সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২৩ ২০:৪২ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জার নাম শুনেছ। তার পূর্ণ নাম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ আল খায়ি। মধ্যযুগে আনুমানিক ত্রয়োদশ শতকে তিনি তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন।

সেলজুক শাসনামলে ইরানের বৃহত্তর খোরাসানে বসবাস করতেন। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য-এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ নাসিরউদ্দিনকে তাদের দেশের লোক বলে দাবি করে। উজবেকিস্তান, আজারবাইজান আর আফগানিস্তান হোজ্জাকে তাদের লোক বলে দাবি করলেও কেবল তুরস্কের আকসেইর শহরেই প্রতিবছর জুলাই মাসের ৫ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নাসিরউদ্দিন হোজ্জা উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

মোল্লা নাসিরউদ্দিন হোজ্জা ছিলেন একজন বেঁটে মানুষ। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে জোব্বা পরে একটা গাধার ওপর চড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। হোজ্জাকে নিয়ে এক হাজারেরও বেশি গল্প চালু আছে। কোনো গল্পে তাকে খুব বুদ্ধিমান একজন মানুষ মনে হয়। আবার কোনো গল্পে তার আচরণ একেবারেই বোকার মতো হয়। তবে তিনি সারাবিশ্বে পরিচিতি পেয়েছেন তার রসবোধের কারণে। তার কথাবার্তা আমাদের যেমন হাসায়, তেমনি ভাবায়ও বটে।

যাই হোক, রংধনু আসরের এ পর্বে বিখ্যাত সেই মানুষটির কয়েকটি মজার ঘটনা তোমাদের শোনাব। আর সবশেষে থাকবে একটি দেশের গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে প্রথমেই গল্পগুলো শোনা যাক।

মোল্লা নাসির উদ্দিন হোজ্জার ভাস্কর্য

১.

তুরস্কের সুলতান বায়েজিদের দরবার। সেখানে নাসির উদ্দীন হোজ্জা নামে এক মজার লোক ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও পণ্ডিত। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধির কথা সবাই জানে।

একবার নাসির উদ্দীন হোজ্জার কিছু অর্থের প্রয়োজন হলো। নিজের কাছে অত টাকা নেই। বন্ধুদের কাছ থেকেও ধার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। নিরুপায় হোজ্জা আল্লাহ্র ওপর ভরসা করলেন।

ফজর নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করলেন। তারপর জায়নামাযে বসে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুললেন। কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি এ জগতের মালিক। তোমার দরবারে ধন সম্পদের কোন অভাব নেই। আমি আজ অভাবে পড়ে তোমার দরবারে হাত তুলেছি। তুমি আমাকে নয় হাজার নয় শত নিরানব্বই টাকা দান কর। আমি এর চেয়ে এক টাকা কম বা বেশি নেব না। ঠিক নয় হাজার নয় শত নিরানব্বই টাকাই চাই।

নাসির উদ্দীন হোজ্জার প্রতিবেশী ছিল এক ধনী ইহুদি। হাড়কিপটে কৃপণ। সুদের ওপর টাকা খাটিয়ে ধনী হয়েছে। বেচারা হোজ্জা বহুবার বিপদে পড়ে তার কাছে হাত পেতেছে, কিন্তু কখনো একটি টাকা ধার পায়নি।

কাকডাকা ভোরে ইহুদি লোকটি হোজ্জার কান্নাকাটি শুনতে পেল। ইহুদি লোকটি মনে মনে ভাবল, হোজ্জাকে পরীক্ষা করার এই তো সময়। দেরি না করে নিজ ঘর থেকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটি থলে নিয়ে এলো। চুপিচুপি জানালার ফাঁক দিয়ে তা হোজ্জার সামনে ছুঁড়ে মারল।

হোজ্জা খুশিতে আটখানা হয়ে সব মুদ্রাগুলো জড়ো করলেন। গুনে দেখেন পুরোপুরি দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা।

আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, ‘হে অফুরন্ত ধন ভাণ্ডারের মালিক, তোমার করুণা অসীম। আমি চেয়েছিলাম মাত্র নয় হাজার নয়শত নিরানব্বই টাকা, আমাকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছ। আমি সানন্দে তোমার দান গ্রহণ করলাম। তুমি  কত মহান, কত বড় দয়ালু!

জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা ইহুদি নাসির উদ্দীন হোজ্জার মুনাজাত শুনে চমকে উঠল। ভাবল, হোজ্জার মতলব তো দেখছি ভালো নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, স্বর্ণমুদ্রাগুলো নিয়ে নিতে পারলেই প্রাণে বাঁচি।

ইহুদি লোকটি নাসির উদ্দীন হোজ্জার ঘরে গেল। বলল, আমার মস্ত বড় ভুল হয়েছে হোজ্জা সাহেব। স্বর্ণমুদ্রাগুলো তাড়াতাড়ি দিয়ে দিন। আপনাকে পরীক্ষা করার জন্যই আমি জানালা দিয়ে এগুলো ছুড়ে ফেলেছি। দিয়ে দিন তাড়াতাড়ি।

নাসির উদ্দীন হোজ্জা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, কোন্‌ মুদ্রা? কিসের মুদ্রা?

