গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রবাদ: মুখের আঘাত তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও খারাপ
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: মুখের আঘাত তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও খারাপ। এই প্রবাদটি এসেছে এক শিকারীর কাহিনী থেকে। কাহিনীটা এরকম:
এক শিকারী তার বন্দুক হাতে নিয়ে শিকারের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করছিলো। মোটামুটি দুটি খরগোশ সেদিন সে শিকার করে। সেজন্য তার মন চাচ্ছিলো না দ্রুত ঘরে ফিরে যেতে। ভাবলো এদিক ওদিক আরেকটু ঘুরেফিরে দেখা যাক না, যদি মেষ জাতীয় একটু নাদুস নুদুস এবং মাংসবহুল কোনো শিকার পাওয়া যায়-মন্দ কী!
শিকারী তাই পা টিপে টিপে জঙ্গলে, প্রান্তরে সন্তর্পনে শিকারের সন্ধান করছিলো। হঠাৎ করে তার নজর পড়লো একটি সিংহের ওপর। ভয়ে তার পায়ে যেন পেরেক ঠুকলো মানে একেবারে নড়াচড়া বন্ধ গেল। বন্দুকও পড়ে গেল হাত থেকে। সিংহ দুই পা সামনে এসে বললো: ভয় পেয়ো না হে শিকারী। আমি তোমাকে শিকার করতে আসি নি। এসেছি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে। প্রস্তাবটি হলো আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। কিন্তু কেন একটি সিংহ একজন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়?
কারণ সিংহ বললো: তার একটি সন্তান আছে। অসুস্থ সে। বনের প্রবীণ প্রাণীরা তাকে পরামর্শ দিয়েছে তার সন্তানকে পাখির মাংস খাওয়াতে। তাহলেই নাকি সুস্থ হয়ে যাবে। এখন সিংহের তো বিশাল দেহ। বনের বিচিত্র প্রাণী সে শিকার করতে পারে নিমেষেই। কিন্তু অত বড় দেহ নিয়ে কী করে সে ছোট্ট পাখি শিকার করবে। পাখি তো একটু বাতাস টের পেলেই উড়ে চলে যায়। সুতরাং সিংহ শিকারীকে বললো: তুমি একদিন একটা পাখি শিকার করে আমাকে এনে দাও। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তুমি যত খুশি নির্ভয়ে শিকার করে বেড়াও, আমি কখনোই তোমাকে আক্রমণ করবো না।
শিকারী কেবল সিংহের আক্রমণ থেকে কী করে বাঁচা যায়-সেই চিন্তাই করছিলো। তাই সিংহের প্রস্তাব শুনে মনে মনে বললো: এই খুঁটি থেকে ওই খুঁটি পর্যন্ত যেতে পারলেই বিপদ কেটে গিয়ে পালাবার পথ সুগম হবে। কাজেই এগিয়ে যাও! এই মুহূর্তে আমাকে যেতে দিলেই হলো, হামলা না করলেই হলো। মানত করছি যদি বেঁচে যাই তাহলে শিকার করা খরগোশ দুটো গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দেবো। এইরকম ভেবেচিন্তে শিকারী সিংহকে বললো: ঠিক আছে। আমরা বন্ধুত্বই করবো। কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে সিংহ সত্যি সত্যিই তাকে আক্রমণ করবে না। তাই বন্দুকটা হাতে তুলে নিয়ে দৌড়ে পালায়। এমন জোরে দৌড় যে পারলে যেন আরও চারটি পা কারও কাছ থেকে হাওলাত করে।
