আগস্ট ১৪, ২০২৩ ১৭:২৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। 

মৌলাভি জালালুদ্দিন রুমি'র মাসনাবি থেকে নেওয়া গল্পটি হলো: প্রাচীনকালে একজন হাকিম মানে খুব জ্ঞানী-গুণী মনীষী ছিলেন। এই প্রজ্ঞাবান মানুষটি আল্লাহর মেহেরবানিতে পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন। হাকিম একদিন অবকাশ যাপনের জন্য গেলেন একটি বনে। হাঁটতে হাঁটতে তিনি গাছে গাছে, লতাগুল্মে বসা পাখির সঙ্গে কিংবা নীচে, মাটিতে কোনো পশুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে সময় কাটাচ্ছিলেন। এতে তাঁর একাকিত্ব দূর হয়ে যাচ্ছিলো।

এভাবে যেতে যেতে হাকিম জঙ্গলের ভেতর একটা ছোট্ট স্কোয়ারের মতো গাছ-গাছালিহীন খালি জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন। গাছ না থাকলেও সেখানে ছিল ফুল-লতা-পাতা আর বড় বড় পাথর। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাকিম দেখতে পেলেন চমৎকার একটি ময়ূর সেখানে পাথরের ফাঁকে বসে আছে। ময়ূর তার পালকগুলো এক এক করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। হাকিম এক কোণে লুকিয়ে ময়ূরের কাণ্ড দেখছিলেন। পালক ছিঁড়তে ছিঁড়তে ময়ূর ভালোরকম ব্যথাও পাচ্ছিলো, তারপরও ছিঁড়েই যাচ্ছিলো পালক।

মজার ব্যাপার হলো ময়ূরটি তার পালক ছেঁড়ার ব্যথা সহ্য করে যাচ্ছিলো এবং নির্বিঘ্নে পালক ছিঁড়ছিল। হাকিম অবাক হয়ে ময়ূরের কাণ্ড দেখছিল। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলো না এতো সুন্দর তার পালক এতো সুন্দর পাখা-কেন সে ছিঁড়ছে! কতো হাজার ডিজাইন তার পালকে যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। হাকিম ময়ূরের এই পালক ছেঁড়ার ঘটনাটাকে আল্লাহর প্রতি অকৃজ্ঞতা হিসেবে দেখছিল। কেননা আল্লাহ ময়ূরকে এতো সুন্দর ডিজাইনের পালক দান করলো আর সে কিনা সেগুলোকে ছিঁড়ে ফেলছে-এটা একেবারেই অকৃতজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। হাকিম সিদ্ধান্ত নিলো এই ঘটনার রহস্য উদ্ধার করবে। এই ভেবে তিনি ময়ূরের সামনে গিয়ে সালাম দিলেন।

ময়ূর মানুষ দেখে প্রথমেই ভয় পেয়ে গেল। ভাবলো শিকারী হবে হয়তো। নিশ্চয়তা কী? হয়তো তাকে শিকার করতেই লোকটি এসেছে! কিন্তু যখন দেখলো যে সে তো পাখিদের মতোই কথা বলছে, বুঝতে পারলো ভয় কিংবা হুমকির কিছু নেই। হাকিম বললেন: এই সুন্দরী ময়ূর! দূর থেকে দেখছিলাম সুন্দর পালকগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দিচ্ছো! ঘটনা কী? ছিঁড়ছো কেন? তুমি কি জানো না তোমার পালকগুলো কতো সুন্দর? মানুষেরা তোমার ওই পালককে কতোটা ভালোবাসে, পছন্দ করে, কতোাট মূল্য দেয়-তুমি কি জানো? শিক্ষিত মানুষেরা তোমার ওই পালককে বইয়ের পাতার ভাঁজে ভাঁজে যত্ন করে রাখে।  ধনী মানুষেরা ওই পালক দিয়ে তাদের ক্যাপ সাজায়। আর তুমি কি করে এতো সুন্দর পালকগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিচ্ছো? তুমি কি জানো না এটা আল্লাহর দরবারে এক ধরনের অকৃতজ্ঞতা?

