আগস্ট ২০, ২০২৩ ২০:০৫ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি হলো:

প্রাচীনকালে এক গরীব শেখ অচেনা এক শহরে গেল। স্বাভাবিকভাবেই ওই শহরে তার কোনো বন্ধুবান্ধব কিংবা চেনাজানা লোকজন ছিল না। পরিচিত কেউ থাকলে তো তার বাসায় গিয়ে রাত্রিটা যাপন করা যেত। নিরুপায় হয়ে শেখ সিদ্ধান্ত নিলো কারো বাসার দ্বারে টোকা মারবে এবং একটি রাত তার বাসায় অতিথি হিসেবে থাকার আবেদন জানাবে।

প্রথম যে বাসাটি সামনে পেলো, ওই ঘরের দরোজায় টোকা মারলো। এক অন্ধ বৃদ্ধ দরোজা খুললো। জিজ্ঞেস করলো: কী চাও? শেখ যখন বুঝতে পারলো দরোজা খুলে দেওয়া বৃদ্ধ লোকটি অন্ধ, একটু লজ্জাই পেলো। কিন্তু কী করবে? অগত্যা বললো: আমি একজন মুসাফির। এই শহরে আমার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই কিংবা পরিচিতও কেউ নেই যার কাছে এই রাতটি কাটিয়ে দিতে পারি। পরিচিত কোনো জায়গার কথাও জানা নেই যেখানে যেতে পারি। বৃদ্ধ অন্ধ লোকটি বললো: ভেতরে এসো! অতিথি হলো আল্লাহর বন্ধু! আমার বাড়ির দরোজা অতিথির জন্য দিবারাত্রিই খোলা। অন্ধ বৃদ্ধের কথায় আশ্বস্ত হয়ে শেখ বাড়ির ভেতর ঢুকলো। ঘরে পা রাখতেই থমকে গেল সে। 

অন্ধ বৃদ্ধের ঘরে পা রাখতেই মুসাফিরের চোখ নিবন্ধ হলো বিশাল একটি কোরআনের ওপর।  বিশাল ওই কারআনটি রুমের মাঝখানে একটি বড়ো রেহেলের ওপর খোলা। মুসাফির বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলো: তুমি কি এই বাসায় একাই বসবাস করো নাকি আরও কেউ আছে তোমার সঙ্গে? অন্ধ লোকটি বললো: আমি একাই এ বাসায় বসবাস করি। শেখ বিস্মিত হলো এবং মনে মনে বললো: একজন অন্ধ লোক কী করে কুরআন খুলে পড়তে পারে! নিশ্চয়ই পড়তে পারে না। তাহলে এতো বড়ো কুরআন কী কারণে এভাবে রেহেলের ওপর খুলে রেখেছে?

শেখের কৌতূহল জাগলো। কিন্তু কীভাবে সই কৌতূহল মেটাবে-বুঝে উঠতে পারছিলো না। একবার ভাবলো ঘটনাটা বৃদ্ধের কাছেই জিজ্ঞেস করে জেনে নেবে। আবার মনে মনে লজ্জা পাচ্ছিলো। কেননা সে ভাবলো: আমি তো একজন অতিথি মাত্র। যিনি আমাকে অতিথি হিসেবে বরণ করলেন তাকে এভাবে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? তারচে বরং ধৈর্য ধরাই উত্তম। এই ভেবে মুসাফির অপেক্ষা করতে লাগলো। রেহেলের ওপর খুলে রাখা বিশাল কুরআন সম্পর্কে কিছুই জানতে চাইলো না। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। 

কিন্তু মাঝরাতে একটা শব্দ শুনে অতিথি মুসাফিরের ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা ছিল কুরআন তিলাওয়াতের। দারুণ এক সুরে কুরআন তিলাওয়াত করছিলো কেউ। অতিথি ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসে বসে অবাক হয়ে কান পেতে শুনছিল সেই তিলাওয়াত। এরপর অতিথি অন্ধকারের ভেতরেই ওই শব্দ অনুসরণ করে সেদিকে এগিয়ে গেল। যখন সেই অন্ধ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে পৌঁছলো, দেখলো বৃদ্ধ কোরআনের রেহেলের সঙ্গে বুক ঘনিয়ে বসে তিলাওয়াত করছে। অতিথি মনে মনে বললো: এই বৃদ্ধ কি আসলেই অন্ধ? না-ও হতে পারে। হয়তো আমার সঙ্গে অন্ধের অভিনয় করছে! আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে অতিথি মুসাফির গভীর মনোযোগের সঙ্গে কুরআন এবং বৃদ্ধের দিকে তাকালো।

