ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (১৫৯): খোররামশাহর মুক্ত করার বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযান
আশা করছি আপনারা প্রত্যেকে ভালো আছেন। গত আসরে আমরা ইরানের সংগ্রামি নেতা ও সাহসী যোদ্ধা শহীদ মোস্তফা চামরানের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে খানিকটা কথা বলেছি। আজ আমরা পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে ইরানের এই মহান যোদ্ধার অবদান ও তাঁর শাহাদাত সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।
পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ সম্পর্কে শহীদ চামরানের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। তিনি বলেন, “যখন রণদামামা বেজে ওঠে তখন কাপুরুষদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং হে রণাদামামা তুমি বেজে ওঠো।” ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরান থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক সরকার উৎখাত হয়ে যায়। সে সময়কার ক্ষমতাচ্যুত শাহ সরকারের প্রতি আমেরিকার অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল বলে নবগঠিত ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর জন্য উঠেপড়ে লেগে যায় মার্কিন সরকার। এ সময় ইরানের ইসলামি সরকারকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হয়। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ইরাকের সামরিক আগ্রাসন প্রতিহত করার মতো কোনো ধরনের প্রস্তুতি ইরানের ছিল না।
সাদ্দাম বাহিনী আগ্রাসন চালালে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে দেশের আপামর জনতা আগ্রাসী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইরাকের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইরান গেরিলা যুদ্ধ চালানোর কৌশল গ্রহণ করে। ইরাকের সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলায় একটি বিশৃঙ্খল সেনাবাহিনীই ইরানের একমাত্র দুর্বলতা ছিল না। এক হাজার ৪৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে ইরাকের আগ্রাসন প্রতিহত করার উপায় নিয়েও দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল মতবিরোধ। এই মতবিরোধের কারণে যুদ্ধের শুরুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিয়ে সাদ্দাম বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিহত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ইরাকি বাহিনী ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত দিয়ে আগ্রাসন চালালেও এই বাহিনীকে ইরানের গভীর অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার কাজে যেসব কমান্ডার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তাদের মধ্যে শহীদ চামরানের নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে ইরানের জনগণ। তিনি যুদ্ধের শুরুতেই ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশের আহওয়াজ শহরে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। তিনি একদিকে গেরিলা হামলা চালিয়ে ইরাকি বাহিনীর অগ্রাভিযান প্রতিহত করেন এবং অন্যদিকে বেদখল হয়ে যাওয়া এলাকাগুলো পুনর্দখল করে ইরানি যোদ্ধাদেরকে রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। খুজিস্তান প্রদেশের সুসাংগার শহর মুক্ত করার অভিযান ছিল এরকমই একটি উল্লেখযোগ্য অভিযান। সুসাংগার পুনরুদ্ধারের অভিযান ছিল আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট।
চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় দুই মাস পর ১৯৮০ সালের ১৭ই নভেম্বর সুসাংগার পুনরুদ্ধার করার অভিযান শুরু হয়। ওই অভিযান সম্পর্কে ড. চামরান তার স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন: “অবশেষে আমাদের অভিযান শুরু হয়ে যায়। সুসাংগারে ইরাকি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ বন্ধুদের দেখার জন্য আমার প্রাণ তখন আনচান করছিল। আমার পরিচিত কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা সুসাংগারে ইরাকি বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। লেফটেনেন্ট ফারাজি ও লেফটেনেন্ট আখাওয়ান আহত শরীরে আমাদের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করেছিল। তিন দিন ধরে তাদের কাছে কোনো খাবার ছিল না। এদিকে আলেমদের ফতোয়া ছাড়া তারা শহরের কোনো দোকান বা পরিত্যক্ত ঘরবাড়িতে ঢুকে খাবার সংগ্রহ করতেও তারা রাজি হচ্ছিল না।”
