পশ্চিমা গণমাধ্যমের স্বরূপ উন্মোচনবিষয়ক ধারাবাহিক
ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-১)
পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হচ্ছে যেকোনো ঘটনাকে উল্টো করে তুলে ধরা। দর্শক-শ্রোতা-পাঠককে উত্তেজিত করে জনমতকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে এসব গণমাধ্যমের জুড়ি নেই। বিশেষ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য এসব গণমাধ্যমে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারা মনগড়া কল্পকাহিনী প্রচার করে একটি ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর এই নাশকতামূলক তৎপরতা তুলে ধরার জন্য আমরা এই নতুন ধারাবাহিকের আয়োজন করেছি। এই অনুষ্ঠানে আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যেসব কল্পকাহিনী প্রচার করে সেসবের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করব। সেইসঙ্গে এসব প্রচারণাকে ব্যর্থ করে দিতে ইরানের পক্ষ থেকে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলোও আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব।
বহুল প্রচারিত একটি ঘটনা বর্ণনা বর্ণনা করে আজকের আসর শুরু করব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের সেন্টার পার্কে একটি পাগলা কুকুর একটি শিশুর ওপর হামলা চালায়। এ দৃশ্য দেখে এক ব্যক্তি সাহস করে কুকুরটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং কুকুরটিকে গলা টিপে হত্যা করেন। এ সময় নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কুকুরের হাত থেকে শিশুটিকে উদ্ধারকারী ব্যক্তির কাছে ছুটে যান এবং তাকে বলেন: আগামীকাল নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ব্যানার শিরোনামটি হবে এরকম: “নিউ ইয়র্কের এক সাহসী যুবক এক বালকের জীবন রক্ষা করেছে।” এ সময় ওই ব্যক্তি সাংবাদিককে বলেন: আমি তো নিউ ইয়র্কের অধিবাসী নই। তখন সাংবাদিক বলেন: তাহলে শিরোনামটি হবে এরকম: “একজন বীর মার্কিন নাগরিক একটি বালকের জীবন রক্ষা করেছে।” এ সময় ওই ভদ্রলোক বলেন: কিন্তু আমি মার্কিন নাগরিক নই। আমি একজন পাকিস্তানি।
একথা শোনার পর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সেখান থেকে চলে যান। পরদিন পত্রিকাটির শিরোনাম করা হয় একরম: “বর্বর মুসলমানদের হাতে নিকৃষ্ট প্রাণী কুকুরের জীবনও নিরাপদ নয়।” খবরটির ইন্ট্রোতে লেখা হয়: “গতকাল সেন্টার পার্কে এক উগ্র মুসলমান একটি কুকুরকে গলা টিপে হত্যা করেছে। এফবিআই ধারনা করছে এ ঘটনার পেছনে আল-কায়েদার হাত আছে।”
বিগত বছরগুলোতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা পেন্টাগন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে রণকৌশল অবলম্বন করে এই ঘটনাকে তার একটি ক্ষুদ্র নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। র্যান্ড কর্পোরেশন এখন থেকে দুই দশকেরও বেশি সময় আগে ‘নেটওয়ার্ক যুদ্ধ’ সম্পর্কে একটি বই প্রকাশ করে। বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাক্য ছিল এরকম: “আগামীর যুদ্ধে সেই পক্ষ বিজয়ী হতে পারবে না যার কাছে সবচেয়ে বড় বোমা আছে বরং সেই পক্ষ বিজয়ী হবে যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ঘটনা রটিয়ে দিতে পারে।”
