আগস্ট ০৬, ২০২৩ ১৪:৫৬ Asia/Dhaka
  • ভিক্ষুকের বাদশাহী এবং অতপর ...

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। বিখ্যাত কবি শেখ সাদির গোলেস্তান থেকে নেয়া গল্পটি এরকম:

প্রাচীনকালের কথা। এক বাদশাহ ছিল আটকুঁড়ে মানে তার নসিবে কোনো সন্তানাদির নিয়ামত ছিল না। সুতরাং সে মারা গেলে কে হবে তার স্থলাভিষিক্ত-এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বাদশা। জীবন তো আর বসে থাকে না। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছেছে বাদশা।

একদিন বাদশা তার মন্ত্রীদের ডেকে আনলো। সবাই যখন সমবেত হলো বাদশা বলতে শুরু করলেন: সবাই মনোযোগের সঙ্গে আমার কথাগুলো শুনুন। আমি অসিয়্যত করে যেতে চাই যাতে আমার মৃত্যুর পর দেশে কোনোরকম বিশৃঙ্খলা, ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি না হয়। আমার অসিয়্যত হলো আমার মৃত্যুর পর খুব ভোরে ভোরে শহরের প্রবেশদ্বারে যাবেন। যাকে দেখবেন সবার আগে শহরে প্রবেশ করছে তাকেই বাদশা হিসেবে মনোনীত করবেন এবং শাহী তাজটা তার মাথায় দিয়ে দেবেন। আপনারা সবাই শহরের দরোজায় উপস্থিত থাকবেন যেন কেউ প্রতারণার আশ্রয় নিতে না পারে কিংবা কেউ কারও অধিকার নষ্ট করতে না পারে। এ ব্যাপারে আপনারা কারও সঙ্গে আলাপ করবেন না। বাদশার গুরুত্বপূর্ণ অসিয়্যত শুনে মন্ত্রী-উজিরদের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হলো।

মন্ত্রীদের প্রতিক্রিয়ার আগে বাদশাহ আরও বললো: আপনারা যদি অন্যদের সঙ্গে এ বিষয়টা নিয়ে আলাপ করেন তাহলে ওইদিন সকালে বহু সুযোগ সন্ধানী আগেভাগে এসে শহরে প্রবেশ করার চেষ্টা করবে। যার ফলে দেশজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে এবং দেশের নিয়ন্ত্রণ আপনাদের হাত থেকে বাইরে চলে যেতে পারে। সেদিন সকালে সবার আগে যে শহরে ঢুকবে সে এই রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হবে এবং এই রাজাসনে আইন অনুযায়ী সে-ই স্থলাভিষিক্ত হবে। আমি যদি শুনি আপনাদের মধ্য থেকে কেউ এই গোপন রহস্য ফাঁস করে দিয়েছেন তাহলে কোনোরকম দয়া দেখানো হবে না। নির্ঘাত তাকে হত্যা করা হবে। মনে রাখবেন এটা এমন এক রহস্য যা সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত ঢাকা রাখতে হবে।

এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের পর অনেকটা সময় গেছে। দিন-সপ্তাহ-মাসের শেষে সেই প্রতিশ্রুত সময় এলো। বাদশা স্রষ্টার আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে গেল ওপারে। দেশবাসী তাদের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো এবং প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বলাবলি করতে লাগলো। মন্ত্রীরা বাদশাকে কবর দিয়ে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো পরদিন খুব ভোরে সবাই শহরের প্রধান প্রবেশদ্বারে যাবে। দরোজায় গিয়ে তারা তাদের ভবিষ্যত বাদশাহর চেহারা দেখার অপেক্ষায় থাকবে। পরেরদিন ঠিকই শুভ্র ভোরের আগেভাগে সকল উজির শহরের প্রবেশদ্বারে গিয়ে উপস্থিত হলো এবং দরোজা খোলার অপেক্ষায় থাকলো। ঘটনাক্রমে সেইদিন যখন দরোজা খোলা হলো দেখা গেল এক দরিদ্র ফকির প্রবেশ করলো সবার আগে।

