গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রাচীন ইরানি প্রবাদ: চোর হলেও সাহসী হও
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: চোর হও তো সাহসী হও! গল্পটি এমন:
পুরানো দিনের কথা। সে সময় কোন হোটেল কিংবা মুসাফিরখানার অস্তিত্ব ছিল না। তবে সরাইখানা ছিল। বাণিজ্যিক কাফেলা পথ চলতে চলতে যেখানে রাত ঘনিয়ে আসতো সেখানে তারা রাতটা ওই সরাইখানায় বিশ্রাম নিতো। সকালে আবার তাদের পথযাত্রা শুরু করতো।
এরকম একটি সরাইখানা দেখতে সামরিক দুর্গের মতো ছিল। এরকম বলার কারণ হলো সরাইখানাটির চারদিকে উঁচু উঁচু প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। সরাইখানার মূল দরজাটি ছিল স্টিলের তৈরি। কোনো চোরের পক্ষে ওই দরোজা ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। যেই কাফেলাই ওই সরাইখানার পাশ দিয়ে যেত,, তারা সেখানে যাত্রাবিরতি করতো এবং বণিকরা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতো। তারা নিশ্চিত থাকতো যে সেখানে কোনো চোর বা ডাকাত ঢুকতে পারবে না। কিন্তু এই নিশ্চিত থাকার বিষয়টি অবশেষে ক্ষুণ্ন হলো।
সরাইখানার ওই রুপকথার মতো কাহিনী কয়েক চোরের ভালো লাগলো না। তারা তিনজন একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো এই রুপকথার গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটাবে। যে করেই হোক দূর্গের মতো ওই সরাইখানায় কোনো এক রাতে তারা চুরি করবে। যাতে কেউ আর বলতে না পারে যে এই সরাইখানা চোরের হাত থেকে পুরোপুরি নিরাপদ। চোরেরা এ নিয়ে ব্যাপক ফন্দি-ফিকির করলো। শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলো সরাইখানার পেছন দিক দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা টানেল তৈরি করবে। একেবারে সরাইখানার বিশাল উঁচু এবং মজবুত দেয়ালের নীচ দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। ব্যস্ শুরু হয়ে গেল কাজ। খন্তি-শাবল-বেলচা দিয়ে টানেল খননের কাজ করলো দীর্ঘ দিন ধরে। অবশেষে তারা সফল হলো দেয়ালের নীচ দিয়ে সৃড়ঙ্গ করে একেবারে পানির কূপের মাঝখান দিয়ে ওঠার পথ তৈরি করতে।
পরে একদিন অন্ধকার রাতে ওই সুড়ঙ্গ পথে চোরেরা সরাইখানায় ঢুকে পড়লো। তারা কোনোরকম হৈ চৈ না করে একেবারে শান্তভাবে মুসাফির এবং ব্যবসায়ীদের মালামাল লুট করে সুড়ঙ্গ পথেই আবার চলে গেল। সেইরাত পোহাতে না পোহাতেই সরাইখানায় চুরির খবর চাউর হয়ে গেল। ফুটবলের মতো গড়াতে গড়াতে চুরির খবর চলে গেল শাসকের কানে। শাসক ঘোড়ায় চড়ে সরাইখানায় গিয়ে হাজির হলো। তার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না যে কোনো চোর সরাইখানার এতো উঁচু এবং মজবুত দেয়াল কিংবা স্টিলের দরোজা ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারে। শাসকের পাইক-পেয়াদারা ভালো করে সবদিক দেখলো। কিন্তু চোরের পায়ের চিহ্ন কিংবা কোনোরকম সিঁদ কাটার লক্ষণ দেখতে পেলো না।