গণমাধ্যম বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমানে গণমাধ্যমের কাজের ধরন হচ্ছে তারা আগে ঘটনার বর্ণনা তৈরি করে এবং তারপর সেই বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনা সাজায়। ইরানের গণমাধ্যম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মাদ জাওয়াদ মোহাম্মাদি এ সম্পর্কে বলেন: “বর্তমানে যোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পশ্চিমা গণমাধ্যম যন্ত্রগুলো এমন একটি ভাব দেখায় যে, তাদের দেশগুলোতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাক স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তাদের আচরণে মনে হয়, পশ্চিমা দেশগুলোর গণমাধ্যমগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে এবং তাদের ওপর সরকার বা প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে যেসব খবর, তথ্য, সংবাদ বিশ্লেষণ ও মতামত প্রচারিত হয় এবং যেসব সংবাদের ভিত্তিতে এসব দেশের জনমত পরিচালিত হয় তার সবই আগে থেকে সাজানো থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে দিক নির্দেশনা পেয়ে বৃহৎ গণমাধ্যমগুলো এসব ঘটনার চিত্রনাট্য সাজিয়ে দেয় এবং বাকিরা তা অনুসরণ করে মাত্র।”
মোহাম্মাদি আরো বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোতে এভাবে ঠিক করে দেওয়া চিত্রনাট্যের বাইরে কোনো খবর বা সংবাদ বিশ্লেষণ প্রচার বা প্রকাশের সুযোগ নেই বললেই চলে। এভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বৃহৎ গণমাধ্যমগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য বিরাজ করছে।”
বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের মনোজগতে সেই চিন্তাধারা স্থান করে নিতে পারে যা আকর্ষণীয় বর্ণনা উপস্থাপন করতে পারে এবং সেই বর্ণনাকে সঠিক প্রমাণ করে দৃশ্যপটে জায়গা করে নিতে পারে। যেকোনো ঘটনার প্রথম বর্ণনাটি যে প্রতিষ্ঠান উপস্থাপন করতে পারবে সেটি দর্শক-শ্রোতার দৃষ্টি নিজের দিকে কেড়ে নেবে এবং তার পক্ষেই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি জনমতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এভাবে গণমাধ্যম ও ইন্টারনেটের এই যুগে যেকোনো ঘটনাকে সবার আগে কে কীভাবে বর্ণনা করল তার ওপর চূড়ান্ত বিজয়ী কে হবে তা নির্ভর করে। শুধুমাত্র আগে ঘটনা বর্ণনা করে বিজয়ী হওয়ার এ প্রবণতাকে ‘যুদ্ধ ছাড়া বিজয়’ বলে অভিহিত করা হয়।
ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাসান খুজাস্তে বলেন: “গণমাধ্যম জগতে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ঘটনা রটিয়ে দেওয়া। যুদ্ধ জয়ে এই রটনা সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে।”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের ভাষায়: “চলতি শতাব্দীতে আমরা ঘটনা-রটনার যুদ্ধে প্রবেশ করেছি। যেদিন যে গণমাধ্যম তার বর্ণনাকে বা তার প্রতিবেদনকে অন্য সব ঘটনার ওপর স্থান দিতে পারবে সেদিনের জন্য ওই গণমাধ্যম গোটা সংবাদ জগতকে শাসন করবে।”
বর্তমান বিশ্বে দুঃখজনকভাবে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র, সিনেমা, ইন্টারনেট, রেডিও ও মিউজিক চ্যানেলগুলোর নিয়ন্ত্রণ ইহুদিবাদীদের হাতে রয়েছে। এ কারণে যেকোনো ঘটনা রটিয়ে দিয়ে তার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ইহুদিবাদী শক্তিগুলো। বিশ্বের বেশিরভাগ শক্তিশালী ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম কোম্পানিগুলোর মালিকানা হয় ইহুদিদের হাতে রয়েছে অথবা তাদের প্রভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স, অ্যাসোশিয়েটেড প্রেস বা এপি, ইউনাইটেড প্রেস কিংবা প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, আইবিসি নিউজ, সিবিএস নিউজ, টাইমস, ডেইলি এক্সপ্রেস, ডেইলি নিউজ, সান, এমনকি ফেসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলিও ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া ও ইতালির মতো পশ্চিমা দেশগুলোর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলিও ইহুদিবাদীরা নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে তৈরি পরিকল্পনা অনুযায়ী, খবর ও সংবাদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করে এবং গোটা বিশ্বের জনমতকে নিজ ইচ্ছে অনুযায়ী পরিচালিত করে।