ইহুদি আবার বলল, কেন? কেন, এই মাত্র আমি জানালা দিয়ে আপনার সামনে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা ছুড়ে ফেলেছি।

হোজ্জা রাগত স্বরে বললেন, বাজে বকোনা এখানে। কানা-খোঁড়াকেও ভুলে কোনদিন একটি পয়সা দাওনি, আর আমাকে না চাইতেই দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেবে? যাও যাও, আপন পথ ধর।

ইহুদির মাথায় যেন বজ্রাঘাত পড়ল। সে নিরুপায় হয়ে কাজীর দরবারে নাসির উদ্দীন হোজ্জার বিরুদ্ধে নালিশ করতে চাইল। নিয়ম ছিল কাজীর দরবারে যার বিরুদ্ধে নালিশ করবে তাকেও সাথে যেতে হয়। ইহুদি হোজ্জাকে কাজীর দরবারে যেতে বলল। তিনি বললেন, ‘আমি ময়লা পোশাক পরে কাজীর দরবারে যেতে পারব না। এতে আমার মর্যাদার হানি হবে।’ অগত্যা ইহুদি বাড়ি গিয়ে নিজের জমকালো জরির পোশাকটি নিয়ে এল।

হোজ্জা এবার নতুন বায়না ধরলেন। বললেন, ‘কাল থেকে আমার পা দু’টি ব্যথায় টনটন করছে। অতদূরে আমি হেঁটে যেতে পারব না। ঘোড়া-টোড়া থাকলে না হয় যাওয়া যেত।

ইহুদি তখন নিজের ঘোড়াটি সাজিয়ে নিয়ে এল। বিনয়ের সাথে হোজ্জাকে বলল, ‘আপনার আর কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। দয়া করে এবার চলুন।

নাসির উদ্দীন হোজ্জা জমকালো জরির পোশাকটি পরলেন। মাথায় পাগড়ি বাঁধলেন। এরপর ইহুদির দামি ঘোড়ায় চড়ে কাজীর দরবারে হাজির হলেন।

ইহুদি কাজীর দরবারে হোজ্জার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা দায়ের করল। কাজী সাহেব হোজ্জার বক্তব্য শুনতে চাইলেন।

হোজ্জা বললেন, ‘লোকটি আমার প্রতিবেশী বদ্ধ পাগল। সে কখন, কাকে, কি বলে তার কোন ঠিক নেই। শুধু শুধু কেউ কখনো কাউকে দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দেয়? আপনি দেখবেন, সে হয়ত এক্ষুনি বলে বসবে, আমার পরনের এই দামি জরির পোশাকটিও তার।

ইহুদি চমকে উঠে বলল, কী বললেন? এই পোশাকটি কি আমার নয়? কাজীর দরবারে আসার জন্য কি এটি চেয়ে নেননি?

নাসির উদ্দীন হোজ্জা হা হা করে হেসে উঠলেন। আবার বললেন, দেখলেন হুজুর! পাগল আর কাকে বলে? ঐ যে মাঠে আমার ঘোড়াটি ঘাস খাচ্ছে, হয়ত সে বলে বসবে ওটিও তার।

ইহুদি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘আপনি একি বলছেন, এই ঘোড়াটি কি আমার নয়? কাজীর দরবারে আসার জন্য আমি কি আপনাকে এটি ধার দেইনি?

এসব কথা শুনে কাজী সাহেব ইহুদিকে 'পাগল' বলে রায় দিলেন। প্রহরীকে নির্দেশ দিলেন, তাকে পাগলা গারদে বন্দী করে রাখতে।

এমন সময় নাসির উদ্দীন হোজ্জা উদারতা দেখিয়ে বললেন, থাক হুজুর থাক, ওকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে লাভ নেই। আমিই তাকে নিয়ে যাই। আহা বেচারা, পাগলা গারদে বন্দী হলে যে তার ছেলেমেয়ে খুব কান্নাকাটি করবে। ওদেরকে তো আমাকেই দেখতে হয়।

এই বলে ইহুদিকে সাথে নিয়ে হোজ্জা বাড়ির পথে পা বাড়ালেন।

২.

