সেপ্টেম্বর ০২, ২০২৩ ১৪:৩৬ Asia/Dhaka

পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা সংক্রান্ত গত পর্বের আলোচনায় আমরা চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প ও চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' বাস্তবায়নে বিরাজমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে আমরা পাকিস্তানের গোয়াদর ও ইরানের চবাহার বন্দরে ভারত ও চীনের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়েও কথা বলেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ ক্ষেত্রে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে কথা বলবো।

পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে চীনের প্রভাব এবং এর কাছেই ইরানের চবাহার বন্দরেও চীনের প্রভাব বিস্তারে ভারত আতঙ্কিত। এ কারণে পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগর এলাকায় ভারত ও চীনের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশে সহযোগিতামূলক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইরানের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের গোয়াদর ও ইরানের চবাহার সমুদ্রবন্দর প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নয় বরং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা ভূমিকা রাখবে এবং এতে সকলের অংশগ্রহণ জরুরি। এ কারণে ইরান চবাহার বন্দরে অন্য দেশের পুঁজি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে। ভূ-কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কারণে উত্তরের কাস্পিয়ান সাগর ও দক্ষিণের পারস্য উপসাগরের জ্বালানি সংগ্রহ ও বহি:র্বিশ্বে তা সরবরাহের বিরাট সুবিধা ইরানের হাতে রয়েছে। এ ছাড়া, কৌশলগত অবস্থানের কারণে ইরান এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ মধ্যএশিয়া, দক্ষিণএশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের সেতুবন্ধন হচ্ছে ইরান।

ভৌগোলিক দিক থেকে ইরানের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে চীনসহ আরো বহু দেশ বাণিজ্য, অর্থনৈতিক ও ট্রানজিট সুবিধা পেতে সবার নজর এখন ইরানের দিকে। এ কারণে চীন ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি করেছে। অন্যদিকে চীন পাকিস্তানের সাথেও অর্থনৈতিক করিডোর 'সিপিইসি' পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ায় ব্যাপক জ্বালানির চাহিদা দেখা দেবে। এ ক্ষেত্রে ইরানের জ্বালানি তাদের জন্য সহজলভ্য। চীন আগামী ২৫ বছরে ইরানের জ্বালানি খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিয়েছে।

জ্বালানির পাশাপাশি ট্রানজিটের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তাদের মতে, ইরানে চীনের বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ তেহরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের নিষেধাজ্ঞাকে সম্পূর্ণ অকার্যকর করে দেবে। দুই দেশের সহযোগিতা খনিজ জ্বালানির ক্ষেত্র চিহ্নিত করা ও উত্তোলন থেকে শুরু করে রপ্তানির সুযোগ করে দেবে। এতে করে ইরানকে পাশ্চাত্যের কোম্পানির মিথ্যা আশ্বাসের ওপর আর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না।  

বিশেষজ্ঞরা আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারের এই প্রক্রিয়াকে নিষেধাজ্ঞা কবলিত ইরানের জন্য অনেক বড় একটি সুযোগ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, ইরান, চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার সমগ্র এই অঞ্চলের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখবে। চীন মনে করে ইরান ও পাকিস্তানের সাথে তাদের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। তাদের মতে, একদিকে পাকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক করিডরে আফগানিস্তানকেও শামিল করতে পারলে অন্যদিকে ইরান-চীন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রাখবে এবং দ্বিতীয়ত সমগ্র এই অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা স্তিমিত হয়ে আসবে। এ ছাড়া, এই চারটি দেশের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তার দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরান ও চীনের সহযোগিতা চুক্তি সমগ্র এই অঞ্চলের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে কারণ ইরান ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। ইরান-চীনের এই সহযোগিতার কারণে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়বে। 

অন্যদিকে 'চীনা ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ' এর বিশেষজ্ঞরা তাদের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, তেহরান-বেইজিং কৌশলগত সমঝোতা ইরান থেকে চীন পর্যন্ত তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপনে ভূমিকা রাখবে যা কিনা পাকিস্তানসহ এই তিন দেশের জন্যই লাভজনক।

রুশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দ্রে কোরিভকো পাকিস্তানের দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে দেয়া সাক্ষাতকারে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 'ইরানের সাথে তুরস্ক ও আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হলে ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক ও আজারবাইজানকে নিয়ে নতুন ব্লকের আবির্ভাব ঘটবে যা কিনা চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডর এবং চীন-ইরানের ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে'।

চীনে ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হোসেন মালায়েক ইরান ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়নকে শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক ফলাফল হিসেবে দেখেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যে এই ইস্যুটি এই অঞ্চলসহ সারা বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে, আর এ কারণে আমাদের শত্রুরও অভাব নেই। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল ফজল আলী ইরান-চীন ২৫ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, একবিংশ শতাব্দী হবে এশিয়ার শতাব্দী এবং আগামী দুই দশকে পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ায় আমরা আমূল পরিবর্তন ও বহু ঘটনাবলী দেখতে পাব। তুরস্কের গবেষক এজগি উযুন চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' এবং চীন-ইরান সহযোগিতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার সাথে এর তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ইউরোপ ও আমেরিকার মতো চীন অন্য কোনো দেশে তাদের রাজনৈতিক কোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। চীন তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি সবার জন্য সমান স্বার্থ রক্ষার নীতিতে বিশ্বাসী। তাই দেখা যায় তারা অন্য দেশের সাথে যেসব চুক্তি করে তাতে যৌথ পুঁজি বিনিয়োগ ও ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়'।

যাইহোক,  ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের বিরুদ্ধে অনেক বড় হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। তাদের মতে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরানের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ইরান জ্বালানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস হওয়ায় সবার নজর এখন ইরানের দিকে। এ ছাড়া, ভৌগোলিক দিক দিয়েও ইরানের কৌশলগত অবস্থান এ দেশটির গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে ইরান তার সুযোগকে কিভাবে কাজে লাগায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