গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রবাদ: বুঝলাম না বন্ধু,তুমি কার-আমার নাকি নেকড়ের?
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদেটি হলো: বুঝলাম না বন্ধু,তুমি কার-আমার নাকি নেকড়ের? এই প্রবাদের পেছনে একটা গল্প আছে। গল্পটি এরকম:
দুই বন্ধু শিকার করার উদ্দেশে বাড়ি থেকে একসঙ্গে বের হলো। দু'জনের কাছে কিন্তু বন্দুক ছিল না। বন্দুক ছিল একটা। ওই বন্দুকটা নিয়ে সকাল সকাল তারা কিছু খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। পার্বত্য পথ ধরে দুই বন্ধু আঁকাবাঁকা পধ ধরে যেতে যেতে শহরের কাছে জঙ্গলময় একটা উপত্যকায় কালো একটা নেকড়ে দেখতে পেল।
এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে বললো: এরচেয়ে ভালো শিকার আর কি হবে? চলো, নেকড়েটাকেই শিকার করি আমরা। দ্বিতীয় বন্ধু বললো: নেকড়ে শিকার করে কী লাভ? না আমরা তার মাংস খেতে পারবো, না তার চামড়ার কোনো মূল্য আছে। তারচে ভালো অন্য কোনো শিকারের সন্ধান করি। প্রথম বন্ধু বললো: ঠিক আছে, নেকড়ের মাংস কিংবা তার চামড়ার কোনো মূল্য নেই,তবে নেকড়ে শিকার করতে পারা তো বিশাল একটা গর্বের বিষয়। এই সুযোগ তো সব শিকারির কপালে জোটে না। আমাদের সৌভাগ্য হলো-এটা কি হাতছাড়া করা উচিত?
দ্বিতীয় বন্ধু কিছু বলার আগেই প্রথম বন্ধু কথা বলতে লাগলো: দেখো! নেকড়ে শিকার করতে পারলে জনগণ আমাদের দিকে অন্যরকমভাবে তাকাবে। আমাদেরকে দেখেই তারা খুশি হয়ে যাবে। মানুষ তো নেকড়েকে ভীষণ ভয় পায়। তারা নেকড়ের আক্রমণের ভয়ে জড়োসড়ো এবং উদ্বিগ্ন। সুতরাং নেকড়েটাকে শিকার করলে জনগণও ভীষণ খুশি হবে এবং তারা নিশ্চিন্ত থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, একটা রক্তপিপাসু হিংস্র প্রাণী শিকার করলে মানুষের বিপদের আশঙ্কা একটু হলেও কমবে। মানুষের কথা ভেবে এ কাজ করলে আল্লাহও খুশি হবেন। কারণ এ কাজটা মানব কল্যাণে করা হবে।
অপর বন্ধু বললো: কিন্তু যদি তীরটি ভুল নিশানায় যায় এবং নেকড়ে মারা না যায়? তাহলে তো আমাদের ওপর উল্টো এমন এক বিপর্যয় নেমে আসবে যা সামাল দেওয়া দুরূহ হয়ে উঠবে। তখন না মুসলিম আমাদের কথা শুনতে আসবে, না কাফের দেখতে আসবে। নেকড়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করবে এবং আমরা নিজেরাই নেকড়ের শিকারে পরিণত হবো। প্রথম বন্ধু বললো: আহ হা! তুমি এভাবে কেন বলছো? আমার লক্ষ্যভেদ করার নৈপুণ্য ভুলে গেছো নাকি! আমি শূন্যে ছুঁড়ে মারা কয়েন বন্দুক ছঁড়ে ফুটো করি। আর তুমি এতো বড় নেকড়ে শিকার নিয়ে ভাবছো? বন্ধু এবার চুপ মেরে গেল। নিপুণ শিকারী বন্ধু এবার বন্দুক কাঁধে নিয়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে লুকালো।
