অক্টোবর ০৯, ২০২৩ ১৯:৪৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আব্দুর রশীদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে,  মুমিনের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে পারা। প্রতিটি কাজ-কর্ম, আচার-আচরণে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। সব আদেশ-নিষেধ পালন করে আল্লাহকে রাজি-খুশি করা এবং আল্লাহর ভালোবাসা লাভে নিজেকে ধন্য করা।

আল্লাহকে ভালোবাসা ও তাঁর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য আল্লাহ নিজেই একটি মানদণ্ড নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া ভালোবাসার দাবি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তা হলো- তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা ও তাঁর আনুগত্য করা। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ সুরা আলে ইমরানের ৩১ নম্বর আয়াতে বলেছেন, "হে নবী! বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।"

এই আয়াতে আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসা পোষণের জন্য রাসূলকে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণকে শর্ত করেছেন। সুতরাং রাসুলকে ভালোবাসা ও তাঁর অনুসরণ ছাড়া শুধু আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা যথেষ্ট নয়।

বন্ধুরা, মুমিনের হৃদয়ে নবীর প্রতি ভালোবাসা কী পরিমাণ হবে- তার বিবরণও আল্লাহতায়ালা বলে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, "নবীর সঙ্গে ঈমানদারের প্রাণেরও অধিক সম্পর্ক। তিনি তাদের সত্তা থেকেও তাদের কাছে অগ্রগণ্য।" (সুরা আহযাব: আয়াত ৩৩)

অন্যদিকে, রাসূলেখোদা বলেছেন, ''তোমাদের কেউ (পরিপূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি ও সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।"

বন্ধুরা, ইতিহাসের যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয়পাত্র ও আল্লাহপ্রেমিকদের কাছে আল্লাহর রাসুল ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়। নিজের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও জাতীয় সব অঙ্গনে তারা ছিলেন রাসুলের পূর্ণ অনুসারী। তারা জানতেন যে, প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য অপরিহার্য হলো রাসুলের প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা।  

তো বন্ধুরা, আজকের আসরে আমরা রাসল (সা.)-এর প্রতি এক সাহাবীর ভালোবাসার কাহিনি শোনাব। এরপর থেকে ইরানি এক ছোট্টবন্ধুর ফার্সি কবিতা আবৃত্তি এবং তেহরানপ্রবাসী এক বাংলাদেশি বন্ধুর সাক্ষাৎকার। অনুষ্ঠানটি গ্রন্থনা ও প্রযোজনা করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে সত্য কাহিনিটি শোনা যাক।

প্রতীকী কার্টুন

(এক তৃষ্ণার্তের কাঁধে পানির মশক)

গ্রীস্মকাল। প্রচণ্ড রৌদ্রতাপ। খরা ও দ্রব্যমূল্যের কারণে মদীনাবাসীদের জীবন বাঁচানো ছিল এক কঠিন ব্যাপার। লোকেরা সব সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকতো। হায়! যদি বৃষ্টি হতো তাহলে লোকেরা স্বস্তির নিঃশ্বাস গ্রহণের সুযোগ লাভ করতে পারত।

এমনি অবস্থাতে মহানবী (সা.) সংবাদ পেলেন যে, উত্তরপূর্ব দিকে বসবাসকারী মুসলমানদের জীবন রোমানদের কারণে হুমকির সম্মুখীন। রোমের সৈন্যবাহিনী যে কোনো সময় মুসলমানদের জীবননাশের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং তিনি মদীনাবাসীদের নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য এক্ষুণিই প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

খরার প্রচণ্ডতা মদীনার অধিবাসীদেরকে আগেই কাবু করে রেখেছিল। প্রত্যেকেরই আন্তরিক ইচ্ছা ছিল যে, নতুন ফসলের ফলমূল খাবে। খরার মৌসুমে তাজা ফলফলাদি ছেড়ে কাঠ ফাটা রোদ আর গরম হাওয়ার মধ্যে মদীনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সফর করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। এ অবস্থায় মোনাফিকদের জন্য অঙ্গীকার ভঙ্গ করার পরিবেশ ছিল অনুকূলে।

