গল্প ও প্রবাদের গল্প:
প্রাচীন ইরানি গল্প: ব্যবসায়ী ও তোতাপাখি
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প। খুবই অর্থবহ এই গল্পটি নেয়া হয়েছে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি'র বিখ্যাত গ্রন্থ মাসনাবি থেকে। গল্পটি এরকম:
এক ব্যবসায়ীর একটা তোতা পাখি ছিল বেশ সুন্দর। পাখিটি চমৎকারভাবে মানুষের ভাষা নকল করে হুবহু কথা বলতে পারতো। এতোসব গুণের কারণে ব্যবসায়ী পাখিটিকে যত্ন করে একটা খাঁচায় লালন পালন করতো।
একদিন ওই ব্যবসায়ী তার বাণিজ্যিক সফরে ভারতে যাবার জন্য প্রস্তুত হল। বাসায় সবাইকে জিজ্ঞেস করলো কার কী লাগবে। ভারত থেকে সে নিয়ে আসবে। সবাই তাদের চাহিদা মতো প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে বললো। ব্যবসায়ী তোতাপাখিটাকেও বললো তার কোনো চাহিদা থাকলে যেন তাকে বলে। তোতাপাখি বললো: না, আমি কিছুই চাই না। শুধু ভারতের তোতাপাখিদের জন্য আমার একটি বার্তা আছে, সেটা পৌঁছালেই খুশি হবো। সেটা হলো ভারতে যাবার পর তোতাপাখিদের সঙ্গে দেখা হলে আমার সালাম পৌঁছে দেবে এবং আমার জীবন যাপন সম্পর্কে, আমার কুশল সম্পর্কে তাদের জানাবে। তাদেরকে বলবে আমি তাদের সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ-উৎসাহী হয়ে আছি। এখন যেহেতু আমি খাঁচায় বসবাস করছি সে কারণে উড়তে পারছি না, তাই তাদের সঙ্গে দেখা করতে পারছি না।
সবাই বললো এমনকি তোতা পাখি নিজেও একটা বার্তা দিলো ভারতের তোতাপাখিদের জন্য। সেইসঙ্গে পাখি বলেছিল: তোতাদের ফেলে আসা সুন্দর দিনগুলোকে স্মরণে রাখতে বলবে এবং আমাকে যেন তারা মনে রাখে। ব্যবসয়ী সম্মত হলো। তোতাপাখি ব্যবসায়ীকে যা যা বলেছিল সবই করবে বলে আশ্বাস দিলো সে। তারপর ভারত সফরের উদ্দেশে ব্যবসায়ী বাড়ি থেকে রওনা হলো এবং একটা সময় ভারতে গিয়ে পৌঁছলো। একদিন বনে গিয়ে ব্যবসায়ী কয়েকটা তোতাপাখি দেখতে পেলো। তার পোষা তোতার সালাম ও বার্তা তাদেরকে পৌঁছালো।
হঠাৎ করে তোতাপাখিদের একটি কাঁপতে কাঁপতে গাছের ডাল থেকে নীচে মাটিতে পড়ে গেল এবং মরে গেল। ব্যবসায়ী ভীষণ অনুতপ্ত হলো তার কাজের জন্য মানে তার পোষা তোতার বার্তা পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু অনুতপ্ত হয়ে আর হবেটা কি! ব্যবসায়ী ভারতে তার ব্যবসার পালা তাড়াতাড়ি গুটিয়ে নিলো। যেটুকু লাভ হয়েছিল ব্যবসায় তা সঙ্গে নিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেল। তবে বাসার যে যা আনতে বলেছিল সবার জন্যই নিয়ে এসেছিল এবং তাদের হাতে হাতে বুঝিয়ে দিলো। তোতাপাখি দেখলো ব্যবসায়ী তার ধারেকাছে ঘেঁষছে না। খাঁচার ভেতর থেকেই সে ব্যবসায়ীকে ডেকে বললো: আমার চাওয়ার কী হলো? তুমি কি আমার সালাম এবং কুশল ভারতের তোতাপাখিদের কাছে পৌঁছিয়েছো? ব্যবসায়ী বললো: হ্যাঁ, পৌঁছিয়েছি। তবে এ কাজের জন্য আমি ভীষণরকম অনুতপ্ত হয়েছি। যদি না পৌঁছাতাম তাহলেই ভালো হতো, তোতা পাখিদের কষ্টের কারণ হতে হতো না। এই বলে ব্যবসায়ী পুরো ঘটনা খুলে বললো তোতাপাখিকে।
পোষা তোতা ব্যবসায়ীর মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে পাখা ঝাপটাতে শুরু করে দিলো এবং কাঁপতে কাঁপতে খাঁচার ভেতরে মরার মতো পড়ে গেল। কিছুতেই আর নড়াচড়া করলো না। ব্যবসায়ী তো অবাক হয়ে গেল। তার এতো প্রিয় পাখিটা এভাবে মরে গেল? কতো আদর-যত্ন করে ওকে খাঁচায় লালন পালন করেছে সে। কী এমন হলো যে তার কথা শুনলেই তোতা পাখিরা এভাবে কাঁপতে কাঁপতে মরে যায়! ভাবনায় পড়ে গেল ব্যবসায়ী। সে ভীষণরকম অনুতপ্ত হয়ে গেল। প্রিয় পোষা পাখিটির মৃত্যুতে বিমর্ষ হয়ে গেল ব্যবসায়ী। একেবারে কান্নাকাটি রোনাজারি শুরু করে দিল সে।
ব্যবসায়ী তার পোষা তোতার মৃত্যুতে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। নিরুপায় হয়ে বেচারা খাঁচার দরোজা খুলে দিয়ে তোতাপাখির দেহটা বাইরে নিয়ে ফেলে দিলো। হঠাৎ করে পাখিটি উড়াল দিয়ে গাছির উপরে একটি ডালে গিয়ে বসলো। ব্যবসায়ী আরও বেশি অবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে পাখিটির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। তোতার কাছ থেকে তার খুব জানতে ইচ্ছে করলো এই রহস্যের ভেদ। তোতা বললো: ভারতের তোতা পাখি তাদের কাজ দিয়ে আমাকে শিখিয়েছে খাঁচা থেকে মুক্তি পেতে হলে কী করতে হবে। আমি তাদের শেখানো বিদ্যা কাজে লাগিয়েই মুক্তি পেয়েছি।
সে আমাকে শিখিয়েছে মানুষের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস, দয়া, বন্ধুত্ব এসব দূরে ঠেলে দিয়ে তাদের সঙ্গে বরং প্রতারণার আশ্রয় নিতে। সে আরও শিখিয়েছে আমাকে খাঁচায় আটকে রাখার কারণ আমার কণ্ঠস্বর এবং কথা বলার গুণ। সুতরাং মরার ভান করে আমার মতো মুক্ত হয়ে যাও! আমিও তার পরামর্শ অনযায়ী কাজ করেছি এবং মুক্তি পেয়েছি। এসব কথা বলা শেষ করে ব্যবসায়ীকে তোতা কিছু পরামর্শ দিয়ে উড়ে চলে গেল। ব্যবসায়ী মনে মনে ভাবলো: জীবনের বহু জ্ঞান ও হেকমত তোতার কাছ থেকে শেখা উচিত। তার বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে যাতে সবসময় মুক্ত স্বাধীন জীবনযাপন করা যায়।#
পার্সটুডে/এনএম/২৩/১০০
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