পুঁচকে একটা খরগোশকে তারা মানতে যাবে কোন দুঃখে? তাই থোড়াই কেয়ার করে। উল্টো খরগোশকে শিং দিয়ে গুঁতো মারে।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাচ্ছে- তারপর কী হলো? কী আর হবে- খরগোশও যথারীতি ব্যর্থ হয়ে শামিল হলো ওই ছিঁচকাঁদুনে দলের সঙ্গে। কান্নাকাটি করা ছাড়া তারা করবেই–বা কী!
এই সময় হঠাৎ কোত্থেকে যেন ভোঁ ভোঁ করে উড়তে উড়তে একটা পিচ্চি মৌমাছি এসে হাজির হলো। একসঙ্গে এতজনকে কখনো কাঁদতে দেখেনি মৌমাছি। খুবই অবাক ব্যাপার। কী হয়েছে এখানে? ওরা কেন এমন সর্বহারার মতো কাঁদছে? বিষয়টা জানা দরকার।
জানবার জন্যই ওড়াউড়ি বন্ধ করে থামল সে। থেমেই প্রশ্ন করে কাঁদুনে পার্টিকে, কী ব্যাপার? সবাই মিলে এমন বিলাপ করে কাঁদছ কেন? ঘটেছে কী? আমাকে একটু খুলে বলো না।
মৌমাছির মতো পুঁচকে একটা প্রাণী কী আর করতে পারে- এমনটা ভেবে কেউই তার কথার জবাব দিল না। মৌমাছি আবার তাড়া দিলে খরগোশ বেজার মুখে বলল: "ভাই রে, ঘটনা যা ঘটে গেছে এবং ঘটছে, তা বড়ই গুরুতর। তোমাকে বলে আর কী হবে? তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না।"
মৌমাছি গোঁ ধরে বলল: "আমাকে অত ফালতু আর অকাজের ভেবো না। ছোট হলেও কোনো কোনো ব্যাপারে আমার ক্ষমতা, ক্ষমতা অনেক। একটা পরীক্ষা নিয়েই দ্যাখো না কেন।"
শিয়াল দোনোমোনো করে আসল ঘটনা খুলে বলল। মৌমাছি সবটা শুনে বলল: "এটা তেমন কোনো সমস্যাই না। মাত্র ১০ মিনিটের ব্যাপার। এর চেয়ে বেশি লাগবে না। এই সামান্যটুকু সময় তোমরা আমাকে দাও। সময়টা দিয়ে চুপচাপ বসে বসে মজা দেখো। সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি। তোমরা শুধু চেয়ে চেয়ে কীভাবে কী ঘটে, সেটা প্রাণভরে দ্যাখো।"
এ কথা বলে মৌমাছি সোজা উড়ে গেল ছাগলের পালের দলনেতার কাছে। তার কানে ঢুকে পট করে হুল ফুটিয়ে দিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল ধাড়ি ছাগল। মৌমাছি তখন দ্বিতীয়বার হুল ফোটাল। ধাড়ি ছাগল মরণ চিৎকার দিয়ে হাত-পা ছুড়তে থাকল। মৌমাছি তখন অন্য কানে উড়ে গিয়ে হুল ফোটাল।
ধাড়ি ছাগলের লাফানির চোটে দলের অন্যসব ছাগল হতভম্ব হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। ব্যাপার কী? মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। দলপতি ছাগল প্রাণ বাঁচাতে পড়ি মরি করে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
দলনেতা শালগম বাগান থেকে বেরিয়ে গেলেও মৌমাছি একের পর এক অন্যান্য ছাগলের কানেও হুল ফোটাতে থাকল। এসময় অন্যরাও ছটফট করতে করতে বাগান ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
অল্প দূরে একটা পুকুর ছিল। সব ছাগল গিয়ে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাগান যখন একেবারেই ছাগল-শূন্য হয়ে পড়ল, তখন মৌমাছির মুখে ফুটে উঠল বিজয়ীর হাসি। এমন আনন্দ সে জীবনে আর কখনো পায়নি।
এ দৃশ্য দেখে জনিও মহাখুশি। ছোট্ট মৌমাছির দারুণ কাজের তারিফ করে সে বলল: "অজস্র ধন্যবাদ তোমাকে, প্রিয় মৌমাছি। আজ তুমি যা করে দেখালে, তার কোনো তুলনাই নেই। আমরা অবাক হয়েছি তোমার নৈপুণ্য দেখে। যেন ম্যাজিকই দেখালে। তোমার উপকার আমরা কোনো দিন ভুলব না। তোমার ওপর আমরা প্রথমটায় আস্থা রাখতে পারিনি। সে জন্য আমাদের দোষ ধরো না। নিজগুণে মাপ করে দিয়ো ভাই। আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু হলে। পরম বন্ধু।"
এসময় শিয়াল, কুকুর, খরগোশও অনেক অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানাল ছোট্ট মৌমাছিকে। প্রশংসা শুনে মৌমাছিও মহাখুশি। শুধু প্রশংসাই নয়, সবাই তার বন্ধু হয়ে গেছে এখন। সেটা বাড়তি পাওনা। আনন্দিত মনে ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে সে চলে গেল নিজের কাজে।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে দুটি ছোট্ট কবিতা। এগুলো লিখেছেন বাংলাদেশের রাজশাহীর বন্ধু আতাউর রহমান। আর আবৃত্তি করেছে আতাউর ভাইয়ের মেয়ে উম্মে আনজুম।
রংধনু নিয়ে তোমার কবিতাটি ভালো লেগেছে। তো এবার অন্য কবিতাটি শোনাও।
মাকে নিয়ে লেখা কবিতাটিও সুন্দর হয়েছে। তো রংধনু আসরে অংশ নেওয়ার জন্য উম্মে আনজুম তোমাকে আর চমৎকার কবিতা দুটির জন্য তোমার বাবাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বন্ধুরা, অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি ইংলিশ গান। My Hero শিরোনামের গানটি গেয়েছে ব্রিটিশ কিশোর শিল্পী হারিস জে. । বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে।#
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।