সুসাংগার অভিযানে ইরানের সেনাবাহিনী, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি এবং গেরিলা বাহিনী তিন দলে ভাগ হয়ে আলাদা আলাদা দায়িত্ব নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। শহীদ চামরান নিজের গেরিলা বাহিনী নিয়ে আইআরজিসি ও সেনাবাহিনীর মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে সরাসরি সুসাংগারে প্রবেশ করার পরিকল্পনা করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমরা প্রতি মুহূর্তে আমাদের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমরা একটি ইরাকি ট্যাংককে দ্রুত গতিতে আমাদের দিকে আসতে দেখি। আমার দলের যোদ্ধাদেরকে নিজেদের আড়াল করার নির্দেশ দিলাম। একজনকে একটি আরপিজি দিয়ে ট্যাংকটির উপর হামলা চালাতে পাঠালাম। ট্যাংকটি হঠাৎ তার গতি কমিয়ে দিল। মনে হলো, এটি ইরানি যোদ্ধাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। এ অবস্থায় এটি নিজের গতি বাড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আরপিজি দিয়ে এটির উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।”
যুদ্ধের এ পর্যায়ে ড. চামরান সেনাপ্রধান জেনারেল ফাল্লাহির কাছে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান পাঠানোর আবেদন জানান। কিন্তু সে সময় সুসাংগারের জন্য যুদ্ধবিমান বা হেলিকপ্টার পাঠানোর অবস্থা সেনাবাহিনীর ছিল না। জেনারেল ফাল্লাহি ড. চামরানের জন্য ট্যাংক বিধ্বংসী একটি ১০৬ মিলিমিটারের আগ্নেয়াস্ত্র পাঠান। শহীদ চামরানের গেরিলা ইউনিট ওই আগ্নেয়াস্ত্রটি দিয়ে ইরাকি বাহিনীর ছয়টি ট্যাংক বিধ্বস্ত করে। কিন্তু ট্যাংক ধ্বংস করার জন্য এই ইউনিটের হাত খুব অল্প সংখ্যক আরপিজি ছিল। এরকম যুদ্ধাস্ত্রের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে ইরানি যোদ্ধারা ‘আল্লাহু আকব’র' স্লোগান দিয়ে শত্রুবাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। হাতাহাতি এ লড়াইয়ে মোস্তফা চামরান আহত হন। তার নেতৃত্বাধীন ইউনিটের অগ্রাভিযানে ইরাকি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় আহত চামরানের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে। তাকে ইরাকি বাহিনীর কাছ থেকে গনিমাত হিসেবে পাওয়া একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে পেছনের দিকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ইরানি যোদ্ধারা সুসাংগার শহরে প্রবেশ করেন এবং আগে থেকে সেখানে অবস্থান করা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। ইরান শিবিরে উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যায়। তারা সুসাংগারের কেন্দ্রীয় মসজিদে ইরানি যোদ্ধাদের প্রধান ঘাঁটিতে মিলিত হন। ড. চামরান মনে করতেন, সেনাবাহিনী, আইআজিসি ও গেরিলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুসাংগার পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। এই তিন বাহিনীর কারো একার পক্ষে এই সাফল্য অর্জন করা সম্ভব ছিল না। ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে সুসাংগার মুক্ত করার অভিযানে অংশ নিতে পেরে দম্ভ প্রকাশ করেননি ড. চামরান।
তিনি বরং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এভাবে: “হে আল্লাহ! হে পরওয়ারদিগার! আমার যা কিছু আছে তা তোমারই দেওয়া, আমি যা কিছু করেছি তা তোমার দেওয়া শক্তিতে করেছি। আমার নিজের কিছুই নেই যা আমি তোমাকে উপহার দেব। আমি এমন কিছু করিনি যার কারণে আমি তোমার কাছে পুরস্কার দাবি করব।” ড. চামরান পরবর্তীতে একটি অভিযানে ইরাকি বাহিনীর নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে শহীদ হন।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেনী (রহ.) ড. চামরানের শাহাদাত সম্পর্কে এক বাণীতে বলেন: “প্রিয় চামরান সব ধরনের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিভেদের ঊর্ধ্বে থেকে সব সময় শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিকে জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছিলেন। এই লক্ষ্যে তিনি জীবন কাটিয়েছেন এবং এই লক্ষ্যেই শাহাদাতে অমীয় সুধা পান করেছেন। তিনি গর্বিত জীবন যাপন করেছেন এবং গর্বভরে শাহাদাত বরণ করেছেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা, ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস শীর্ষক ধারাবাহিকের আজকের সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #
পার্সটুডে/ মুজাহিদুল ইসলাম/বাবুল আখতার/৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।