পাথরের আড়াল থেকে অপেক্ষা করতে লাগলো বন্দুকের নিশানায় নকড়ের আসার জন্য। হাত ইশারায় বন্ধুকেও কাছে ডেকে নিয়ে বললো: ওর ঠিক পেটে গুলি করবো যাতে যা কিছু খেয়েছে, বেরিয়ে আসে। দ্বিতীয় বন্ধু বললো: না, না! পেটে মেরো না! পেটে মারলে ও মরবে না। পরে সব বরবাদ হয়ে যাবে। কিছুই করার থাকবে না আমাদের। প্রথম বন্ধু বললো: হুমম তাহলে ওর পিঠে মারবো যাতে আর সোজা হতে না পারে। দ্বিতীয় বন্ধু বললো: নাহ, পিঠে মারলেও মরবে না নেকড়ে। উল্টো আমাদের ওপর হামলা করে বসেতে পারে। প্রথম বন্ধু বললো: তাহলে কি মাথায় গুলি করবো? যাতে সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়? দ্বিতীয় বন্ধু বললো: নেকড়ের মাথায় গুলি করা ঠিক নয়। মাথাই যদি না থাকে তাহলে কেউ বিশ্বাস করবে না যে তুমি যা শিকার করেছো সেটা একটা নেকড়ে।
মাথা না থাকলে সকল শ্রমই বৃথা যাবে, গর্ব তো ছাই! গুলিটাও বেকার খরচ হবে। শিকারী বন্ধু এবার রেগে গেল। খানিক থেমে বললো: ওর ঘাড়ে গুলি করবো। তাহলে মারাও যাবে আবার বোঝাও যাবে ওটা একটা নেকড়ে। এভাবে দুই বন্ধু কথা বলার মাঝে নেকড়েটাকে যেখানে ভালোভাবে মারা যেত সেখান থেকে সরে গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে ঢুকে গেল। শিকারী বন্ধু বললো: দেখলে তো, কী হলো এখন? এতো বেশি কথা বলেছো যে নেকড়ে এখন আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। দ্বিতীয় বন্ধু বললো: খুব ভালো হয়েছে! নেকড়ে শিকারের চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও! চলো আমরা আমাদের কাজে যাই। কিন্তু না, শিকারী বন্ধু বললো: তা হবে না।
শিকারী বন্ধু বললো: আমি যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা করবোই। নেকড়ে শিকার করবো। কী আর করা! দুই বন্ধু শেষ পর্যন্ত আধা ঘণ্টার মতো ওই পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকলো। অপেক্ষা করতে করতে একটা সময় নেকড়েটাকে আবারও দেখা গেল। শিকারী বন্ধু তাড়াতাড়ি বন্দুক প্রস্তুত করে কাঁধেদ তুলে নিলো এবং নেকড়েকে টার্গেট করলো। অপর বন্ধু বললো: তাহলে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছো? নেকড়ের শরীরের কোন অংশে গুলি করবে? শিকারী বন্ধু বললো: কেন আমরা তো সিদ্ধান্তই নিলাম নেকড়ের ঘাড়ে গুলি করবো। বলতে বলতে প্রস্তুত হলো গুলি করার জন্য। অপর বন্ধুটি দ্রুত বন্দুকের ওপর তার হাত রেখে গুলি করতে বাধা দিলো। শিকারী বন্ধু বললো: কী ব্যাপার! গুলি করতে দিলে না যে? নেকড়ে তো পালিয়ে যাবে! আবার ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে ওকে দেখার জন্য।
দ্বিতীয় বন্ধু বললো: দোস্ত! ঘাড়েও গুলি করো না! যদি নেকড়ে না মরে ক্ষিপ্ত হয়ে যার তার ওপর হামলা করতে পারে। শিকারী বন্ধু রেগেমেগে ঘাড় থেকে বন্দুক নামিয়ে মাটিতে রাখলো। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় বন্ধুকে বললো: বুঝলাম না, তুই আমার বন্ধু নাকি নেকড়ের? এই ঘটনার পর থেকে যখনই শত্রুর ক্ষতি করতে গেলে কেউ বাহানা তৈরি করে বিরত রাখতে চায় তার সম্পর্কে বলতে শুরু করলো: বুঝলাম না বন্ধু,তুমি কার-আমার নাকি নেকড়ের?#
পার্সটুডে/এনএম/১৬/৮১
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