গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রাচীন একটি ইরানি প্রবাদ: ক্ষতস্থানে হাড্ডি
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন।
আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: ক্ষতস্থানে হাড্ডি রেখেছে। গল্পটি এরকম: প্রাচীনকালে এক কসাই ছিল। চাপাতি দিয়ে মাংস কাটার সময় হাতে আঘাত পেলো সে। হাত থেকে তার রক্ত প্রবাহিত হতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে প্রতিবেশিরা জড়ো হলো এবং কসাইয়ের হাত থেকে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে কাপড় দিয়ে তার হাত পেঁচিয়ে দিলো। তারপর তাকে নিয়ে গেল ওই শহরের চিকিৎসকের কাছে।
হেকিমের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর হেকিম রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে ওষুধ দিলো। হেকিম যখন কসাইয়ের জখম হওয়া হাত বাঁধতে গেল বুঝতে পারলো যে ওই জখমের স্থানে এক টুকরো ছোট্ট হাড্ডি আছে। সুতরাং হেকিম ওই হাড্ডির টুকরো বের করে এনে তারপর জখমের জায়গাটা বাঁধতে চাইলো। কিন্তু কী মনে করে আবার হেকিম ওই হাড্ডির টুকরোটি জখমের জায়গায় রেখেই পট্টি বেঁধে দিলো। ব্যান্ডেজ করার পর হেকিম কসাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো: তোমার জখম কিন্তু অনেক গভীর। একদিন পরপর আমার কাছে এসো, ব্যান্ডেজ করে দেবো। তারপর থেকে কসাই নিয়মিত হেকিমের কাছে একদিন পরপর যেতে লাগলো। একটু মাংস আর কিছু টাকা নিয়ে যেত হেকিমকে দেওয়ার জন্য। হেকিমও নিয়মিত তার হাতের জখমে ব্যান্ডেজ করে দিতো। এভাবে কেটে গেল কিছুদিন। কিন্তু কসাইর হাতের কোনো উন্নতিই হলো না। এরইমাঝে একদিন হেকিম অপর এক রোগীর চিকিৎসার জন্য শহরের বাইরে সফরে যেতে বাধ্য হলো। ওই সফরে তার কয়েকদিন লেগে গেল। এই ফাঁকে হেকিমের ছেলে বাবার পরিবর্তে রোগী দেখতে লাগলো। বাবার চিকিৎসা দেখে দেখে সেও কিছুটা শিখেছিল। সেই বিদ্যা দিয়ে সাধারণ রোগীদের সেবা দিতে লাগলো ছেলে। তো কসাই নিত্যদিনের মতো সেদিনও হেকিমের জন্য কিছু মাংস আর টাকা নিয়ে গেল।
হেকিমের ছেলে বাবার মতোই কসাইয়ের ব্যান্ডেজ খুলে ক্ষতস্থানটাকে জীবাণুমুক্ত করলো। হঠাৎ সে দেখতে পেলো ছোট্ট একটু হাড্ডি জখমের স্থানে পড়ে আছে। খুব সতর্কতার সঙ্গে সে হাড্ডিটাকে বের করে এনে তারপর ব্যান্ডেজ করে দিলো। তার পরের দিন কসাই যখন হেকিমের ছেলের সঙ্গে দেখা করতে এলো বেশ হাসিখুশি মনে হলো তাকে। হেকিমের ছেলেকে বললো: অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি তো তোমার বাবার চেয়েও ভালো চিকিৎসা করো। এই দুই দিনে আমার হাত মোটামুটি ভালো হয়ে গেছে। হেকিমের ছেলে আরও একবার কসাইয়ের জখমের স্থানটা জীবাণুমুক্ত করলো এবং ব্যান্ডেজ করে দিলো।
হেকিমের ছেলে আরও একবার কসাইয়ের জখমের স্থানটা জীবাণুমুক্ত করলো এবং ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললো: ইনশাআল্লাহ দু'একদিনের মধ্যেই তোমার হাতের জখম ভালো হয়ে যাবে। আশা করি আমার কাছে আর আসতে হবে না তোমার। এরইমাঝে হেকিমের সফর শেষ হয়ে এলো এবং একরাতে সফরের ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। হেকিমের স্ত্রী খাবারের আয়োজন করলো। কিন্তু যেখানে সবসময় মাংস দিয়ে খাওয়া হতো সেখানে স্ত্রী লাউ-বেগুনের তরকারি দিলো, তাও আবার মাংস ছাড়া রান্না করা। হেকিম জামার হাতা গুটিয়ে একটা চামুচ নিলো এবং তার প্লেটের খাবার উল্টেপাল্টে দেখলো। কিন্তু কোনোভাবেই এক টুকরো মাংসও খুঁজে পেলো না।
হেকিম এবার তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো: বৌ! খাবারে মাংস নেই কেন? স্ত্রী বললো: তুমি ছিলে না তো! মাংস আসবে কোত্থেকে? ছেলেও ছিল মহা ব্যস্ত। সময়ই তো করতে পারে নি যে কসাইর দোকানে যাবে মাংস কিনতে। হেকিম ছেলের দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো: মাংস কিনতে যাবে? কেন? কসাই তার হাতের জখমের ব্যান্ডেজ করার জন্য তোমার কাছে আসে না? ছেলে বললো: হ্যাঁ বাবা! আসে তো। আমি তার ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ খুলে আবার বেঁধে দিয়েছি। ওর জখমে দেখলাম এক টুকরো হাড্ডি।
ওই হাড্ডিটা বের করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো আমি খুব ভালো করে জীবাণুমুক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছি বাবা। আজ তো আর ব্যান্ডেজ করতে এলো না। মনে হচ্ছে ওর হাতের ক্ষতটা ভালো হয়ে গেছে। হেকিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার হাতের ওপর থাপ্পড় মেরে বললো: ওর জখমের স্থান থেকে হাড্ডির টুকরোটা বের করে ফেলেছো? তাই বলি! কেন আজকের রাতের খাবারে মাংস নেই। ছেলে বললো: বুঝতে পারছি না বাবা! তার মানে কি জখমের স্থানে যে হাড্ডিটা পড়ে ছিল সেটা বের করে আনা উচিত ছিল না? কিন্তু ওই হাড্ডিটা বের না করলে তো জখমটা ভালো হতো না।
হেকিম এবার ছেলেকে বললো: আমিও তার আঘাতের স্থানে হাড্ডির টুকরোটা দেখেছি। কিন্তু বের করি নি, রেখে দিয়েছি। যাতে এতো দ্রুত ওর জখম ভালো না হয়। যার ফলে ওই কসাই তার আহত হাত নিয়ে ব্যান্ডেজ করতে সবসময় আমাদের কাছে আসতো আর আসার সময় আমাদের জন্য মাংস এবং টাকা নিয়ে আসতো। কিন্তু সেই সুযোগটা তো আর রইলো না। কাল থেকে আমাদেরই কসাইর কাছে গিয়ে তাকে টাকা দিতে হবে। সেদিন থেকে যারা কারও উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিংবা স্থায়ী সমস্যা তৈরি করে তাদের সম্পর্কে বলা হয়: ক্ষতস্থানে হাড্ডি রেখেছে।
পার্সটুডে/এনএম/২৩/৮৭
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