নাসিরউদ্দিনের পুরনো বন্ধু আইনুল্লাহহ দূর গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছেন বন্ধুর বাড়িতে। নাসিরউদ্দিন চাইলেন কিছু পরিচিতজনের সঙ্গে বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দিতে। আইনুল্লাহহ বললেন, ‘আমার পোশাক আশাকের অবস্থা সুবিধার নয়, তোমার পাগড়িটা আমাকে ধার দাও।’

নাসিরউদ্দিন নিজের পাগড়ি বন্ধুকে পরিয়ে দিয়ে তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলেন। এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ। সে যে পাগড়িটা পড়েছে সেটা আমার।’

সে বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার পর আইনুল্লাহ মন খারাপ করে বললেন, ‘বন্ধু, পাগড়িটা যে তোমার সেটা ওই লোককে না বললে কি চলছিল না? দয়া করে এরপর যে বাড়িতে যাব সেখানে গিয়ে এটা বলো না।

যে কথা সেই কাজ। পরবর্তী বাড়িতে গিয়ে নাসিরউদ্দিন বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ, এবং সে যে পাগড়িটা পড়েছে সেটি আমার নয়, তার নিজের।’

সেখান থেকে বেরুনোর পরও আইনুল্লাহর মুখ বেজার। বন্ধুকে তিনি বললেন, ‘পাগড়িটা তোমার নাকি আমার এটা কেন টেনে আনতে হবে বুঝলাম না। দয়া করে এই কাজটা আর করো না।

নাসিরউদ্দিন মাথা নাড়লেন এবং পরবর্তী বাড়িতে গিয়ে বললেন, ‘এই হল আমার বন্ধু আইনুল্লাহ। তার মাথায় যে পাগড়িটা দেখছেন সেটা আমার নাকি তার এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলব না।

৩.

হোজ্জা আর তার এক বন্ধু একবার এক হোটেলে ঢুকল কিছু খাওয়ার জন্য। খাওয়া শেষে হিসাব করে দেখল যে, দুই গ্লাস দুধ খাওয়ার মতো টাকা ওদের হাতে নেই। তাই দুজনের জন্য এক গ্লাস দুধ চাইল। দুধ আসার পর হোজ্জার বন্ধুটি বলল, ‘ভাই, তুমি আগে অর্ধেকটা খেয়ে ফেল।’

হোজ্জা জানতে চাইল, ‘কেন?’ জবাবে বন্ধুটি বলল, ‘আমি আবার চিনি ছাড়া দুধ খেতে পারি না। অথচ, একজনের খাওয়ার মতোই চিনি আছে আমার কাছে। তাই বলছিলাম যে, তুমি অর্ধেকটা খেয়ে নিলে বাকিটা আমি চিনি দিয়ে খাব।’

হোজ্জা তখন গ্লাসটা হাতে নিয়ে তার মধ্যে অনেকটা লবণ ঢেলে বলল, ‘তাহলে আমার অর্ধেক ভাগটা আমি লবণ দিয়ে খেয়ে নিলাম। বাকিটা তুমি চিনি মিশিয়ে মিষ্টি করে খেয়ো!’ 

৪.

একবার হোজ্জা বাদশাহর জন্য কিছু উপহার নিয়ে যাচ্ছিল। গেটে প্রহরী হোজ্জাকে আটকে দিয়ে বলল: তোমার উপহার আমাকে দাও, আমিই জাঁহাপনাকে দিয়ে আসব।

হোজ্জা কিছুতেই রাজি হলো না। সে নিজেই উপহার দিয়ে আসতে চায়। এদিকে প্রহরীও নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত হোজ্জা বলল, ‘ঠিক আছে, আমি ভেতরে গিয়ে বাদশাহর কাছ থেকে যা বকশিশ পাব, তার অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দেব।’

এ কথা শুনে প্রহরী হোজ্জাকে ভেতরে যেতে দিল। হোজ্জা দরবারে গিয়ে বাদশাহকে উপহার দেওয়ার পর বাদশাহ খুব খুশি হলেন এবং হোজ্জাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তার কী চাই?

হোজ্জা বলল, ৫০ ঘা বেত্রাঘাত! একথা শুনে দরবারের সবাই অবাক হয়ে গেল! এ কেমন উপহার চাওয়া? বাদশাহ যতই অন্য উপহার দিতে চান, হোজ্জা ততই বেতের বাড়ি নিতে চায়। শেষ পর্যন্ত হোজ্জার জেদের কাছে হেরে গিয়ে বাদশাহ নির্দেশ দিলেন হোজ্জাকে বেত মারার।

২৫ ঘা বেত মারার পর হোজ্জা থামতে বলল। তারপর বাদশাহর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জাঁহাপনা, আমার পুরস্কারের একজন ভাগীদার আছে।’

বাদশাহ জানতে চাইলেন, ‘কে?’ তখন হোজ্জা দরবারে আসার পথে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। পুরো ঘটনা জানার পর বাদশাহ তখন ওই প্রহরীকে ডেকে আচ্ছামতো বেত্রাঘাত করে তার পাওনা মিটিয়ে দিলেন।

বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি শিশুতোষ গান। 'কঁচি কাঁচার ভিড়ের মেলায় আয়রে ছুরে আয়' শিরোনামের গানটি লিখেছেন, আজাদ আশরাফ, সুরকারের মাসুদ রানা আর গেয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর নিহারিকা ফুলকুঁড়ি আসরের সদস্য মুজাহিদ, রাজা, আহমদ, তাহমিদ, নুওয়াইসির ও তানজিম।

তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। (গান)

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৯

ট্যাগ