আগস্ট ২৯, ২০২৩ ১৪:৩৬ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো প্রাচীন একটি  গল্প। গল্পটি এরকম: 

প্রাচীনকালে এক লোক ছিল বেশ দ্বীনদার এবং পরহেজগার। দিনরাত সে কেবল স্রষ্টার ইবাদাত আর সৃষ্টির সেবা করে বেড়াতো। সদা হাস্যোজ্জ্বল, আনন্দময় চেহারায় সে শহরময় ঘুরে বেড়াতো। যখনই কোনো গরীব বা বঞ্চিত কাউকে হাত পাততে দেখতো তার সাহায্য সহযোগিতায় এগিয়ে যেতো। 

এই পরহেজগার লোকটিকে সবাই মোটামুটি ভালোই বাসতো। একদিন এই পরহেজগার লোক একটা সোনার ইট খুঁজে পেল। বেশ বড়োসড়ো সেই সোনার ইট পেয়ে তার হুশজ্ঞান একটু অস্থির হয়ে গেল। কী করবে না করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। পরহেজগার লোকটি যদিও জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছে ইবাদাত বন্দেগিতে তারপরও সোনার ইট পেয়ে খেঁই হারিয়ে ফেললো। নিজেকে যেন সোনার ইটের দাস বানিয়ে ফেললো সে। এমন দাসই হয়ে গেল এই পরহেজগার যে লোভ-লালসায় নিজের পুরোণো দিনের ইবাদাতের কথাই ভুলে গেল। পরহেজগারী বলতে তার মাঝে আর কিছুই অবশিষ্ট রইলো না।

আগে যেখানে রাত কাটাতো ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে সেখানে সোনার ইট পেয়ে এখন পরহেজগার লোকটির রাত কাটে শুধু সোনালি ভবিষ্যত চিন্তায়। কী করবে, কীভাবে করবে-এইসব চিন্তায় তার ইবাদাতের কথা আর মনে পড়ে না। দিনের বেলাতেও ওই একইরকম চিন্তায় কেটে যায় তার সময়।মনে মনে বলতে লাগলো: এখন থেকে জাঁকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করবো। নিজের জন্য একটা রাজকীয় প্রাসাদ হবে। আমার প্রাসাদটি হবে সবচেয়ে বড় এবং সকল প্রাসাদের চেয়ে উঁচু। এখন এই সোনার ইট থেকে একটু একটু করে যতই খরচ করি না কেন শেষ হবে না। আমার জীবনের ছোট বড় সকল ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাই মেটানো যাবে এই সোনার টুকরো ইট দিয়ে।

প্রাসাদে নিজের জন্য একটা বিশেষ কক্ষ বানাবো। সেখানে চাকর চাকরাণীরা চারপাশে ঘুরঘুর করবে। আমি সোনার পালঙ্কে হেলান দিয়ে বসবো আর সোনার মুদ্রা গুণবো। জীবনের এতোটা বছর অভাবে অনাহারে দু:খ-কষ্টে কাটিয়েছি। এখন একটু শুয়ে বসে আরাম আয়েশে কাটাবো। এখন থেকে অন্যরা আমার জন্য কাজ করবে। আমার আর কোনোরকম কাজ করার দরকার নেই। সোনার ইট আছে আমার কাছে। সুতরাং হাসি-খুশি আরাম আয়েশে, ঘোড়ায় চড়ে কাটিয়ে দেবো বাকি জীবন।

ওই ইট পেয়ে সে এতো বেশি পার্থিব জগতের সুখ শান্তির চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল যে শয়তান তার অন্তরে বাসা বেঁধে বসলো। এই নেককার লোকটা তাই ধীরে ধীরে নির্বোধ ও মূর্খ হয়ে ওঠে। ভালো ও কল্যাণময় কাজের কথা একেবারে ভুলেই গেল। পরহেজগারী আর তাকওয়া তার ভেতরে মরে গেল। স্রষ্টার ইবাদাত আর সৃষ্টির সেবাও বাদ দিলো। কেবল দুনিয়াবি স্বার্থচিন্তা আর ঐশ্বর্য ভাবনায় কাটতে থাকলো তার দিন। পরহেজগারীর সময় সে তার সকল প্রয়োজনের কথা আল্লাহর কাছে বলতো। এখন সেসব ভুলে বসে আছে। মোটকথা ইমান এবং মানবিকতা তার অস্তিত্বে জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সোনার ইট পেয়ে সে এতোই খুশি হয়ে উঠলো যে তার চিন্তার জগতে ঝড় উঠে গেল, কোনোরকম স্থিরতা তার মধ্যে আর দেখা গেল না।
সারাক্ষণই নতুন নতুন চিন্তা তার মাথায় বাসা বাঁধতে লাগলো আর বিড়বিড় করে আনমনে কথা বলতে লাগলো। রাতের বেলা অস্বস্তিতে ঘুমাতো আর ঘুম হলেও দু:স্বপ্ন দেখতো। অস্থিরতায় তার মনের শান্তি দূর হয়ে গেল। স্বস্তি ও আরাম-আয়েশ যেন তার ঘর থেকে পালিয়ে গেল। অবশেষে একদিন সে তার ঘর থেকে বাইরে এলো এবং মরুভূমির দিকে পাড়ি জমালো। যখনই একটু ভালো লাগতো মরুভূমিতে হাঁটতো। হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করতো যে পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর। পৃথিবীর বুকে যত সৃষ্টি আছে সবাই সুখে ও আনন্দে বসবাস করছে। এভাবে ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার সামনে পড়লো একটি কবরস্থান।

ধার্মিক লোকটি এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে গেল। পাশেই একটি লোক কাদা-মাটি দিয়ে ইট তৈরি করছিলো। পরহেজগার লোকটি তার দিকে তাকালো এবং কী যেন ভেবে চীৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিলো। ওই দৃশ্য দেখে হঠাৎেউদাসীনতা বা গাফলতির ধূসর পর্দা যেন তার চোখের সামনে থেকে সরে গেল। লজ্জা-কাতরতার ঘাম তার কপালে জমে উঠলো। পরহেজগার লোকটি তার মাথা অবনত করে ফেললো। মুহূর্তেই তার কামনা বাসনার রাজ্যে যে লোভ-লালসার পার্থিব আয়না জেঁকে বসেছিল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কবরের জন্য ইট তৈরির কাজে ব্যস্ত শ্রমিককে দেখে সে মানব জীবনের পরিণতি সম্পর্কে সম্বিৎ ফিরে পেলো। বুঝতে পারলো তার ভুল। আপনমনে বললো: 

আমি এখনও আমার সোনার ইট ভাঙানোই শুরু করলাম না, কিছুই খরচ করলাম না। অথচ কীসব আজব স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেলাম। উদাসীনতার মেঘ আমার হৃদয়কে ঢেকে দিলো। ছি ছি! আমি তো সেইসব হাস্যকর স্বপ্ন পূরণ করে পার্থিব ঐশ্বর্যের ভেতর নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছিলাম। আহা! আমাদের সবার পরিণতিই তো ওই কয়েক মুষ্টি মাটি ছাড়া আর কিছু নয়। অবশেষে ধার্মিক লোকটি তওবা করলো, ভীষণ অনুতপ্ত হলো। এরপর তার যা কিছু সম্পদ ছিল সবই আল্লাহর পথে ব্যয় করলো।

পার্সটুডে/এনএম/২৯/৯০
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