অসিয়্যত অনুযায়ী মন্ত্রী-উজির সবাই ওই ভিক্ষুককে ব্যাপক সম্মান দেখিয়ে এবং বিশেষ অভিষেক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাদশাহির তাজ তার মাথায় পরিয়ে দিলো। নিয়ম অনুযায়ী তাকে বাদশাহ হিসেবে বরণ করে নিলো এবং তার সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করলো সবাই। ফকির বেচারা তো কিছুই জানতো না। তাই মন্ত্রীদের কাজকর্ম দেখে অবাকই হচ্ছিলো। মনে মনে ভাবছিলো তারা হয়তো মজা করছে, ঠাট্টা মশকরা করছে। মন্ত্রীরা নতুন বাদশাকে প্রাসাদের দিকে নিয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত ওই বেচারা ফকিরই দেশের বাদশা হিসেবে মনোনীত হলো। দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল ফকির বাদশাহী প্রাসাদে আরাম-আয়েশের সঙ্গে কাটাতে লাগলো এবং প্রয়োজনীয় আদেশ-নির্দেশ দিতে লাগলো। একসময় যে কিনা রাতের খাবারের জন্য এক টুকরো রুটির সন্ধানে থাকতো সে এখন নিয়ামতের প্রাচুর্যে ডুবে আছে।

খাচ্ছে দাচ্ছে ঘুমাচ্ছে আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছে এজন্য যে আগের বাদশাহকে সন্তানহীন অবস্থায় দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছেন। সন্তান থাকলে তো আর সে কোনোদিন বাদশাহ হতে পারতো না। সে তাই আল্লাহর দরবারে তার পুত্রসন্তান লাভের জন্য দোয়া করতে লাগলো যাতে তার মৃত্যুর পর তার সন্তান বাদশার আসনে বসতে পারে। ফকির বাদশা যদিও মসনদে আসীন হয়ে আনন্দিত কিন্তু দেশ পরিচালনার নিয়ম-কানুন না জানার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। সুতরাং ধীরে ধীরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত বিশৃঙ্খলার খবর তার কানে আসতে লাগলো। কিন্তু কী করবে সে বুঝতে পারছিলো না। তাই শুধু বিরক্ত হতো, রাগ হতো আর 'আহ' 'আহ' শব্দ করে তার মনের কষ্টকর অবস্থার কথা প্রকাশ করতো।

বেচারা ফকির বাদশাহ তো জানতোই না কী করে এরকম বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে হয়। না সে বাদশাহি করার পদ্ধতি জানতো না জানতো দেশ পরিচালনার রাজনীতি। যতোই দিন যাচ্ছিলো ততোই দেশের ভূখণ্ড হারাতে লাগলো। ফকির বাদশা প্রাসাদেই পড়ে থাকতো আর রাগ করে বসে থাকতো। একদিন ওই ফকির বাদশার পুরণো এক বন্ধু দীর্ঘদিন বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরলো এবং তার বন্ধুকে বাদশাহির আসনে আসীন দেখলো। দেখা করতে গেল তার সঙ্গে। বললো: আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি এজন্য যে কীরকম দু:খ কষ্ট থেকে মুক্তি পেলে। আল্লাহ তোমাকে বাদশাহির মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এখন আর তোমাকে রুটি রুজি নিয়ে ভাবতে হয় না, না জীবন নিয়ে ভাবতে হয়। বাদশাহ বন্ধুর কথা শুনে মাথা নাড়লো এবং বললো:

প্রিয় বন্ধু আমার! আজ অভিনন্দন জানানোর সময় নয়। চারদিক থেকে বিশৃঙ্খলার খবর আসছে। আমি আমার সেই দারিদ্র্য আর অভাব অনটনের দিনগুলোর কথা ভাবছি। সে সময় শুধুমাত্র একটুখানি রুটি-পণিরের চিন্তায় ভুগতাম। কিন্তু আজ এক দুনিয়ার উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় ভুগতে হচ্ছে আমাকে। আমি এখন বুঝতে পারছি এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে তৃপ্তি হল সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন যা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন।  কিন্তু আমার মতো অনেকেই তার মর্যাদা উপলব্ধি করে না।#

পার্সটুডে/এনএম/৬/৭৭

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