এই ঘটনার পরদিন থেকে লোকজন দেখতে পেলো শিকারী প্রতিদিনই কোনো না কোনো জালে আটকা পড়া পাখি নিয়ে বনের দিকে যায়। মানুষজন ওর রহস্য জানতে পেরে তাকে সিংহের বন্ধু উপাধি দেয়। সিংহ এবং শিকারীর মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সিংহ প্রতিদিন শিকারীর কাছ থেকে একটি করে পাখি নিয়ে গিয়ে তার সন্তানকে খেতে দেয়। তারা পরস্পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প-গুজব করে। তারপর যে যার জীবন জীবিকার সন্ধানে বের হয়ে যায়। একদিন শিকারী তার বন্ধু সিংহের সঙ্গে খাবার খেতে চাইলো। তাই সে প্রতিদিনের মতো কেবল একটি পাখি না নিয়ে কিছু মাংসও কিনে নিয়ে গেল সিংহের জন্য। জঙ্গলের ভেতর আগুন জ্বালালো এবং তার নিজের জন্য কাবাব বানালো। পাকানো মাংস থেকে কিছুটা মাংস দিলো সিংহকে। সিংহ অন্যান্য সিংহের মতোই পুরো মাংস একবারে মুখে দিলো। খাবার সময় তার ঠোঁট মুখ দিয়ে ঝোল ঝরতে লাগলো।
শিকারী সিংহের খাবারের এই অবস্থা দেখে বললো: তুমি এভাবে খাচ্ছো কেন? সুন্দর করে খেতে পারো না? আস্তে আস্তে খাও! মুখ দিয়ে যাতে পানি ঝরে না পড়ে। অন্যান্য সিংহের মতো তুমিও কি অভদ্র হয়ে গেছো? সিংহ শিকারীর কথা শুনে মুখে দেওয়া অর্ধ-খাওয়া মাংস ছুঁড়ে মারলো শিকারীর সামনে। তারপর শিকারীকে বললো: তোমার বন্দুক হাতে নাও! বাঁট দিয়ে আমার মাথায় জোরে বাড়ি মারো! শিকারী বললো: কেন? আমরা না পরস্পরের বন্ধু? সিংহ বললো: বন্ধুত্ব এখন থেকে আর নাই। তুমি হয় বাঁট দিয়ে আমার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করো এবং ছয় মাস পর ফিরে আসো! না হয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও!
শিকারী বেচারা কী আর করবে। উঠে দাঁড়ালো এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে সিংহের কথামতো ভীষণ আঘাত করলো তার মাথায়। সিংহের মাথা ফেটে গেল এবং রক্ত বেরিয়ে গড়াতে লাগলো। শিকারী সিংহের মাথা থেকে রক্তক্ষরণ দেখে ভীষণ কষ্ট পেলো এবং ভয়ও পেলো। সে দ্রুত বন থেকে বেরিয়ে গেলে এবং আর সেখানে পা রাখলো না। এরপর বেশ কিছুদিন, সপ্তাহ, মাস কেটে গেল। শিকারী চেষ্টা করলো সিংহের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের কথা ভুলে যেতে। কিন্তু ছয় মাস পর মনে হলো সিংহের জন্য বরং তার মন কাঁদছে। সুতরাং বন্দুকটা আবার কাঁধে নিয়ে জঙ্গেলের দিকে গেলে এবং সিংহের দেখা পেল। আস্তে আস্তে পা ফেলে শিকারী সিংহের কাছে গেল। শিকারী জানতো না কেন সে তাকে ছয় মাস যেতে বলেছিলো। সেজন্য জানতো না এখনও কি সিংহের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব আছে নাকি নেই।
সিংহ শিকারীকে দেখে সামনে এগিয়ে গেল এবং বললো: আমার মাথায় দেখো তো গভীর সেই ক্ষতচিহ্ন এখনও আছে কিনা? শিকারী ভালোভাবে দেখে বললো: না, আলহামদু লিল্লাহ! জখম ভালো হয়ে গেছে। সিংহ বললো: হ্যাঁ! ওই গভীর ক্ষতটা ভালো হয়ে গেছে কিন্তু মুখের কথার জখমটা এখনও ভালো হয় নি। তোমাওপর আক্রমণ করার আগেভাগে এখান থেকে পালাও এবং আর কখনও এখানে পা রাখবে না। শিকারী যে-ই যে গেল আর জঙ্গলে গেল না। সেই থেকে কেউ যখন কাউকে বলতে চায় যে তোমার রুক্ষ ভাষা কিংবা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা বন্ধ করো, কেননা ওই ভাষা তরবারির আঘাতের চেয়েও দু:সহ, তখন এই প্রবচনটি বলতে শুরু করে: মুখের ভাষা তলোয়ারের আঘাতের চেয়েও খারাপ।
পার্সটুডে/এনএম/২৭/৮৮
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