চোরের কোনো লক্ষণ দেখতে না পেয়ে শাসক ভাবলো: তাহলে সরাইখানার কর্মচারীদের কেউ একাজ করে থাকতে পারে। সরাইখানার ভেতরে শোরগোল শুরু হয়ে গেল। সরাইখানার দারোয়ানদের পেটানোর আদেশ হলো যাতে তারা চোরদের সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করে। এদিকে চোরেরা চুরির মালামাল নিরাপদ জায়গায় রেখে সরাইখানায় এলো হাল-অবস্থা দেখার জন্য। এসে দেখলো বেচারা দারোয়ানরা মার খেয়ে গগনবিদারী চীৎকার দিচ্ছে। এ অবস্থা দেখে চোরের সর্দার খুব কষ্ট পেলো। মনে মনে বললো বেচারারা অপরাধ না করেও শাস্তি পাচ্ছে-আল্লাহ এটা সহ্য করবে না। সে একটু এগিয়ে গিয়ে চীৎকার করে বললো: ওদেরকে মেরো না! সবার দৃষ্টি গেল চোরের সর্দারের দিকে।
সর্দার একটু এগিয়ে গিয়ে বললো: ওদেরকে ছেড়ে দাও! ওরা নিরপরাধ। সরাইখানায় আমি চুরি করেছি। শাসক তার দিকে তাকিয়ে বললো: তুই চুরি করেছিস? কীভাবে? চোরের সর্দার সব ঘটনা খুলে বললো। শাসক জিজ্ঞেস করলো: মুসাফিরদের মালামাল কোথায়? যদি সত্যি বলে থাকিস তাহলে মালামাল রাখার জায়গা দেখিয়ে দে। চোর বললো: এই কূপের গভীরে। কেউ একজন গিয়ে দেখে আসতে পারে। কিন্তু কেউই যেতে রাজি হলো না।
অবশেষে চোরের সর্দারের পরামর্শে তার কোমরে একটা রশি বেঁধে দেওয়া হলো এবং সে নিজেই কূপের গভীরে গেল। কূপে ডুব দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁজে পেয়ে চোর রশির মাথায় বিরাট একটা পাথর বেঁধে দিয়ে পালিয়ে গেল। তার সহযোগীরাও ধীরে ধীরে সরাইখানার গেইট পেরিয়ে চলে গেল।
মুসাফিরের দল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু কূপের ভেতর থেকে চোরের বের হয়ে আসার কোনো লক্ষণই দেখা গেল না। সবাই মিলে পরে কাঁপতে কূপের ভেতরে গেল। গভীরে যেতেই সে সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান পেলো এবং ওই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে সে বেরিয়ে গেল দেয়ালের বাইরে। তখনও শাসক এবং মুসাফিররা কূপের চারপাশে অপেক্ষা করছিল-কী হয় দেখার জন্য। এমন সময় ওই পেয়াদা চীৎকার করতে করতে সরাইখানার মূল গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তাকে দেখে সবাই বুঝতে পারলো যে চোর মিথ্যা বলে নি, এই কূপের তলদেশ দিয়ে বাইরে যাবার পথ রয়েছে। সুতরাং নিরীহ দারোয়ানদের শেকল খুলে দেওয়া হলো। শাসক এবার পায়চারী করতে করতে আপন মনে কী যেন ভাবছিল। এমন সময় একজন মুসাফির যার কিছু মাল চুরি হয়েছিল চীৎকার করে বললো:
আমি আমার চুরি যাওয়া মালামাল ওই চোরকে দান করে দিলাম, হালাল করে দিলাম তার জন্য। সে ভোগ করুক নিশ্চিন্তে। কেননা চোরটা যথেষ্ট স্মার্ট এবং বুদ্ধিমান ছিল। এতো কঠোর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সে সরাইখানায় ঢোকার পথ তৈরি করেছে, সত্যিই মেধাবি চোর। তবে তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার বীরত্ব এবং নির্ভীক মন। সে নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে নিরীহ দারোয়ানদেরকে শাস্তি থেকে বাঁচিয়েছে। চুরি মোটেই ভালো কাজ না, খুবই খারাপ কাজ। তবে কেউ যদি খারাপ কাজ করে ওই চোরের মতো যেন বীরত্বপূর্ণ, সাহসী পুরুষ হয়। সেদিন থেকে কেউ যদি খারাপ কোনো কাজ করে এবং একইসঙ্গে সাহসী কাজ করে, তার সম্পর্কে বলা হয়: চোর হও এবং সাহসী হও!
পার্সটুডে/এনএম/২৮/৮৯
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