তাকিয়ে দেখলো বৃদ্ধের চোখ সত্যিই বন্ধ, অথচ কুরআন পড়ছে। অবাক করা বিষয়টি হলো বৃদ্ধের আঙুল কুরআনের যে শব্দের ওপর পড়ছে সেই শব্দই তিলাওয়াত করছে। মুসাফির এবার আর অপেক্ষা করতে পারলো না। ধৈর্যের পেয়ালা তার উপচে পড়লো। অন্ধ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললো: তুমি তো অন্ধ, দেখতে পাচ্ছো না, তাহলে কীভাবে কুরআন পড়ছো? আবার ঠিক যে শব্দটিতে আঙুল রাখছো সেই শব্দটিই কীভাবে তিলাওয়াত করছো? অন্ধ বৃদ্ধ বললো: এতে অবাক হবার কী আছে? কুরআন যারা তিলাওয়াত করে এভাবেই তো করে। যে শব্দটির ওপর আঙুল রাখে সে শব্দটিই তিলাওয়াত করে। অতিথি বললো: কিন্তু তুমি তো অন্ধ, শব্দ তো দেখতে পাও না, তাহলে  এ কাজ করো কী করে? রহস্যটা কী? 

অতিথির প্রশ্নের জবাবে অন্ধ বৃদ্ধ বললো: রহস্যটা হলো আমি তিলাওয়াত ভালোবাসি। আমার মনে তিলাওয়াত করার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অন্ধের পক্ষে তো সেটা সম্ভব না। তাই এক রাতে আমি আল্লাহর কাছে সাহায্যের আবেদন জানালাম আমাকে যেন দৃষ্টিবানদের মতো কুরআন তিলাওয়াত করার ক্ষমতা দেয়। অতিথি অবাক হয়ে বললো: আল্লাহ তোমাকে দৃষ্টিশক্তি দান করেছে? বৃদ্ধ বললো: না। দেখতে পাচ্ছো না আমি এখনও অন্ধ! মুসাফির বললো: এ কারণেই তো আমি অবাক হচ্ছি! বৃদ্ধ বললো: আমি কুরআন পড়ার শক্তি চেয়েছি, আল্লাহ কবুল করেছেন। কিছুদিন পর আমার ওপর এলহাম হলো: "আল্লাহ যা চান তাই করতে পারেন-আল্লাহর এই শক্তির ওপর তুমি যেহেতু আস্থা রেখেছো! আল্লাহ তাই তোমাকে এই শক্তি দান করেছেন যখনই তুমি কুরআনের সামনে বসবে তুমি কুরআন পড়তে পারবে"।

মুসাফির অবাক হয়ে বললো: আল্লাহ আকবার! অন্ধ বৃদ্ধ বলতে লাগলো: "তার পর থেকে যখনই আমি কুরআনের রহেলের সামনে বসি কুরআন পড়তে পারি। আসলে, মানুষের ওপর যত বিপদাপদই আসুক না কেন সেটাকে যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত হিসেবে চিন্তা করা যায় তাহলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে অসম্ভব অনেক কাজই করা যায়। কেননা আল্লাহর জন্য অসম্ভব বলে কোনো কিছু নেই। অনেকটা আমার কুরআন তিলাওয়াত করার মতো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ পোড়াবাগান থেকেও আঙুর খাওয়াতে পারেন। আবার তোমার দু:খ-বেদনাকেও আনন্দে পরিণত করে দিতে পারেন"। অন্ধ বৃদ্ধের কথা শুনে শেখ সিজদায় পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে লাগলো। বলতে লাগলো: দৃষ্টি থাকতেও যারা কুরআন পড়ছে না তাদের জন্য দু:খ হয়।
পার্সটুডে/এনএম/২০/৮৪

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