কিন্তু ভীষণ গরম, তপ্ত রোদের প্রখরতা, খরার প্রচণ্ডতা এবং মোনাফিকদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ইসলামী বাহিনীর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রায় ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্য রোমানদের সম্ভাব্য হামলার মোকাবিলা করার জন্য সিরিয়ার দিকে যাত্রা করল।

মরুভূমির পথ। সূর্য তাদের উপর আগুন বর্ষণ করছিল। তাদের সাথে পানাহার দ্রব্যও খুব বেশি ছিল না। বরং সম্ভাবনা এটাও ছিল যে, না জানি ইসলামী বাহিনীকে পানাহার দ্রব্যের অভাবের সম্মুখীন হতে হয়। তাই কোনো কোনো দুর্বল ঈমানদার লোকেরা পথিমধ্যেই সরে পড়ল। কিছু দূর পথ চলার পর কাআব ইবনে মালেক মদীনার দিকে ফিরে চলে যায়।

সাথীরা গিয়ে রাসূল (সা.)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! কাআব ইবনে মালেক আমাদের সঙ্গ ছেড়ে মদীনায় ফিরে চলে গেছে। রাসূল (সা.) বললেন, তাকে যেতে দাও। যদি তার মধ্যে বিন্দুমাত্রও নেকীর অংশ থেকে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ খুব শীঘ্রই তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। আর যদি তার মধ্যে নেকীর লেশমাত্র পাওয়া না যায়, তাহলে মনে করে নিও যে, আল্লাহ তোমাদেরকে তার অনিষ্টতা থেকে নাজাত দান করেছেন।

কিছুক্ষণ পরেই সাহাবারা আবার রাসূলের কাছে গিয়ে বলল, ইয়া রাসূলুলাহ! মারারা ইবনে রাবীও ইসলামী বাহিনী ত্যাগ করে চলে গেছে। রাসূল (সা.) বললেন, দেখো! যদি তার মধ্যে নেকীর লেশমাত্রও থেকে থাকে তাহলে মহান খোদা খুব শীঘ্রই তোমাদের সাথে দ্বিতীয়বার একত্র করে দেবেন। আর যদি এমনটি না হয় তাহলে বুঝে নেবে যে, আল্লাহ তোমাদেরকে তার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেছেন।

আরো কিছু পরে লোকেরা এসে রাসূলে খোদাকে জানালো ইয়া নাবী আল্লাহ! হেলাল ইবনে উমাইয়্যাও আমাদের দল ছেড়ে চলে গেছে। রাসূলে আকরাম (সা.) এবারও তাদেরকে একই জবাব দিলেন। তারা চুপ হয়ে গেল।

এমন সময় হযরত আবু যার গিফারীর উটটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করলেন যেন কাফেলা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

হঠাৎ কাফেলার লোকেরা লক্ষ্য করে দেখল যে, হযরত আবু যার গিফারীও কাফেলার সাথে নেই। তারা তৎক্ষণাৎ রাসূলে খোদার খেদমতে হাজির হয়ে বলল যে, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! জনাব আবু যারও আমাদের দলচ্যুত হয়েছেন।

মহানবী (সা.) একটা মৃদু শ্বাস টেনে বললেন, যেতে দাও। যদি তার মধ্যে কোনো নেকী থেকে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তাকে আবার তোমাদের সাথে একত্র করে দেবেন। আর যদি এমনটি না হয় তাহলে মনে করবে যে, মহান আল্লাহ তোমাদেরকে তার ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে, আবু যার গিফারি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু উটটি স্বস্থান থেকে এক কদমও নড়ল না। বাধ্য হয়ে তিনি উটের পিঠ থেকে নিচে নামলেন এবং সফরসামগ্রী নিজের কাঁধে নিয়ে পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন। রোদের তীব্রতা তার মাথার উপরে বর্ষিত হচ্ছিল। আর তৃষ্ণার তীব্রতায় তার জিহ্বা বেরিয়ে আসার উপক্রম। কিন্তু তিনি তার এ অবস্থার কথা যেন ভুলে গেলেন। তার স্মরণে কেবল একটাই কথা। কী করে তিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হবেন এবং ইসলামী বাহিনীর সাথে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাই তিনি খুব দ্রুত পদে পথ চলতে লাগলেন।