ময়ূরকে বলছিল যে, তুমি কি জানো না এটা আল্লাহর দরবারে এক ধরনের অকৃতজ্ঞতা? হয়তো জানো কোনো কারণে রাগ করেই এ কাজ করতে দ্বিধা করছো না তুমি। কিন্তু এটাও তোমার জানা উচিত কোনো কৃত্রিম রাগের বশবর্তী হয়ে এ ধরনের কাজ করলে আল্লাহর দরবারে গুনাহ হিসেবে সাব্যস্ত হতে পারে। সেরকম কিছু হলে তুমি কি ক্ষমার অযোগ্য গুনাহগার হবে না? হাকিম বললো ময়ূর কেবল কান পেতে কথাগুলো শুনলো কিন্তু কিছুই বললো না। অবশেষে হাকিম জিজ্ঞাসা করলো: কী হে সুন্দর ময়ূর! কথা বলছো না কেন? অন্তত এটুকু তো বলো-কেন পালক ছিঁড়ছো? এমনও তো হতে পারে তোমার কাজের পক্ষে যুক্তি আছে! ময়ূর সরে গিয়ে একটা পাথরের ওপর বসলো।

তারপর বললো: হে বিজ্ঞ হাকিম! তুমি নিজে বলছো আমাদের পালকগুলো মানুষের কাছে খুব ভালো লাগে, এগুলো মানুষের কাছে অনেক প্রিয়। তুমি বলেছো আমাদের পালক বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে ভাঁজে রাখা হয় কিংবা মাথার ক্যাপে লাগিয়ে ডিজাইন করা হয়। তুমি নিজে এসব কিছুই ভালো করে জানো। অথচ তুমি নিজে একবারও কেন ভাবলে না কী কারণে আমি আমার পালক ছিঁড়ছি? তুমি কি মনে করো শিকারীরা খুব সম্মানের সাথে, মিষ্টি ভাষায়, আদর-ভালোবাসা দিয়ে আমাদেরকে বলে: হে সুন্দর ময়ূর! তোমার একটি পালক আমাকে দাও! আর আমি তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাই করবো? না হাকিম! ওরা আমাদের মেরে ফেলে। তারা এই সুন্দর পালকের জন্য আমাদের জীবনটাই নিয়ে নেয়।

ময়ূর হাকিমকে বলেছিলো: শিকারীরা এই সুন্দর পালকের জন্য আমাদের জীবনটাই নিয়ে নেয়। হ্যাঁ, এই সুন্দর পালকই ময়ূরদের জীবনের জন্য বড় রকমের আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সুন্দর পালকগুলো না থাকলে আমরা নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারতাম। আমাদের লক্ষ্য করে কোনো শিকারী আর তীর ছুঁড়ে মারতো না। এখন তুমিই বলো হে বিজ্ঞ হাকিম! পালক ছেঁড়া ছাড়া শিকারীর হামলায় মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার মতো আর কী উপায় আছে? আমাদের ময়ূরদের সুন্দর পালক তখনই সুন্দর ও আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হবে যখন এগুলো আমাদের জন্য হুমকির কারণ না হয়! এখন কি বুঝতে পেরেছো হে বিজ্ঞ মনীষী! কেন আমি আমার সুন্দর পালকগুলো একে একে ছিঁড়ে ফেলছি?

হাকিম এবার মাথা নিচু করে রইলেন, কিছুই বললেন না। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ময়ূরের কথা না জেনে তিনি একতরফাভাবে তার পালক ছেঁড়ার বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন। ময়ূরকে নিয়ে তার বিচার-বিবেচনাটা একপেশে হয়ে গেছে। তার কথা না শুনে বিচার করা ঠিক হয় নি। এ সত্য বুঝতে পেরে চুপ হয়ে রইলেন হাকিম। ময়ূরকে বলার মতো কিছু ছিল না তাঁর।#

পার্সটুডে/এনএম/১৪/৮০

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