বিশ্বের সাধারণ মানুষের ধারনা, গণমাধ্যমগুলো যা কিছু ঘটে তার ওপর ভিত্তি করে সংবাদ তৈরি করে। কিন্তু বাস্তবতা তেমনটি নয়। কোনো পেশাদার গণমাধ্যমই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া কোনো খবর বা ছবি প্রচার করে না। তারা আগে থেকে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করে যা হয়তো তাদের কোনো খবর বা সংবাদ বিশ্লেষণে সরাসরি বর্ণনা করে না। কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করে নেয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিবিসির থিংক ট্যাংক এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে উন্নতি ও অগ্রগতির মডেল হিসেবে তুলে ধরতে হবে এবং প্রমাণ করে দিতে হবে যে, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করার কারণেই আরব আমিরাতের এই উন্নতি সম্ভব হয়েছে। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিবিসি হাজার হাজার খবর ও সংবাদ বিশ্লেষণ তৈরি করবে। শত শত প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করে সামাজিক আন্দোলন শুরু করে দেবে। আর এতকিছুর ফলস্বরূপ সাধারণ দর্শক-শ্রোতা কোনো ধরনের চিন্তাভাবনা বা গবেষণা ছাড়াই একথা গভীরভাবে বিশ্বাস করবে যে, সংযক্ত আরব আমিরাত এখন উন্নত বিশ্বে প্রবেশ করেছে।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক: ইরাকে মোতায়েন মার্কিন বাহিনীর সাবেক কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস একবার দাবি করেন, ইরানের কুদস ফোর্সের সাবেক কমান্ডার লে. জেনারেল কাসেম সোলায়মানি আমেরিকার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের দর্শক-শ্রোতাদের ওপর এমনভাবে খবর, গুজব ও সংবাদ বিশ্লেষণের বোমা পড়তে থাকে যে, ইরাকে নিযুক্ত ইতালির তৎকালীন রাষ্ট্রদূত মার্কো কারনেলসের বক্তব্য কারো কানে পৌঁছে না। কারনেলস বলেছিলেন, বিবিসি মিথ্যা বলছে এবং বাস্তবতাকে উল্টো করে তুল ধরছে। আমরা বরং ইরাকের শিয়া যোদ্ধাদের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তাদের হাত-পা ধরছিলাম যে, তারা যেন জেনারেল সোলায়মানির সঙ্গে আমাদের বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু সোলায়মানি আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।
ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর থেকে এদেশের মানুষ, ইসলামি বিপ্লব ও প্রতিরোধ অক্ষ সম্পর্কে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো শত শত মিথ্যা খবর, গুজব ও রটনা তৈরি করে তা প্রচার করেছে। আমরা আমাদের এই নতুন ধারাবাহিকে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর ঘটনা ও রটনা তৈরির এই প্রক্রিয়ার স্বরূপ উন্মোচনের চেষ্টা করব। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ইরান সম্পর্কে নেতিবাচক ও হতাশাজনক চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরলেও বাস্তবতা হচ্ছে ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞান, সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিশ্বের বহু দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ইরানের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে হলে এসব উন্নতির খবর প্রচার করতে হবে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী গণমাধ্যম কর্মীদের এক সমাবেশে যেমনটি বলেন: “আপনারা আপনাদের সমাজের প্রকৃত বাস্তবতা এবং আপনাদের বিপ্লব সম্পর্কে সঠিক চিত্র তুলে ধরুন। আপনারা যদি বাস্তবতা প্রচার না করেন তাহলে শত্রুরা তাদের ইচ্ছেমতো প্রচার করবে। তারা মিথ্যা বলবে এবং বাস্তবতা ১৮০ ডিগ্রি উল্টো করে তুলে ধরবে। নির্যাতিতকে নির্যাতনকারী এবং নির্যাতনকারীকে নির্যাতিত হিসেবে তুলে ধরতে তাদের জুড়ি নেই।”#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএআর/২২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।