হঠাৎ আসমানের একদিকে কিছু মেঘমালা দেখতে পেলেন যা দেখে মনে হচ্ছিল যে, বৃষ্টি হতে পারে। তিনি সেদিকে ঘুরলেন। এসময় তার পা একটা ভারী পাথরের সাথে ধাক্কা খেল। তিনি চেয়ে দেখলেন সেখানে বৃষ্টির পানি জমা আছে। তিনি সামান্য পানি পান করলেন এবং পিপাসা পুরোপুরি নিবারণ না করেই দাঁড়িয়ে গেলেন।

আবু যাব ভাবলেন যে, হতে পারে আল্লাহর নবী (সা.) তৃষ্ণার্ত রয়েছেন। এ ভেবে তিনি কাঁধ থেকে খালি মশকটি নামালেন এবং সে পানি মশকে ভরে নিলেন। মশকটি কাঁধে করে চলতে লাগলেন। গরমের তীব্রতায় তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে উঁচু-নিচু পথ অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকলেন।

কিছুক্ষণ পথ চলার পর অনেক দূরে ইসলামী বাহিনীর অবস্থান দেখতে পেলেন। এ দেখে তিনি খুব খুশি  হলেন এবং আরো দ্রুত পদে পথ চলতে লাগলেন। এসময় ইসলামী বাহিনীর একজন সৈনিক দেখতে পেল যে, একজন লোক দ্রুতগতিতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

তাঁরা রাসূল (সা.) এর কাছে গিয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাসূল (সা.) খুশির ভাব প্রকাশ করে বললেন, হায়! সে যদি আবু যার হতো।

এসময় আগমনকারীর ছায়া নিকটতর হতে থাকল। লোকেরা তাকে দেখে চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠল, খোদার কসম! আগন্তুক ব্যক্তিটি হযরত আবু যার ব্যতীত আর কেউ নন।

একথা শুনে রাসূলে আকরাম (সা.) বললেন, হে পরোয়ারদিগার! আবু যারকে ক্ষমা করে দাও। সে একাই জীবনযাপন করে, একাই মৃত্যুবরণ করে আর একাই হাশরে উপস্থিত হয়।

এরপর মহানবী (সা.) আবু যারকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করলেন। আবু যার তার কাঁধের সমস্ত মালামাল মাটিতে রেখে দিলেন। ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন।

এসময় রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে বললেন, তাড়াতাড়ি পানি আনো। আবু যারকে পানি খাওয়াও।

একথা শুনে আবুযার বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার সাথে পানি আছে।

রাসূল (সা.) বললেন, পানি তোমার সাথে ছিল  অথচ তুমি পিপাসায় কষ্ট করেছো? তৃষ্ণা নিবারণ করোনি?

তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমার পিতামাতা আপনার জন্য কোরবান হোক! পথে আমি একটি পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়েছি। দেখলাম সেখানে পানি জমা আছে। আমি একটুখানি পানি পান করে দেখলাম যে, পানি ভালো আছে। তখন আমি ভাবলাম যে, আল্লাহর নবীকে পানি পান না করিয়ে আমি নিজে পানি পান করবো না।

আবু যারের কথা শুনে নবীজির মুখে হাসি ফুটে উঠল। একেই বলে প্রকৃত ভালোবাসা।

ছোট্টবন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে একটি ফার্সি কবিতা। আবৃত্তি করেছে তেহরানের জাহানে তারবিয়াত বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তাহা। 

রেডিও তেহরান কার্যালয়ে মোহাম্মদ তাহা

তাহা'র চমৎকার উচ্চারণে প্রার্থনামূলক কবিতাটি শুনলে। তো বন্ধুরা, এখন তোমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো তেহরানপ্রবাসী বাংলাদেশি বন্ধু জাহরা মুনীরি মুনতাহার সঙ্গে। 

শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো আবারো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি আজকের আসর। কথা হবে আবারো আগামী আসরে।

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/৯

 

ট্যাগ